হিকমা ও বিজ্ঞান
অনেকে জ্ঞানের চেয়ে বিজ্ঞানের বিশেষায়ণের কারণে বিজ্ঞানের প্রতিশব্দ হিসেবে ইলমের পরিবর্তে حكمة পরিভাষাটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। আল্লাহ তা’আলা আল-কুরআনকে হিকমতপূর্ণ কুরআন” বা বিজ্ঞানময় কুরআন হিসেবে ঘোষণার কারণে এ ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণে حكمة পরিভাষাটি সম্পর্কে আলোচনা আবশ্যক।
আভিধানিকভাবে حكمة পরিভাষাটির কয়েকটি অর্থ রয়েছে। যেমন-
১) সুদৃঢ় হওয়া, মজবুত হওয়া।
২) নিষেধ করা, বাধা দেয়া।
৩) কোনো বস্তুকে যথাস্থানে রাখা।
৪) আলাদা কোনো সীমা প্রতিষ্ঠিত করা, স্বতন্ত্র মাত্রা নির্ধারণ করা।
৫) মীমাংসা করা, সমাধান করা।
الحكمة (হাকীম) শব্দটি হিকমাহ ধাতুমূল থেকে উৎপন্ন শব্দ।
তাফসীরে কাশশাফে হিকমাহ শব্দের কয়েকটি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
১) কথা ও কাজকে সুদৃঢ় ও মজবুত করা।
২) সত্যের খাতিরে সত্যের পরিচয় লাভ এবং কল্যাণের পরিচয় লাভ সত্যনিষ্ঠ আমল বা কর্মের জন্য এবং এটা হলো শরীআতের বিধি-নিষেধ সংক্রান্ত জ্ঞান।
৩) আহলি সুলুক বা তারীকাতপন্থীদের মতে, হিকমাহ হলো নাফসের এবং শয়তানের কুহক সম্বন্ধে জ্ঞান এবং সাধনা পদ্ধতির পরিচয় লাভ করা।
৪) কর্মসম্পর্কে বুদ্ধিপ্রসূত প্রজ্ঞার একটি রূপ হলো হিকমাহ যা প্রতারণা এবং নির্বুদ্ধিতার প্রতিরোধক। এটি আদালত বা ভারসাম্য তথা সুবিচারের অংশবিশেষ।
৫) হিকমাহ অর্থ বুরহান বা প্রমাণ, প্রমাণের অধিকারীকে হাকীম বলা হয়। ৬) মুসলিহাত বা উপকারিতা ও কল্যাণকামিতা।
৭) সূফীগণের মতে, হিকামহ হলো সুকুত আনহা সম্পর্কে জ্ঞান যে বিষয়ে কারো কথা বলা উচিত নয়, বরং নিশ্চুপ থাকা ভালো।
ইমাম জুরজানীর মতে, হিকামহ কেবল তত্ত্ব জ্ঞানকেই বোঝায় না বরং আমলও হিকমাতের মধ্যে শামিল রয়েছে। যেমন শরীআত সম্পর্কিত উলুম ও হালাল-হারামের জ্ঞান লাভ করা। এছাড়া সে রহস্যসমূহও হিকমাতের অন্তর্ভুক্ত যা সাধারণ ইলমের গতি বহির্ভূত। অর্থাৎ ইলাহী সত্তার রহস্যসমূহও হিকমাতের অন্তর্ভুক্ত। আর ইলাহী সত্তার রহস্য হলো আল্লাহ তা’আলার যাত সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করা।
ইবনে মিসকাওয়ায়হ কিতাবুত তাহারাতে লিখেছেন, হিকমাহ হলো ভেদাভেদের জ্ঞানসম্পন্ন মানবমনের ফাযীলত। অর্থাৎ মানবীয় সামর্থ্য অনুসারে বিশ্ব চরাচরের রহস্য সম্পর্কিত জ্ঞান যা একে মুক্তিপ্রসূত জ্ঞানসমূহের উদ্ভব ঘটে, যা ভালো-মন্দের পার্থক্যকরণ শিক্ষা দেয়। ইবনে মিসকাওয়ায়হ হিকমাতের শ্রেণিবিভাগ নির্দেশ করেছেন, যথা থাকা বা তীক্ষ্ণবুদ্ধি, ভাজাক্কুল বা অনুধাবন, সারআতু ফাহমিন বা দ্রুত উপলব্ধি ইত্যাদি
ইবনে সিনার মতে, ইলম ও আমলের গণ্ডির মধ্যে থেকে রূহের পূর্ণতা লাভের নাম হিকমাহ। এতে একদিকে ন্যায়পরায়ণতা যেমন প্রতিষ্ঠিত হয় তেমনি অন্যদিকে নফসে আকীলা এর পূর্ণাঙ্গকরণে শামিল রয়েছে। কারণ হিকমা চিন্তামূলক ও ব্যবহারিক মাকুলাভ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ইবনে সিনা আরো বলেছেন, ইলম দুই প্রকার। একটি হলো এমন ইলম যা সর্বকালে ও সর্বস্থানে এক রকম থাকে না বরং স্থান ও পাত্রভেদে যাতে পরিবর্তন দেখা যায়। আর অপর ইলম হলো যা সব যুগে সমভাবে অপরিবর্তিত অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। তিনি এ দ্বিতীয় প্রকার ইলমকে হিকমাহ বলে অভিহিত করেছেন। এর অনেক শাখা-প্রশাখার মধ্যে মানতিক বা যুক্তিবিদ্যা অন্যতম এবং এটি সব ইলমের ভিত্তি। চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান এবং অপরাপর স্বতন্ত্র ইলমসমূহ এরই শাখা-প্রশাখামাত্র।
