হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর জীবনী
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ এক জীবন ব্যবস্থা। দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য আধ্যাত্মিকতা ও বৈষয়িকতার মধ্যে এক ইনসাফপূর্ণ, ভারসাম্যমূলক, স্বভাবসুলভ এবং প্রাকৃতিক বিধান পেশ করেছে ইসলাম। এর অনুসরণ ও অনুকরণের মধ্য দিয়েই কেবল সত্যিকার শান্তি, মুক্তি ও চিরকল্যাণের নিশ্চয়তা পাওয়া যেতে পারে। এ সত্য, শাশ্বত এবং চির সুন্দর ইসলামের সংস্পর্শে এসেই মরুচারী বেদুঈনদের জীবনে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয়েছিল। ইসলামের কল্যাণে তাঁরা আইয়ামে জাহিলিয়াতকে রূপান্তরিত করেছিলেন সোনালী যুগে। অর্ধ দুনিয়া জয় করে সাম্য, মৈত্রী, ন্যায়, সদাচার, ইনসাফ ও ভ্রাতৃত্বের এক মহান সমাজ গড়ে ইতিহাসের অমর অধ্যায় রচনা করেছিলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, নতুন নতুন বিস্ময়কর আবিষ্কারে বিশ্ববাসীকে আশা ও সুখে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলেন। নানা কারণে সোনালি এ দিনগুলো বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। অচিরেই দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার পরিবর্তে তারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। বিলাসিতা, ভোগ, আদর্শহীনতা, অনৈতিকতা, ষড়যন্ত্র, ক্ষমতা ও অর্থের লোভ তাদেরকে পতনের শেষ সীমায় উপনীত করে। হিজরি পঞ্চম শতকে এসে এ অবস্থা চরম আকার ধারণ করে।
হযরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের মাধ্যমে খিলাফতের গৌরবময় অধ্যায় সমাপ্ত হওয়ার পর ইসলাম বিরোধী রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। মুসলিম নামধারী এসব শাসকরা নিজেদেরকে খলীফা ঘোষণা করার ঔদ্ধত প্রদর্শন করে। তারা নিজেদের নামে খুতবা পড়ার বিধান চালু করে। রাজতান্ত্রিক শাসন ইসলামের নামে চালানোর অপচেষ্টাও লক্ষ্য করা যায়। তা সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির কথা চিন্তা করে আপামর মুসলিম জনতা উমাইয়া আব্বাসীয়দের রাজতান্ত্রিক শাসনই মেনে নিয়েছিলেন। হিজরি পঞ্চম শতকে এসে তাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতায় মুসলিম জাহানের মধ্যে গড়ে ওঠে অসংখ্য ছোট ছোট স্বাধীন রাষ্ট্র। এর মধ্যে একদিকে চলতে থাকে গৃহযুদ্ধ ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র অন্যদিকে বিধর্মীদের বিশেষত খ্রিস্টানদের কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন
রাজনৈতিক দিক থেকে মুসলিম জাহানে নেমে আসা এই দারুণ বিপর্যয় সাংস্কৃতিক, নৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বিপর্যয় নামিয়ে আনে। গ্রিক, ভারতীয় ও অন্যান্য অমুসলিম দর্শন নির্বিচারে আমদানি ও তার ব্যাপক চর্চার কারণে আপামর মুসলিম মানসে এর সর্বনাশা কুফল ছড়িয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষ ভ্রান্ত দর্শনের চটকদার কথা আর মনগড়া যুক্তিতে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল। তাদের চিন্তা ও বিশ্বাসে ইসলাম বিরোধী ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। ইসলামের নির্ভেজাল তৌহিদী দর্শন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলাম বিরোধী দর্শনের আগ্রাসনে, শিক্ষাবিদদের স্বার্থান্ধতা এবং শাসকদের অদূরদর্শিতা ও মূর্খতার কারণে তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে। এর ফল যেমন ছিল মারাত্মক তেমনি সুদূরপ্রসারী।
মুসলিম জাতির এমন জাতীয় দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের মধ্যে আশার আলো হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র.)। তিনি মুসলিম জাতির ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধঃপতন দূর করার জন্য বিরামহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে ইসলামী দর্শনকে মুক্ত করার জন্য আমৃত্যু সাধনা অব্যাহত রেখেছিলেন। গ্রিক, ভারতীয় এবং পারসিক বৈরাগ্যবাদের অক্টোপাস থেকে ইসলামী আধ্যাত্মিকতাকে মুক্ত করে এর স্বকীয়তা ফিরিয়ে আনার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। সাধারণভাবে তাকে ইসলামের “আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ’ বলে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়। তাঁর প্রকৃত অবদান ও ভূমিকার কথা না বলে কতিপয় মনগড়া কারামত আর অতিশয়োক্তির মাধ্যমে তাঁকে এমন মহিমান্বিত করে তোলার চেষ্টা করা হয় যা সাধারণ মানুষকে নতুন করে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। তাদের কেউ কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর কাছে প্রার্থনা করে। তার মাজার যিয়ারতের মানত করে। তার জন্ম-মৃত্যু দিনে বিশেষ দুআ, উরসের আয়োজন করে এমনকি তাঁকে ‘গাউসুল আযম’ বা সবচেয়ে বড় ত্রাণকর্তা উল্লেখ করে। অথচ হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র.) ইসলামকে দ্বিখণ্ডিত মতবাদ হিসেবে উপস্থাপন করেননি। তিনি বরং ইসলামের বাহ্যিক হুকুম আহকাম পালনের ধারাটি পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি এর আধ্যাত্মিক সাধনার প্রকৃত রূপটি তুলে ধরার জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন। নৈতিক, আধ্যাত্মিক, দার্শনিক সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
