খাজনা তত্ত্ব (Theory of Rent)
খাজনা নির্ধারণের দুটি তত্ত্ব বিদ্যমান। যথা-
১. রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব।
২. আধুনিক খাজনা তত্ত্ব।
রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব (Ricardian Theory of Rent)
প্রখ্যাত ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো ১৯০০-এর প্রথম দিকে খাজনা সম্পর্কে যে তত্ত্ব প্রদান করেন, তা তার নামানুসারে ‘রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। এ তত্ত্বে তিনি খাজনার অর্থ, উৎপত্তির কারণ এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেন।
ডেভিড রিকার্ডো (১৭৭২-১৮২৩) তদানীন্তন স্মিথীয় গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে অর্থনীতিকে নতুন রূপ দেন। রিকার্ডে বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করেন এবং তার ভবিষ্যৎ ছিল হতাশাবাদী। তার মতে, পণ্যের মূল্য নির্ভর করে উৎপাদন ব্যয়ের ওপর । তার উল্লেখযোগ্য অবদান হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আপেক্ষিক সুবিধা তত্ত্ব, জমির খাজনা তত্ত্ব প্রভৃতি।
ইংল্যান্ডের ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদ The Principles of Political Economy and Taxation’ নামক গ্রন্থে খাজনা সম্পর্কে যে মতামত ব্যক্ত করেন সেটাই ‘রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বে খাজনা কী? কেন খাজনার উৎপত্তি হয় এবং কীভাবে এর পরিমাণ নির্ধারিত হয়? এ সকল বিষয়
সম্পর্কে রিকার্ডো তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করেন।
মূল বক্তব্য: খাজনা তত্ত্বে রিকার্ডো বলেন, খাজনা হলো জমির উৎপাদনের সেই অংশ যা জমির আদি ও অবিনশ্বর শক্তি ব্যবহারের জন্য জমির মালিককে দেওয়া হয়। তার মতে, চাহিদার তুলনায় জমির যোগানের স্বল্পতাই খাজনা উদ্ভবের কারণ। তাছাড়া জমির উর্বরতা শক্তি ও অবস্থানগত পার্থক্য এবং জমিতে ক্রমবর্ধমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধি দ্রুত কার্যকরি হওয়ায় খাজনা দিতে হয়।
জমির উর্বরা শক্তির পার্থক্যের কারণেও উৎপন্ন ফসলের পরিমাণের পার্থক্য ঘটে। সে জন্য খাজনার পরিমাণও কম-বেশি হয়। আর যে জমির উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ এবং খরচ সমান হয় তাকে প্রান্তিক জমি (marginal land) বা খাজনাবিহীন জমি বলে অভিহিত করেন। এরূপ জমির আয় এবং উৎপাদন খরচ পরস্পর সমান বলে খাজনা দিতে হয়। না। যেহেতু রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্ব সিলেবাসে নেই। তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি।
অনুমিতি (Assumption):
১. সমগ্র সমাজের দৃষ্টিকোণ হতে জমির যোগান সীমাবদ্ধ।
২. জমি প্রকৃতির দান বলে এর যোগান দাম নেই।
৩. জমির উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি কার্যকরী.। 8. বিভিন্ন জমির উৎপাদন ক্ষমতা বা উর্বরতার পার্থক্যের কারণে খাজনার উদ্ভব হয়।
৫. জমির মৌলিক এবং অবিনশ্বর ক্ষমতা রয়েছে।
৬. পূর্ণপ্রতিযোগিতা বিদ্যমান।
৭. খাজনা দামের মধ্যে প্রবেশ করে না।
৮. অধিক উর্বর জমি প্রথমে ও কম উর্বর জমি পরে চাষ করা হয়।
খাজনা