হিদায়াতুল হিকমা গ্রন্থের সংজ্ঞা অনুসারে হিকমাহ হলো : মানবীয় শক্তি অনুসারে আয়ান মাওজুদাত বা দৃশ্যবস্তু এ ব্যাপারে যা স্থিত রয়েছে তার বিভিন্ন অবস্থার জ্ঞান। আয়ান বলতে বোঝায় এমন বস্তু বা ব্যাপার যা মানুষের দৃষ্টিগোচর, তার সাধ্য ও ইচ্ছার আওতাধীন। এ জাতীয় বস্ত্র ও ব্যাপারের জ্ঞানকে বলা হয় হিকমাহ বা ব্যবহারিক প্রজ্ঞা। অন্য প্রকার ইলমকে বলা হয়, চিন্তামূলক হিকমাহ।
লিসানুল আরব গ্রন্থকারের মতে, হিকমাহ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ ইলমের সাহায্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদির পরিচিতি লাভ করা।
হিকমাহ শব্দটি হুকুম অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তখন এর অর্থ হয় ইলম ও ফিকহ। আল্লাহ তা’আলা এ অর্থেই বলেছেন :
وَآتَيْنَهُ الْحُكْمَ صَبِيًّا
“আমি তাকে শৈশবেই হুকুম দান করেছিলাম।” [আল-কুরআন, ১৯ : ১২]
হিকমাহ এমন এক জ্ঞান যা মানুষকে মূর্খতা ও বোকামি হতে রক্ষা করে। এ শব্দটি মাওয়াইজ বা উপদেশ এবং আমছাল বা দৃষ্টান্ত অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আল-কুরআনে নবীগণকে হুকুম ও হিকমাহ দান করার কথা বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলার এমনি একটি ঘোষণা থেকে বোঝা যায়, হিকামাহ অর্থ ইলম ও বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা হক বা সত্য অনুধাবনের ক্ষমতা। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন :
وَلَقَدْ آتَيْنَا لقَمَنَ الْحِكْمَةَ
“আমি লুকমানকে হিকমা বা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছিলাম।” [আল-কুরআন, ৩১ : ১২]
হিকমাতে ইলাহীর অর্থ দৃশ্য-অদৃশ্য সব সত্তার পরিপূর্ণ জ্ঞানের মাধ্যমে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার ক্ষমতা মানুষের হিকমাতের মর্ম হলো সৃষ্টি জগতের পরিচয় লাভ করে এর কল্যাণকর ব্যবহারের মতো প্রজা। এ কারণে হিকমাহ সে সচেতনতাকেও বলা হয়ে থাকে যা অতীত জাতিসমূহের ইতিবৃত্তের আলোকে অর্জিত হয়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
وَلَقَدْ جَاءَهُمْ مِنَ الْأَنْبَاءِ مَا فِيْهِ مُزْدَجَرْه حِكْمَةُ بَالِغَةٌ فَمَا تُغْنِ النذره
“তাদের কাছে এমন খবর এসেছে যে খবরের মধ্যে সাবধান বাণী রয়েছে; এই সাবধান বাদী ছিল পরিপূর্ণ জ্ঞান। তবে এ সতর্ক বাণী তাদের কোনো উপকারে আসেনি।” – [আল-কুরআন, ৫৪: 8-5]
ইমাম রাগিবের মতে, হুকুম শব্দটি হিকমাহ হতে ব্যাপকতর। প্রত্যেক হিকমাহ হুকুম হতে পারে কিন্তু প্রত্যেক হুকুম হিকমাহ হয় না। আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা থেকে বিষয়টির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَب وَالْحِكْمَةَ
“তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেবেন।” [আল-কুরআন, ২: ১২]
يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ
“তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমাত দান করেন।” [আল-কুরআন, ২ : ২৬৯]