জন্ম: কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ তীরে পর্বতঘেরা জিলান নগরীতে রমযান ১, ৪৭১ হিজরিতে হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র.) জন্মগ্রহণ করেন। জন্মভূমি জিলানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেই তাঁকে জিলানী বলা হয়।
পরিচয়: তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আবূ সালিহ মুসা জঙ্গী, তাঁর মা সৈয়দা উম্মুল খায়র ফাতিমা। তাঁর মাতামহ সৈয়দ আবদুল্লাহ সজিময়ী ছিলেন একজন পরম ধার্মিক, সুযোগ্য আলিম ও সাধক ব্যক্তিত্ব। পিতার দিক দিয়ে তিনি হাসান বিন আলী (রা.)-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। আর মাতার দিক দিয়ে তাঁর সম্পর্ক ছিল হুসায়ন বিন আলী (রা.)-এর সঙ্গে। তাঁর মধ্যে তাই “হাসানী-হুসায়নী’ রক্তধারার পবিত্র সম্মিলন ঘটেছিল। চূড়ান্ত বিচারে তিনি মুহাম্মদ (স.)-এরও বংশধর ছিলেন।
ব্যতিক্রমী শৈশব: শৈশব থেকেই আবদুল কাদির জিলানী (র.) স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁর জন্ম হয়েছিল রমযান মাসের ১ তারিখে। জীবনীকারগণ উল্লেখ করেছেন, সেদিন থেকেই তিনি সাওম পালন করেছেন। বলা হয়ে থাকে, মায়ের কোলে শুনে শুনেই তিনি ১৮ পারা পর্যন্ত কুরআন মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, সাত বছর বয়স থেকেই তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় শুরু করেছিলেন।
অন্যান্য বালক-বালিকাদের মতো শিশুসুলভ চাঞ্চল্য তাঁর মধ্যে ছিল না। শৈশবেই তিনি ছিলেন অনেক বেশি শান্ত, স্থির স্বভাবের এক চিন্তাশীল বালক। খেলা, দুষ্টুমি, সময় বা শক্তির অর্থহীন অপচয় হয় এমন কোনো কাজ তিনি করেননি। এমনকি অনর্থক খেলায় মগ্ন থাকতেও তাকে দেখা যায়নি। বরং বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থেকে, পড়াশোনা করে এবং মায়ের সঙ্গে, বাবা ও অন্যান্যদের সঙ্গে থেকে নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রেই তাঁকে বেশি আগ্রহী দেখা গিয়েছে। পরবর্তীতে তিনি যে একজন বড় মাপের মানুষ হবেন- তার নিদর্শন শৈশবেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
শিক্ষাজীবন: কুরআন হিফয সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে আবদুল কাদির জিলানী (র.) শিক্ষা জীবন শুরু করেন। তাঁর কুরআন হিফয সম্পন্ন হওয়ার কিছু দিনের মধ্যে তিনি পিতৃহারা হন। পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কোনো পুরুষ না থাকায় অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে তাঁর শৈশব ও বালকবেলা কাটে। তাঁর মাতা উম্মুল খায়র ফাতিমা তাঁকে অপাত্য স্নেহে বড় করে তুলেন। কোনোভাবেই যাতে তাঁর পড়ালেখা বন্ধ হয় সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। চেষ্টায় অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই আবদুল কাদির (র.) প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর তাঁর মধ্যে আরো বেশি জানার এবং উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয় ৷
বাগদাদ যাত্রা: আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর বালকবেলায় মুসলিম জাহানে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রভূমি ছিল বাগদাদ। এ নগরীটি কেবল আব্বাসীয় শাসকদের রাজধানীই ছিল না বরং মুসলিম সভ্যতা, সংস্কৃতিরও রাজধানীতে পরিণত হয়েছিল। উচ্চশিক্ষার জন্য এ সময়ে বাগদাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জ্ঞানপিপাসু আবদুল কাদির (র.) উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য তাই বাগদাদ যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু জিলান থেকে বাগদাদ যাওয়া কোনো সহজ বিষয় ছিল না। আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার তো প্রশ্নই আসে না, কোনো প্রাচীনতম যোগাযোগও তেমন ছিল না। যাত্রা পথ ছিল দুর্গম এবং বিপদসঙ্কুল। একাকী কেউ এ পথে চলার সাহস করত না। দলবেঁধে বড় বড় কাফিলা নিয়ে এ পথ কেউ কেউ পাড়ি দিত। তাও মাঝে-মধ্যেই অনেক কাফিলা ডাকাতের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাতো। পথের এ কষ্ট এবং দুর্গমতা সম্পর্কে অবহিত থাকার পরও আবদুল কাদির (র.) তাঁর পরিকল্পনায় অটল ছিলেন। কেননা তাঁর মনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য যে তীব্র ব্যাকুলতা ও অন্তহীন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল সে তুলনায় কোনো বিপদই বিবেচনাযোগ্য ছিল না। তিনি তাঁর মায়ের কাছে বাগদাদ যাওয়ার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন।
তখন তাদের সংসারের যে অবস্থা তাতে এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়াই ছিল। স্বাভাবিক। কিন্তু আবদুল কাদির (র.)-এর মা নিজেদের দারুণ সঙ্কটেও ছেলের জ্ঞানপিপাসা নিবারণের ব্যবস্থা করলেন। অবর্ণনীয় অভাব-অনটনের চিন্তাও তাকে এ থেকে ফিরিয়ে রাখল না। বরং স্বামীর রেখে যাওয়া সর্বশেষ সম্বল ৮০টি স্বর্ণমুদ্রা তিনি জ্ঞানপিপাসু ছেলের হাতে তুলে দিলেন। বালক বেলাতেই আবদুল কাদির (র.)-এর মধ্যে যে কী অসম্ভব বিবেচনাবোধ তৈরি হয়েছিল, অন্যের অধিকার আর ন্যায়-নীতির ব্যাপারে কী নিষ্ঠা জন্ম নিয়েছিল- এ সময়ে তিনি তার প্রমাণ পেশ করলেন। ৮০টি স্বর্ণমুদ্রাও তার শিক্ষা গ্রহণের জন্য যথেষ্ট ছিল না। তা সত্ত্বেও তিনি নিলেন ৪০টি স্বর্ণমুদ্রা। বাকি মুদ্রাগুলো রেখে দিলেন স্নেহের ছোট ভাইয়ের জন্য। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলেন বাগদাদগামী কোনো কাফিলার জন্য। অবশেষে কাফিলার সন্ধানও পাওয়া গেল। পথে ডাকাতের উপদ্রবের কথা চিন্তা করে মা ক্ষুদ্র সম্বল স্বর্ণ মুদ্রাগুলো তাঁর বগলের নিচে জামার কাপড়ে সেলাই করে দিলেন। বিদায় দেয়ার আগে স্নেহময়ী মা উপদেশ দিলেন “কখনো মিথ্যা বলবে না। সব সময় আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। মায়ের কাছে উপদেশ পালনের ওয়াদা করে আবদুল কাদির (র.) বাগদাদের পথে, জ্ঞান অর্জনের নতুন সম্ভাবনার পথে, নিজেকে সমৃদ্ধ ও পরিপূর্ণ শিক্ষিত করে তোলার আলোকিত পথে যাত্রা করলেন। ডাকাতকবলিত কাফিলা এবং প্রথম হিদায়াত আবদুল কাদির (র.)-এর বাগদাদ যাত্রা পথে মায়ের উপদেশ পালন, ওয়াদা পালন আর সত্যবাদীতার এক অনুপম ঘটনা জন্ম নেয়। সঙ্গে সঙ্গে পথহারা নীতিহারা মুসলিমদেরকে সুপথে ফিরিয়ে আনার কাজে তাঁর সফল অভিষেক ঘটে।