খাজনা তত্ত্বের ব্যাখ্যা: ধরি, জনমানবহীন একটি দ্বীপে কিছু লোক বসবাস করার জন্য গমন করে। তারা প্রথমে ঐ সমস্ত জমি চাষাবাদ করবে যেগুলো তাদের অবস্থানের কাছাকাছি বা উর্বর। এ পর্যায়ে জমির কোনো খাজনা নেই এবং তা প্রথম শ্রেণির জমি নামে পরিচিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রথম শ্রেণির জমির ফসল দিয়ে খাদ্য সমস্যা দূর করা যায় না বলে দ্বিতীয় শ্রেণির জমি চাষের আওতায় আসবে। যেহেতু দ্বিতীয় শ্রেণির জমির চেয়ে প্রথম শ্রেণির জমির উৎপাদন ক্ষমতা বেশি সেহেতু প্রথম শ্রেণির জমিকে এ পর্যায়ে অবশ্যই খাজনা দিতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণির জমি খাজনাবিহীন জমি নামে পরিচিত হবে। জনসংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেলে তখন তৃতীয় শ্রেণির জমি চাষের আওতায় আসবে। ফলে দ্বিতীয় শ্রেণির জমিতে খাজনার সৃষ্টি হবে। ফলশ্রুতিতে প্রথম শ্রেণির জমির খাজনা আরও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণির জমিতে খাজনার সৃষ্টি হবে না। এ তৃতীয় শ্রেণির জমিকে প্রান্তিক জমি হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে।
সমালোচনা : আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বকে বিভিন্নভাবে সমালোচনা করেছেন। এগুলো নিম্নরূপ—
১. জমির অবিনশ্বর ক্ষমতা: আধুনিক অর্থনীতিবিদদের মতে, জমির কোনো অবিনশ্বর ক্ষমতা নেই। কেননা ক্রমাগতভাবে একই জমিতে চাষ করতে থাকলে উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়। আবার সেচ, সার এবং উন্নত বীজ প্রয়োগ করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কাজেই এ অবস্থায় জমির কোনো অবিনশ্বর ক্ষমতা নেই।
২. চাষ পদ্ধতি: রিকার্ডো বলেন, প্রথমে কৃষক প্রথম শ্রেণির জমি চাষ করে, অতঃপর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রেণির জমি চাষ করে। সত্য বলতে কী, বাস্তবে এ ধরনের যাচাই বাছাই করে চাষ করা হয় না।
৩. খাজনাবিহীন জমি; রিকার্ডো ধরে নিয়েছেন যে, ৩য় শ্রেণির জমি খাজনাবিহীন। কিন্তু বাস্তবে কোথাও এ ধরনের জমির অস্তিত্ব নেই।
৪. ক্রমহ্রাসমান উৎপাদন বিধি: রিকার্ডো বলেছেন, কেবল জমির উর্বরতার কারণে খাজনা প্রদান করতে হয়। কিন্তু যুক্তিটা সত্য নয় । কেননা উর্বর না হলেও ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উৎপাদন বিধির কারণে খাজনা প্রদান করতে হয়।
৫. খাজনা ও দাম: রিকার্ডের মতে, দাম খাজনাকে প্রভাবিত করে না। কিন্তু আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ এ কথা স্বীকার করতে রাজি নন । তারা বলেন, দাম খাজনাকে প্রভাবিত করে।
৬. খাজনা উদ্ভবের মূল কারণ অনুদ্ঘাটিত: আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, খাজনা উদ্ভবের মূল কারণ হলো চাহিদার তুলনায় যোগানের স্বল্পতা, কিন্তু তা রিকার্ডো উল্লেখ করেন নি।
৭. খাজনা নির্ধারণ পদ্ধতি: মূলত এ তত্ত্বে জমির খাজনার কারণ ও পার্থক্য ব্যাখ্যা করা হয়। কীভাবে খাজনা নির্ধারিত হয় তা ব্যাখ্যা করা হয় না।
৮. পৃথক তত্ত্ব নিষ্প্রয়োজন: রিকার্ডো বলেন, কেবল জমি থেকেই খাজনা সৃষ্টি হয়। কিন্তু আধুনিক অর্থবিজ্ঞানীগণ মনে করেন, সীমাবদ্ধ যোগান বিশিষ্ট যেকোনো উপকরণ খাজনা সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, কেবল জমির জন্য আলাদা একটি তত্ত্ব প্রয়োগ করা নিষ্প্রয়োজন। ৯. উপাদানের দাম: মার্শাল বলেন, খাজনা হলো জমির দাম এবং জমি উৎপাদনের উপকরণ। অতএব, অন্যান্য
উপকরণ হতে একে আলাদা করে বেশি গুরুত্ব প্রদান করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এসব সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও রিকার্ডোর খাজনা তত্ত্বের গুরুত্ব হ্রাস পায় নি। বিশেষ করে অনুপার্জিত আয় ভোগকারী সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এবং আধুনিক খাজনা তত্ত্ব বিশ্লেষণে এ তত্ত্ব সোপান হিসাবে কাজ করেছে।
Recent Posts