من ايتِ اللهِ وَالْحِكْمَةِ
“আল্লাহ তা’আলার আয়াতসমূহ ও হিকমাহ হতে।” [আল-কুরআন, ৩৩ : ৩৪] এসব আয়াতে হিকমাহ শব্দের তাৎপর্য হলো আল-কুরআনের নিগূঢ় তত্ত্বের জ্ঞান, নাসিখ বা রহিতকারী, মানসূখ বা রহিত, মুহকামাহ বা সুস্পষ্ট এবং মুতাশাবিহাত বা রহস্যপূর্ণ বিষয়সমূহের জ্ঞান।
ইমাম সুদ্দী অবশ্য উল্লিখিত আয়াতসমূহে হিকমাহ দ্বারা সুন্নাহকে বোঝানো হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
অধিকাংশ অভিধানবেত্তা ও আরবি ভাষাবিদ ইলম ও হিকমাতের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, হিকমাহ ইলমের একটি শাখা। ইলমের সঙ্গে হিকমাতের পার্থক্য মাহিয়া বা প্রকৃতিগত নয় বরং গায়া বা উদ্দেশ্যগত এবং নাওইয়্যা বা শ্রেণিগত ।
আল-কুরআনে আল্লাহ তা’আলার সিফাত হিসেবে আলীম ও হাকীম নাম দুটো একত্রে প্রায় ৩৬টি স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। এ থেকেও বোঝা যায় ইলম ও হিকমাহ অভিন্ন বিষয় নয়। বরং আলীম হলেন তিনি যিনি কোনো বস্তু বা ব্যাপারে সত্তাগত বা আসল রূপ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন। অন্যদিকে হাকীম হলের পরিপূর্ণ হিকমাতের অদ্বিতীয় অধিকারী। [মুফরাদাত]
আল্লাহ তা’আলা নিজেকে এ হিসেবে আলীম বলেছেন যে, প্রত্যেক বস্তু বা বিষয় বর্তমান ভূত-ভবিষ্যৎ রূপ সমৃদ্ধি সম্যক জ্ঞানের অধিকারী। [ তাজুল আরূস
ইলম শব্দটি তামরীয় বা প্রভেদকরণ এবং রুয়াবী বা প্রত্যক্ষকরণের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ইমাম রাযী (র.) তাফসীরে কবীরে এবং আল-আলুসী (র.) রুহুল মাআনীতে হাকীম শব্দের তাৎপর্য বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।
হিকমাহর প্রকারভেদ : হিকমাহ প্রথমে দু’প্রকার। এগুলো হলো দৃশ্যবস্তু ও বিষয়গত হিকমা এবং চিন্তামূলক হিকমা। এই দুই রকম হিকমাহ আবার তিনভাগে বিভক্ত। যেমন-
১. তাযীবুল আখলাক বা নীতিবিদ্যা।
২. তানবীরুল মানযিল বা গার্হস্থ্য বিজ্ঞান।
৩. সিয়াসাতুল মুদুন বা রাজনীতি বিজ্ঞান ।
চিন্তামূলক হিকমাকে আলাদাভাবে তিনভাগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে । যেমন-
১. আল-ইলমুল আলা বা সর্বোচ্চ জ্ঞান তথা মৌলতত্ত্বের জ্ঞান, যা অনুধাবনের জন্য বস্তু বা ব্যক্তির জড়রূপ প্রয়োজন হয় না। যেমন আল্লাহ তা’আলার ইলম। এ ইলমের নামগুলো হলো ইলমে ইলাহী, আল-ফালাসাফাতুল উলা,
২. ইলমুল আওসাত বা মাধবর্তী ইলম। যা আয়াসসাধ্য বা শিক্ষালভ্য। মানতিক বা যুক্তিবিদ্যাকে যারা হিকমাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে তারা আমলকে হিকমাতের অন্তর্ভুক্ত করেন।
৩. ইলমুল আদনা বা নিম্নবিদ্যা। এর অপর নাম পদার্থবিদ্যা।
সিদ্দীক হাসান খান আবাদুল উলুম গ্রন্থে এবং তাহানাবী কাশশাফ গ্রন্থে বিজ্ঞানের শ্রেণিবিভাগ প্রসঙ্গে হিকামী ও উলুম হিকামিয়ার উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, এক দৃষ্টিকোণ থেকে ইলম দুইভাগে বিভক্ত। হিকামী ও গায়র হিকামী। হিকামী উলুমকে উলুম হাকীকাও বলা হয়। এ কারণে যে, কালের বিবর্তনেও এর উসূল বা মূলনীতি পরিবর্তিত হয় না। হিকামী উসূলের আসল উদ্দেশ্য সে উলূমই, যথা চিন্তামূলক হিকমা। অপরটি হলো এমন ইলম যা আমলের উদ্দেশে হয়ে থাকে অর্থাৎ ব্যবহারিক আসলী হিকমাতের উলূম বা জ্ঞান-বিজ্ঞান।