বাগদাদমুখী কাফিলাটি দুর্গম পথ অতিক্রম করতে গিয়ে ডাকাত কবলিত হয়। ডাকাতরা কাফিলার প্রতিজন সদস্যের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে সার্চ করে। তন্ন তন্ন করে প্রত্যেকের গোপন জায়গা খুঁজে লুকানো সম্পদও লুট করে নেয়। এমনকি বালক বলে আবদুল কাদির (র.) পর্যন্ত ও রেহাই পান না। তারা তাঁকে জিজ্ঞাসা করে- তাঁর কাছে কিছু আছে কিনা।
আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর মা উপদেশ দিয়েছিলেন, তিনি যেন মিথ্যা না বলেন এবং তিনি মায়ের উপদেশ পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন। কাজেই একমাত্র সম্বল ৪০টি স্বর্ণ মুদ্রার চেয়েও নিজের ওয়াদাই বেশি দামি বিবেচিত হলো। তিনি ডাকাতদের জিজ্ঞাসার জবাবে জানালেন- তার কাছে ৪০টি স্বর্ণ মুদ্রা আছে।
ডাকাতদলের সদস্যরা বিষয়টা বিশ্বাস করল না। তারা তাঁকে তাদের সরদারের কাছে নিয়ে গেল। সরদারের জিজ্ঞাসার জবাবেও আবদুল কাদির (র.) জানালেন, তাঁর কাছে সত্যিই স্বর্ণমুদ্রা আছে। ডাকাতরা অনেক খুঁজেও স্বর্ণমুদ্রা বের করতে না পেরে তাঁকে মিথ্যাবাদী বলল। তাঁকে ছলনাকারী বলল। তখন তিনি জানালেন সত্যিই তিনি কোনো মিথ্যাচার করেননি। বরং প্রকৃতার্থেই তার কাছে ৪০টি স্বর্ণমুদ্রা আছে এবং সেগুলো তাঁর বগলের নিচে কাপড়ের সঙ্গে সিলাই করা অবস্থায় আছে। বালকের সরলতা আর সত্য বলা হয়তো ডাকাত সরদারকে বিস্মিত করল। অথবা সে বালকের বোকামি দেখে বিরক্ত হলো। তারপরও সে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, সে কেন লুকোনো স্বর্ণমুদ্রার কথা জানাল। তখন আবদুল কাদির (র.) জানালেন, মায়ের কাছে করা ওয়াদা পালন এবং সত্য বলার জন্যই তিনি এমনটা করেছেন।
তাঁর কথায় ডাকাত দলের সরদার এবং সব সদস্যদের মধ্যে এক অপূর্ণ ভাবাবেগ তৈরি হলো। তাদের মধ্যে এই চেতনা তীব্র হয়ে উঠল যে, এই ছোট্ট একটি ছেলে তার মায়ের সঙ্গে ওয়াদা পালনের জন্য কীভাবে নিশ্চিত ক্ষতি জেনেও সত্য বলে ফেললো। ক্ষতির কথা না ভেবে মায়ের উপদেশ পালনকেই কর্তব্য জ্ঞান করল। আর তারা কত খারাপ! মানুষের সম্পদ কেড়ে নেয়া, সত্য না বলা ইত্যাদি কাজ করেই তাদের জীবন কেটে যাচ্ছে। এই ভাবনা ডাকাতদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। তখনই তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এই অভিশপ্ত পাপের জীবন আর না। তারা কাফিলার লোকদের সম্পদ ফেরত দিয়ে নিজেরা আত্মশুদ্ধির সাধনায় নিমগ্ন হলো।
বাগদাদে উচ্চশিক্ষা: আবদুল কাদির জিলানী (র.) যখন বাগদাদে এলেন তখন বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। বিশ্ববিখ্যাত অনেক মুসলিম মনীষী তৈরি হয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনিও এখানে এসে ভর্তি হলেন। আত্মনিয়োগ করলেন জ্ঞান অর্জনের পবিত্র সাধনায়। এখানে তিনি তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, আরবি সাহিত্য, কালাম শাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত অধ্যয়ন করেন। তীক্ষ্ণ মেধা, গভীর প্রত্যয়, নিষ্ঠাপূর্ণ সাধনায় খুব সহসাই আবদুল কাদির (র.) নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিতে পরিণত হন।
এ সময়ে নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসভুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়েও পড়াশোনার পদ্ধতি ছিল। অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিই নিজ নিজ বিষয়ে লোকদের ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জ্ঞানদানের কাজ করতেন। নিজে যে বিষয়ে অভিজ্ঞ কোনো সম্মানী ছাড়াই সে বিষয়টি মানুষকে জানিয়ে দিতেন। আবদুল কাদির (র.) এমন উস্তাদদের কাছেও তালিম গ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষকগণের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন আবূ সানী মুহাম্মদ ইবনে হাসান আল বাকিলানী, আবূ সাঈদ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল করীম হায়বশ, আবূ গানায়িম মুহাম্মদ ইবনে আলী মামুন আল কায়সী, আবূ বকর আহমদ ইবনে আল মুজাফ্ফর, আবূ জাফর ইবনে আহমদ ইবনে আল হুসায়নী, আবূ তাহির আব্দুর রহমান ইবনে আহমদ, হিবুতুল্লাহ ইবনে আল মুবারক, আবূ নসর মুহাম্মদ আবূ ইমাম ইসমাঈল ইবনে আল মুহাম্মদ ইস্পাহানী, আবুল কাসিম আল ফারুকী, আবদুর রহমান আল কাজ্জাজ, তালহা আল আকুনী ইয়াহইয়া আওলাদ আল বান্না, কাজী আবূ সাঈদ মুবারক মাথরানী, আবদুল ওয়াকী হাম্বলী আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবনে কাজী এবং আবুল খাত্তাব মাহফুয হাম্বলী প্রমুখ ।
সমকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে শাস্ত্রীয় পণ্ডিত হিসেবে আবদুল কাদির (র.) এর এসব শিক্ষকগণ ছিলেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব। তাঁদের কাছে দীর্ঘদিন বিস্তারিত অধ্যয়ন শেষে তিনি নিজেও শাস্ত্রীয় জ্ঞানে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। অচিরেই তাঁর এ দক্ষতার কথা দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথাগত শাস্ত্রীয় জ্ঞান অর্জন শেষে আবদুল কাদির (র.) আত্মশুদ্ধি অর্জন ও আত্মিক উন্নয়নের শিক্ষা গ্রহণে করেন।
আধ্যাত্মিক ইলম চর্চা ও সাধনা: আধ্যাত্মিক ইলম অর্জনের প্রথম পর্যায়ে আবদুল কাদির জিলানী (র.) সমকালীন শ্রেষ্ঠ সাধক ও আলিম আবূ সাঈদ মুবারক ইবনে আলী ইবনে হুসায়নী মাখজুমী (র.)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। নজিরবিহীন আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর আগ্রহে আবদুল কাদির (র.) বায়আত গ্রহণের অল্প দিনের মধ্যে তরিকতের জ্ঞান অর্জন করেন। ক্রমান্বয়ে মারিফাতের জ্ঞানেও তাঁর সফল অধিষ্ঠান ঘটে এবং তিনি এ ক্ষেত্রে মাখজুমী (র.)-এর সব শিষ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। তাঁর সাধনা ও নফলতাই তাঁকে শায়খ হুসায়নী মাখজুমীর খিরকা লাভে সহযোগিতা করে ।
তবে ইলম মারিফাতের উচ্চ শিখরে আরোহণের ব্যাপারটি সহজতর কোনো বিষয়। ছিল না। এ জন্য মাখজুমী (র.)-এর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও তেমন মূল্য পেত না যদি না আবদুল কাদির (র.) নিজে অভাবনীয় দক্ষতায় নিজের সাধনার অংশটি সম্পন্ন না করতেন। ইলমে মারিফাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার জন্য তিনি কঠোর ইবাদত ও রিয়াজতে নিমগ্ন হয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ইরাকের গহীন জঙ্গলে একাদিক্রমে ২৫ বছর মুরাকাবা-মুশাহাদা ও কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনায় কাটিয়েছেন। এ সময় তিনি খাবার-পানীয় প্রায় গ্রহণই করতেন না। দিনের পর দিন কাটাতেন অনাহারে। বেশিরভাগ সময় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন গাছের ফল, পাতা প্রভৃতি ।
রিয়াযতকালে তাঁর অবস্থা এমন হতো যে, বাহ্য জ্ঞান থাকত না। কখনো আল্লাহর ইশকে চিৎকার করতেন, কখনো জঙ্গলময় ছুটোছুটি করতেন, কখনো বা অজ্ঞান হয়ে ছটফট করতেন। তাঁর ইবাদতের নজির পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি ইশার অজু দিয়ে ফজরের সালাত আদায় করেছেন! এ দীর্ঘ সময়ে ইশার পর কোনো একটি দিনও তিনি ঘুমাননি। সারারাত জেগে ইবাদত করেছেন। দীর্ঘ পনেরো বছর তিনি ইশার সালাতের পর প্রতিরাতে একবার করে কুরআন খতম করেছেন। নিষিদ্ধ দিনগুলো বাদে প্রতিদিন সাওম পালন করেছেন। এ থেকেই ইবাদতে তাঁর নিষ্ঠা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। অবশ্য এসবই জনশ্রুতি। প্রামাণ্য কোনো সূত্র থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়নি । আবদুল কাদির (র.) ইবাদত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন- ‘সূফীদের ইবাদত
আল্লাহর আযাবের ভয়ে নয়, তাঁর থেকে পুরস্কার লাভের আশায়ও নয়। বরং আল্লাহ প্রেমই তাকে ইবাদতে বাধ্য করে ও মশগুল রাখে। এভাবে তিনি নিজ ইচ্ছা-শক্তি, কর্মশক্তি ও চিন্তা শক্তিকে আল্লাহতে সমর্পণ করে তাঁরই ইচ্ছা সিন্ধিতে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন।আধ্যাত্মিক ইলম চর্চা ও সাধনা আধ্যাত্মিক ইলম অর্জনের প্রথম পর্যায়ে তিনি সমকালীন শ্রেষ্ঠ সাধক ও আলিম আবূ সাঈদ মুবারক ইবনে আলী ইবনে হুসায়নী মাখজুমী (র.)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। নজিরবিহীন আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর আগ্রহে আবদুল কাদির (র.) বায়আত গ্রহণের অল্প দিনের মধ্যে তরিকতের জ্ঞান অর্জন করেন। ক্রমান্বয়ে মারিফাতের জ্ঞানেও তাঁর সফল অধিষ্ঠান ঘটে এবং তিনি এ ক্ষেত্রে মাখজুমী (র.)-এর সব শিষ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন। তাঁর সাধনা ও নফলতাই তাঁকে শায়খ হুসায়নী মাখজুমীর খিরকা লাভে সহযোগিতা করে ।
তবে ইলম মারিফাতের উচ্চ শিখরে আরোহণের ব্যাপারটি সহজতর কোনো বিষয়। ছিল না। এ জন্য মাখজুমী (র.)-এর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দও তেমন মূল্য পেত না যদি না আবদুল কাদির (র.) নিজে অভাবনীয় দক্ষতায় নিজের সাধনার অংশটি সম্পন্ন না করতেন। ইলমে মারিফাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার জন্য তিনি কঠোর ইবাদত ও রিয়াজতে নিমগ্ন হয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ইরাকের গহীন জঙ্গলে একাদিক্রমে ২৫ বছর মুরাকাবা-মুশাহাদা ও কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনায় কাটিয়েছেন। এ সময় তিনি খাবার-পানীয় প্রায় গ্রহণই করতেন না। দিনের পর দিন কাটাতেন অনাহারে। বেশিরভাগ সময় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন গাছের ফল, পাতা প্রভৃতি ।
রিয়াযতকালে তাঁর অবস্থা এমন হতো যে, বাহ্য জ্ঞান থাকত না। কখনো আল্লাহর ইশকে চিৎকার করতেন, কখনো জঙ্গলময় ছুটোছুটি করতেন, কখনো বা অজ্ঞান হয়ে ছটফট করতেন। তাঁর ইবাদতের নজির পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। দীর্ঘ ৪০ বছর তিনি ইশার অজু দিয়ে ফজরের সালাত আদায় করেছেন! এ দীর্ঘ সময়ে ইশার পর কোনো একটি দিনও তিনি ঘুমাননি। সারারাত জেগে ইবাদত করেছেন। দীর্ঘ পনেরো বছর তিনি ইশার সালাতের পর প্রতিরাতে একবার করে কুরআন খতম করেছেন। নিষিদ্ধ দিনগুলো বাদে প্রতিদিন সাওম পালন করেছেন। এ থেকেই ইবাদতে তাঁর নিষ্ঠা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। অবশ্য এসবই জনশ্রুতি। প্রামাণ্য কোনো সূত্র থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়নি । আবদুল কাদির (র.) ইবাদত সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন- ‘সূফীদের ইবাদত
আল্লাহর আযাবের ভয়ে নয়, তাঁর থেকে পুরস্কার লাভের আশায়ও নয়। বরং আল্লাহ প্রেমই তাকে ইবাদতে বাধ্য করে ও মশগুল রাখে। এভাবে তিনি নিজ ইচ্ছা-শক্তি, কর্মশক্তি ও চিন্তা শক্তিকে আল্লাহতে সমর্পণ করে তাঁরই ইচ্ছা সিন্ধিতে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন।আবদুল কাদির (র.) তাঁর রিয়াযতকালীন সময়ে যখন জঙ্গলে একাকী সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন, তখন একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। জঙ্গল এমনিতেই নীরব, তার ওপর নিশুতি অন্ধকার রাত। ভীষণ অন্ধকার, নিরবচ্ছিন্ন নৈঃশব্দ। তার মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখা গেল। ওপর থেকে আলোর বন্যায় আলোকিত হয়ে উঠলো পুরো বনভূমি। আবদুল কাদির (র.) ধ্যানমগ্ন ছিলেন। অবস্থার হঠাৎ অস্বাভাবিক পরিবর্তনে তাঁর ধ্যান ভেঙে গেল। আলোর মধ্য থেকে ভেসে এলো একটি গুঢ়-গম্ভীর কণ্ঠ। কণ্ঠ বলল : ‘হে আবদুল কাদির। আমি আল্লাহ, তোমার কঠোর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে দীদার দিয়ে ধন্য করার জন্য আরশ থেকে নেমে এসেছি। আমি আজ তোমাকে পরম পুরস্কার দিচ্ছি যে, আজ থেকে তুমি সব বিধি-নিষেধ মুক্ত। আজ থেকে আমি তোমার জন্য সর হারামকে হালাল করে দিলাম।’
নীরব-নিস্তব্ধ বন এবং ঊর্ধ্বাকাশের আলোর বন্যা থেকে ভেসে আসা এই গম্ভীর কণ্ঠ এবং তাঁর বাণী শুনে আবদুল কাদির (র.) বিভ্রান্ত হলেন না। কেননা তিনি জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি জানতেন, ইসলামকে আল্লাহ তা’আলা পূর্ণ করেছেন মুহাম্মদ (স.)-এর মাধ্যমে। এরপরে ইসলামে আর কোনো সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধনের প্রয়োজন নেই। মুহাম্মদ (স.) শুধু সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ, রাসূল ও নবীই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন সর্বশেষ রাসূলও। তাঁর পরে আর কোনো -রাসূল আসবেন না। কাজেই তাঁর মাধ্যমে যা হারাম ঘোষিত হয়েছে কিয়ামত নবী পর্যন্ত তা বহাল থাকবে। যা হালাল ঘোষিত হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত তাতে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। নতুন করে তাঁকে এই বনভূমিতে দীদার দিয়ে হারাম হালাল তুলে নেয়ার যে কথা বলা হলো তা কোনোভাবেই আল্লাহ তা’আলার কথা হতে পারে না। এ নিশ্চয় শয়তানের ধোঁকা। শয়তানই তাঁর ঈমান লুট করার জন্য আল্লাহর নামে ধোঁকা দেয়ার এই প্রেক্ষাপট ও পরিবেশ তৈরি করেছে। কাজেই তিনি পরম করুণাময় আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ও তাঁর সর্বময় ক্ষমতা ও অসীম শক্তির কথা বর্ণনা করে তিলাওয়াত করলেন- ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহি।’
সঙ্গে সঙ্গে বনভূমি উজ্জ্বল করে রাখা আলো বিলীন হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষের আকৃতি ধরে আবদুল কাদির (র.)-এর কাছে উপস্থিত হলো শয়তান। সে বলল- ‘আবদুল কাদির। আমি এভাবে ধোঁকা দিয়ে অনেক সাধক-দরবেশকে গুমরাহ করেছি। কিন্তু তুমি আলিম। তোমার ইলমই আজ তোমাকে রক্ষা করল।’ আবদুল কাদির (র.) কিন্তু শয়তানের এই স্তুতি বাক্য ভুললেন না। তিনি আবারো পাঠ করলেন- ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহি।’ আর বললেন- ‘দূর হ’ অভিশপ্ত শয়তান। এটা হলো তোর আরো মারাত্মক একটি ধোঁকা। আমার জ্ঞানের কোনো সাধ্য নেই যে আমাকে তোর ধোঁকা থেকে রক্ষা করে। আমাকে রক্ষা করেছেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ।
অতীতে দেখা গিয়েছে, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও যে দেখা যাবে তা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এক ধরনের লোক নিজেদেরকে নিজেরাই, কামিল মুর্শিদ ঘোষণা করে। নিজেরা নিজেদেরকে আউলিআকুল শিরোমণি বা সূফী সম্রাট ইত্যকার নানা উপাধিতে ভূষিত করে। তাদের অন্ধ ভক্তরা অথবা স্বার্থান্বেষী ভক্তরা নিজেদের অপকর্মকে হালাল করা অথবা সত্যিকারার্থেই না বুঝার জন্য তাদের তথাকথিত কামিল মুর্শিদের ওপর নানা অলৌকিকতা আরোপ করে। শয়তানের ধোঁকায় আত্মবিস্মৃত হয়ে ধর্মব্যবসায়ী এবং চরম ভণ্ড পীরের কাছে নিজেদের ঈমান-আমল বিকিয়ে দেয়। কেননা এ ধরনের মুর্শিদরা ঘোষণা করে কামালিয়াত হাসিলের পর আর শরীঅত মেনে চলার দরকার নেই। সালাত, সাওম, হজ, যাকাতসহ ইসলামের সব বাহ্যিক ইবাদত ও অন্যান্য সদাচার, সামাজিক, পারিবারিক ও নৈতিক বিধি-বিধান মেনে চলা তখন ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হয়। হালাল, হারাম মেনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না। আসলে এরা আল্লাহর ওলী নয়। তারা নিঃসন্দেহে আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত শয়তানের প্রিয়ভাজন অনুসারী
যে কোনো মানুষ সে যত বড় সাধকই হোক না কেন- সে সত্যিকারের সাধক কি না তার মাপকাঠি হলেন মুহাম্মদ (স.)। কোনো মানুষের পক্ষে তাঁর চেয়ে বেশি ইবাদত করা সম্ভব না। তাঁর চেয়ে বেশি আধ্যাত্মিক সাধনা ও কামালিয়াত হাসিল করাও সম্ভব নয়। সম্ভব নয় তাঁর চেয়ে বেশি আল্লাহ তা’আলার প্রিয়ভাজন হওয়া। আজন্ম নিষ্পাপ হওয়ার পরও বিশ্বনবী মুহাম্মদ (স.) শরীআতের একটি আমলও তরক করেননি। বরং এমন অনেক কাজ বেশি বেশি করেছেন, অনুসারীদের জন্য করা কঠিন হবে বিবেচনা করে তা তাদেরকে করতে আদেশ করেননি। বিশ্বনবী, সর্বশেষ নবী ও রাসূল, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয়ভাজন এবং শরীআতের ভাষ্যকার ও ইসলামের পূর্ণতা বিধানকারী হয়েও যে কাজ মহানবী (স.) করেছেন- কেউ যদি দাবি করে তাকে বা তাদেরকে সে কাজ করা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে- তাহলে বুঝতে সে আসলে আল্লাহ ও রাসূলের দল থেকে বের হয়ে গিয়েছে। কেননা মুহাম্মদ (স.)-এর চেয়ে বেশি কামালিয়াতের দাবিদার ভণ্ড এবং অবশ্যই পথভ্রষ্ট না হয়ে পারে না । বিষয়টির ব্যাখ্যা এভাবেও করা যায় যে, ইলম মারিফাত বা ইসলামী আধ্যাত্মিকতার জ্ঞান ইসলামী শরীঅত বহির্ভূত কোনো বিষয় নয়। তা এমন বিষয়ও নয় যা শরীঅতকে অবজ্ঞা করে বা উপেক্ষা করে। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে তিন রকম বিধান দিয়েছেন পালন করার জন্য।
প্রথমত : আকাঈদ তথা বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহ, রাসূল, মালাইকা, কিতাব, আখিরাত, তাকদীর, কিয়ামত প্রভৃতির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন হলো আকীদাগত ইবাদত। এ ইবাদত ছাড়া কোনো মানুষ মুসলিম বলে গণ্য হবে না এবং সে যত ভালো কাজই করুক না কেন তা আল্লাহ তা’আলার কাছে ভালো কাজ বলে গণ্য হবে না। আল্লাহর কাছে আমল কবুলযোগ্য হওয়ার জন্য অবশ্যই আকাঈদগত ইবাদত আগে সম্পন্ন করতে হবে। ইলমে আকাঈদ বা ইলম আল কালামশাস্ত্রে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত : যাহিরী আমল তথা আনুষ্ঠানিক ইবাদত। ইসলাম মানুষকে এমন কিছু আমলের নির্দেশ দিয়েছে যা করার জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার করতে হয়। যা গোপন করা যায় না এবং গোপন করা জরুরিও নয়। বরং প্রকাশ্যে সবাইকে নিয়ে পালন করতে হয়। যেমন সালাত, সাওম, যাকাত, হজ, সুবিচার, সদাচার, ইহসান, তাবলীগ, পরোপকার, দুস্থের সেবা, মানবকল্যাণের জন্য নানা কর্মসূচি প্রভৃতি। এসব কাজ ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সম্পন্ন করতে হয়। মানুষের পার্থিব শান্তি ও কল্যাণ এবং আখিরাতের মুক্তির জন্য এ কাজের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি ।
তৃতীয়ত : বাতিনী আমল তথা অনানুষ্ঠানিক গোপন ইবাদত। শরীআতের এমন কতগুলো আমল আছে যা করার জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ লাগে না, বরং তা করতে হয়। অন্তর দিয়ে। এগুলো বাতিনী আমল। নিয়ত শুদ্ধ করা, তওবা, শোকর, তাকওয়া, তাওয়াক্কুল বাতিনী আমলের উদাহরণ। যাহিরী বা আনুষ্ঠানিক ইবাদত কবুলযোগ্য হওয়ার জন্য এ ইবাদতটি জরুরি। যাহিরী আমলকে বাদ দিলে এটি কোনো ইবাদত না। যেমন যাহিরী ইবাদত হলো সালাত আদায় করা। এর মধ্যে বাতিনী ইবাদত হলো শুধু আল্লাহর হুকুম পালনের নিয়তে সালাত আদায় নিশ্চিত করার জন্য অন্তরকে যাবতীয় রিয়া থেকে মুক্ত রাখার সাধনা করা। অন্তরকে যদি এ থেকে মুক্ত করা না যায় তাহলে সালাত কবুলযোগ্য হবে না। আবার সালাত আদায় না করে শুধু অন্তর পবিত্র করার এ কাজ অর্থহীন এবং অপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হবে। আবার ধরা যাক তওবা, শোকর, তাকওয়া, ইখলাস প্রভৃতি মানসিক কাজগুলো। যাহিরী আমলে ভুল না হলে বা যাহিরী ও মানসিক দিক থেকে আল্লাহর কাছে ভুল করার পর তীব্র অনুশোচনা ও অনুতাপ তৈরি না হলে তওবা অর্থবহ হবে না। যাহিরী ইবাদত না থাকলে বা না করলে নিষ্ঠা দেখানোর কোনো সুযোগও থাকবে না। কাজেই শুধু বাতিনী ইবাদত কেবল অর্থহীনই নয় বরং বিভ্রান্তিকরও বটে।
এ ইবাদতগুলোর কোনো একটি এককভাবে শরীঅত নয়, বরং শরীঅত হলো এ তিনের সমন্বয়। আরো সহজভাবে বললে, এ তিনটির সমষ্টিই মূলত ইসলাম । এর কোনো একটিকেও অস্বীকার করে, অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করে মুমিন হওয়া যাবে না। কাজেই আকাঈদ বাদ দিয়ে কেউ যদি যাহিরী আমল করে সে মুনাফিক। আকাঈদ অনুশীলন করে যদি কেউ যাহিরী আমল তরক করে সে ফাসিক। আর আকাঈদ ও যাহিরী আমল বাদ দিয়ে কেউ যদি বাতিনী আমলের কথা বলে সে মূর্খ এবং ভণ্ড। সুতরাং কালাম ও ফিকহ বাদ দিয়ে যারা তাসাউফ ও তরীকতের দাবিদার তারা ভণ্ড। আবদুল কাদির (র.) তাসাউফের দাবিদার পীর-ফকিরদের ১২টি দলের কথা উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে কেবল একটি দল যারা শরীআতের বিধি-বিধান মেনে চলে তাদেরকেই কেবল হক বলে আখ্যায়িত করে বাকি ১১টি দলকে ভঙ ও বাতিল বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ইমাম মালিক (র.)-এর একটি উক্তি উদ্ধৃত করা যায়। তিনি বলেছেন ‘যে ব্যক্তি কোনো ইলম যাহির অর্জন করেনি, সে ফাসিক। যে বাতিন বা তাসাউফ শিখেছে, ফিকহ শিখেনি, সে যিন্দিক বা কাফির। আর যে উভয় বিদ্যা শিক্ষা করেছে, সে মুহাক্কিক।
আবদুল কাদির জিলানী (র.) আকাঈদ, ফিকহ ও তাসাউফের ইলমের মধ্যে রাসূলের (স.) দেখানো আদর্শ অনুসরণ করেছেন। কোনোটিকে আলাদা অতিরিক্ত গুরুত্ব দেননি। আবার কোনোটিকে উপেক্ষাও করেননি। বরং মহানবী (স.) যেভাবে এ তিনটি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলামকে উপস্থাপন করেছেন তিনিও তাই করেছেন। ফলে তিনি শরীঅত ও তরীকত উভয় দিকের ইমাম হিসেবেই বরিত হয়েছিলেন। আর এ জন্যই তিনি গ্রিক ও ভারতীয় দর্শনের নাস্তিক্যবাদী অথবা বহুশ্বরবাদী প্রভাব থেকে তরীকতকে মুক্ত করে এর প্রকৃতরূপ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ইসলাম প্রচার ও প্রসার: শ্রীঅত ও মারিফাতে পূর্ণতা অর্জন করার পর আবদুল কাদির জিলানী (র.) ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথমে তিনি জনসভার আয়োজন করে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন। এসব জনসভায় তিনি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায়, আবেগপূর্ণভাবে ইসলামের জীবনদর্শন ও মূলনীতি ব্যাখ্যা করেন। সাধারণ মুসলমানরাই এসব সভার শ্রোতা ছিলেন। পরে আস্তে আস্তে অমুসলিমরা আসতে শুরু তাঁর বক্তব্য সাধারণ মুসলমানের ওপর অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে। তারা নিজেদেরকে পাপ পথ থেকে বিরত রাখার জন্য শপথ গ্রহণ করেন। অনেকেই তওবা করে নতুনভাবে ইসলামী জীবন-যাপনের ি গ্রহণ করেন। তাঁর এসব সভার বক্তৃতা শুনে প্রায় পাঁচ হাজার অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করেন। শেষেরদিকে সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে সঙ্গে আলিম, দার্শনিক, গবেষক, আবিষ্কারক, বিজ্ঞানী, আমির-উমরাহরাও তার জনসভায় আসা শুরু করে এবং তার বক্তৃতা শুনে নতুনভাবে জীবন গড়ার শপথ নিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে ফিরে যায়। আবদুল কাদির জিলানী (র.) তার বক্তৃতা শুনতে আসা বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। বরং ইসলামের নীতি অনুসারে সবার সঙ্গে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করতেন। কাউকে বেশি গুরুত্ব দিতেন না আবার কাউকে গুরুত্বহীন মনে করে দূরে সরিয়ে দিতেন না। বরং গুরুত্ব দিতেন আগ্রহ ও আন্তরিকতাকে। যে যত বেশি আগ্রহ ও আন্তরিকতা নিয়ে তাঁর কাছে আসত তিনি তাকে তত বেশি গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করতেন।
আবদুল কাদির জিলানী (র.) ইসলাম প্রচারের কাজ শুধু জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন নি। বরং নতুন করে জীবন-যাপন করার শপথ নেয়া বিভিন্ন পর্যায়ের আলিম- যারা তার শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন- তাদেরকে নিয়ে একটি মুবাল্লিগ দল গঠন করেছিলেন। এ দলটিকে বিশেষ যত্নে শরীঅত ও মারিফাতের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সব দিক থেকে তাদেরকে ইসলাম প্রচারের জন্য যোগ্য করে তুলেছেন। তারপর তাদেরকে পাঠিয়েছেন দেশ-দেশান্তরে। তাঁর মুবাল্লিগ দলের একটি উপদল সুদূর আফ্রিকার গহীন অরণ্য, মরু ও পর্বতময় এলাকায় গিয়েছিলেন। সেখানে তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। নিজেদের জীবন দিয়ে তুলে ধরেছিলেন ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য। চারিত্রিক মাধুর্যে প্রমাণ করেছিলেন, ইসলামের চেয়ে মানবতার বন্ধু আর কোনো জীবন ব্যবস্থা হতে পারে না। তাঁদের জীবন-যাপন ও চারিত্রিক মাধুর্য আদিবাসী আফ্রিকানদের মনে গভীর ভাবান্তর তৈরি করেছিল। তারা ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে জীবন ধন্য করেছিলেন। মুবাল্লিগদল গহীন অরণ্যের এই আদিবাসীদের শিক্ষা দেয়ার জন্য অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের চেষ্টায় আফ্রিকায় ইসলাম বিস্তৃত হয় বলেই সুদান, নাইজেরিয়া, চাঁদ, ক্যামেরুনের মতো দুর্গম দেশে আজো মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লক্ষ করা যায়।
আবু সাঈদ খরমীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এরপর আবূ সাঈদ খরমী (র.)-এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রয়োজনীয় বৈষয়িক শিক্ষা, ইসলামের বাহ্যিক হুকুম আহকাম বা শরীঅত শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক শিক্ষা দানেরও ব্যবস্থা রাখেন। তার চেষ্টায় শিক্ষার্থীরা আমল শুদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ত শুদ্ধ করারও প্রশিক্ষণ পেতে থাকে। তাঁর শিক্ষার্থীরা তথাকথিত মারিফাতের ইলম গ্রহণ না করে সম্পূর্ণ ইসলাম শেখে। আবদুল কাদির জিলানী (র.)ও নিজের আদর্শ বলে কোনো আদর্শ প্রচার না করে বরং মহানবী মুহাম্মদ (স.)-এর আদর্শই প্রচার করেন। কেননা তিনি জানেন, ইসলামে মুহাম্মদ (স.)-ই হলেন প্রথম এবং শেষ কথা। তাঁর বিন্দুমাত্র অবাধ্যতা বা তাঁর চেয়ে কাউকে অগ্রাধিকার দেয়া একজন মানুষের কাফির হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কাজেই আবদুল কাদির জিলানী (র.) নিজস্ব কোনো আদর্শ প্রচার করেছেন এটা যারা ভাবেন তারা অত্যন্ত গুমরাহীর মধ্যে বাস করেন। অথবা যারা বলেন, আমরা আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর আদর্শ অনুসরণ করব তারাও ভয়ানক গুমরাহীর মধ্যে বাস করেন।
আবদুল কাদির জিলানী (র.) খরমী (র.)-এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির খ্যাতি দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমেই এর ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। একটি সামান্য কুটির থেকে বাগদাদের লোকদের সহযোগিতা ও আগ্রহে প্রতিষ্ঠানটি একটি সুরম্য প্রাসাদে পরিণত হয়। এখানে আবদুল কাদির জিলানী (র.) পরম আন্ত রিকতা ও নিষ্ঠায় একদল আত্মনিবেদিত আলিম গড়ে তোলেন- যারা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হন। যাদের মধ্যে দুনিয়াকে উপেক্ষা করা বা অবজ্ঞা করার পরিবর্তে আল্লাহ তা’আলা যেমন গুরুত্ব দিতে বলেছেন তেমন গুরুত্ব দেয়ার মানসিকতা তৈরি হয় আবার আধ্যাত্মিক দিক থেকে তাযকিয়া ই নফস বা আত্মশুদ্ধি অর্জনের সাধনা অব্যাহত রাখে। তাঁর কাছে শিক্ষা নেয়া এসব আলিমও ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করে মুসলিম উম্মাহকে ভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তির কবল থেকে রক্ষা করেন।
আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর খ্যাতি, জ্ঞান গভীরতা ও আন্তরিকতার জন্য দেশ-দেশান্তর থেকে সাধারণ মানুষ তাদের বিভিন্ন রকম সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁর কাছে আসতে থাকে। তিনি কোনো রকম বিরক্তি ছাড়াই সাধ্যমত সবার কথা শোনার এবং কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তার ফায়সালা দেয়ার চেষ্টা করেন। ফলে সর্বস্তরে তার একটি বিশেষ ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। সাধারণ ও শিক্ষিত মানুষ সবাই-ই তাঁকে তাদের অত্যন্ত আপনজন এবং অভিভাবক হিসেবে মেনে চলতে থাকে।
গ্রন্থ রচনা: নিজে সভা করে লোকদের ইসলাম সম্পর্কে জানানো, মুবাল্লিগ তৈরি করে তাদেরকে দিয়ে ইসলাম প্রচার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে অবহিত করার সঙ্গে সঙ্গে আবদুল কাদির জিলানী (র.) বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ফতুহুল গায়ব, গুনিয়াতুত তালিবীন, ফতহুর রব্বানী, কাসিদা প্রভৃতি সমধিক প্রসিদ্ধ। তার এসব গ্রন্থ কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল প্রভৃতি শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে।
জীবন-যাপন: আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর চারিত্রিক মাধুর্য ইসলাম যেমন মানবীয় চরিত্রের আদেশ দেয় ঠিক তেমনই ছিল। রাসূলুল্লাহ (স.)-এর পূর্ণ অনুসারী ছিলেন তিনি। 1 ইসলামের আদর্শ অনুসারে তাই মানুষে মানুষে পার্থক্য করতেন না। দুঃখী মানুষের সেবা করতেন। সব সময় আগে সালাম দেয়ার চেষ্টা করতেন। তবে ক্ষমতাসীনদের তিনি খুব এড়িয়ে চলতেন। তাদের দেয়া কোনো উপহার গ্রহণ করতেন না। সাধারণ মানুষের উপহার গ্রহণ করতেন হাসি মুখে। আর যা পেতেন সবই গরিব-দুঃখী মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।
কারামাত: আবদুল কাদির জিলানী (র.)-এর অনেক কারামতের কথা জানা যায়। অনেক ক্ষেত্রে তা ভক্তের বর্ণনায় অতিশায়োক্তি হতে পারে, তবে ওলীগণের কারামত যেহেতু সত্য সুতরাং তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারামত নিয়ে কথা না বলে এটা বলা যায় যে, তিনি কারামতের অধিকারী ছিলেন। পাশাপাশি এ কথাটি মনে রাখতে হবে যে, বিশ্বনবী মুহাম্মদ (স.) মু’জিযার ওপর নির্ভর করে ইসলাম প্রচার করেননি। বিশ্বনবীর ঘোষণা অনুসারে তাঁর পরে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে স্বীকৃত যথাক্রমে আবূ বকর (রা.), উমর (রা.), উসমান (রা.) ও আলী (রা.) ও ইসলাম প্রচারের জন্য সর্বজনগ্রাহ্য বোধগম্য উপায়ই ব্যবহার করেছেন। কারামতের আশ্রয় গ্রহণ করেননি। তাঁদের নিষ্ঠাবান অনুসারী হিসেবে আবদুল কাদির জিলানী (র.)ও যে ইসলাম প্রচারে স্বাভাবিক পথ অবলম্বন করেছেন, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাঁর কাছ থেকে যে সব কারামত প্রকাশ পেয়েছে তা নিশ্চয় কোনো বিশেষ অবস্থা মোকাবেলার জন্য, কাউকে মোহিত বা মুগ্ধ করা বা নিজের বড়ত্ব প্রমাণ করার জন্য না ।
নসীহত ও পদ্ধতি: আবদুল কাদির জিলানী (র.) বলতেন- মুমিনের কাজ তিনটি। আল্লাহর হুকুম পালন করা, তাঁর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং তাঁর ইচ্ছার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দেয়া।’
আবদুল কাদির জিলানী (র.) আরো বলতেন- ‘প্রথমে ফরয, পরে সুন্নাত ও তারপর নফল। ফরয ছেড়ে দিয়ে সুন্নত ও নফল নিয়ে মশগুল থাকা আহাম্মকী। সুন্নাত আদায় বাকি রেখে নফল আদায়ের চেষ্টারও কোনো মূল্য নেই। ফরয ছেড়ে দিয়ে সুন্নত নফল নিয়ে থাকা বাদশাহকে পরিত্যাগ করে গোলামের খিদমতে আত্মনিয়োগ করার শামিল শুধু প্রতিমা পূজার নামই শিরক নয়, প্রবৃত্তির দাসত্ব করাও শিরকের শামিল। সব ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত ইবাদত সম্পাদনের পর তিনি তার অনুসারী সাধকদের আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য কিছু বিশেষ রীতি নির্ধারণ করে দেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতায় আবদুল কাদির জিলানী (র.) এ বিষয়গুলোকে সাধনায় সহযোগী হিসেবে প্রমাণ করেন। এগুলো হলো
১। উচ্চস্বরে আল্লাহু যিকর করা।
২। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ এর ১২ বর্ণের মধ্যে বিশ্বজাহানের সব রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর বিশেষ তালিম নেয়া, একে নিয়ে চিন্তা গবেষণা করা এবং বেশি বেশি যিকর করা।
৩। তাহাজ্জুদের সালাত নিয়মিত আদায় করা এবং এরপরে কুরআন তিলাওয়াত ও দরুদ পাঠ করা।
৪। ফজরের সালাতের পর নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও দরুদ পাঠ করা।
৫। তরীকার সাধক আশিকানদের মারিফাতি গজল শোনা। সাধারণদের জন্য এ গজল শোনা বিদআত।
ইন্তিকাল: ১১ রবিউস সানী ৬৬২ হিজরিতে হযরত আবদুল কাদির জিলানী (র.) ইন্তিকাল করেন। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১। তাঁর চার স্ত্রী ছিলেন, তাদের ঔরসে জন্ম নিয়েছিল ২৭ পুত্র ও ২২ কন্যা।
আরো জানুন:
- হজরত মুহাম্মদ (স) জীবনী
- ইমাম মুসলিম: হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনে ইমাম মুসলিম এর অবদান।
- ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী ও মুসনাদ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ
- ইমাম আবু দাউদ (র)-এর জীবনী ও তাঁর সুনান গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য।