?> আল ফারাবি - Best Information
আল ফারাবি

আল ফারাবি

আল ফারাবি

১. জীবন

আল-কিন্দির প্রতিষ্ঠিত ‘ফালাসিফা’ গোষ্ঠীর পরবর্তী শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হলেন আবু নছর মুহাম্মদ আল ফারাবি (ল্যাতিন আল-ফারাবিয়াস) (Alpharabius)। আল-ফারাবিকে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। তিনি ‘মুয়াল্লিম সানি’, দ্বিতীয় শিক্ষক বলে পরিবিদিত, প্রথম শিক্ষক হলেন অ্যারিস্টটল। তাঁর পরবর্তী প্রভাবশালী মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখ চিন্তাবিদ তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন। তিনি ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফারার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সেনাধ্যক্ষ। তিনি ফারারে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং অতি শৈশবেই সেকালের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ বাগদাদে গমন করেন। কিন্তু আরবি ভাষা না জানার জন্য তিনি সেখানকার সুধী মহলে প্রবেশের ছাড়পত্র লাভে সমর্থ হননি। ফলে তিনি আরবি ও গ্রিক ভাষা আয়ত্ত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। ভাষা আয়ত্ত হয়ে গেলে তিনি আবু বিশর মিতাহ্ ইবনে ইউনুস নামক প্রসিদ্ধ দার্শনিকের নিকট অ্যারিস্টটলের দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। কথিত আছে যে, তিনি প্রায় সত্তরটি নোটবুকে দর্শনশাস্ত্রের সারাংশ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি আবুবকর ইবনে সাররাজ নামক বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক বৈয়াকরণের নিকট আরবি ব্যাকরণ শিক্ষা করেন। তারপর তিনি বিভিন্ন পণ্ডিতদের কাছ থেকে অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের গভীর জ্ঞান লাভ করেন। তিনি সঙ্গীতশাস্ত্রেও গভীর জ্ঞান লাভ করেন। ইবনে খাল্লিকান বলেন যে, ফারাবি এত বেশি দর্শনপ্রিয় ছিলেন যে তিনি অ্যারিস্টটলের ‘ডি এনিমা’ (আত্মা) সম্পর্কীয়) গ্রন্থ ভাগটি দুইশতবার অধ্যয়ন করেন। এবং ‘ফিজিক্স’ (পদার্থবিদ্যা) বিষয়টি চল্লিশবার অধ্যয়ন করেন। তিনি কিছুকাল ইরানের হাররান নামক সেবিয়ানের ধর্ম শিক্ষা

 

কেন্দ্রে অবস্থান করেন এবং তাদের ভাষা, দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান লাভ করেন । আল-ফারাবি প্রায় চল্লিশ বছরকাল বাগদাদে অতিবাহিত করেন এবং একাগ্রমনে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের বিস্তৃত টীকা রচনা করেন এবং দর্শনশাস্ত্রে কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থও রচনা করেন। তার বাগদাদে অবস্থানের চল্লিশ বছরের মধ্যে প্রায় ছয়জন। খলিফার আবির্ভাব ঘটে এবং ঘন ঘন শাসক পরিবর্তনের ফলে আল-ফারাবি বহু অসুবিধার সম্মুখীন হন এবং বাগদাদ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই সময় জন্যভূমি তুর্কিস্তানে কিছুকাল বাস করেন স্থানীয় শাসক আলী সামানের আদেশে ‘আল-তালিম  আল-সানি’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থের উক্ত নামকরণের পশ্চাতে যে কারণ। রয়েছে তা হলো এই যে, প্রাচ্যের সুধী মহলে অ্যারিস্টটল ‘মুয়াল্লিম আউয়াল’ এবং আল-ফারাবি ‘মুয়াল্লিম সানি’ হিসেবে পরিবিদিত। অতএব আল-ফারাবি সিরিয়ার দামেস্কে গমন করেন এবং সেখানকার শাসক আকশীন ভাতারের অনুগ্রহ লাভ করেন। এবং সেখানে থেকে মিসরে গমন করেন। সেখানে কয়েক বছর অতিবাহিত করার পর তিনি আবার সিরিয়ায় ফিরে আসেন এবং আলেপ্পো শহরে বসবাস করতে থাকেন। সেখানে তিনি এতই অর্থকষ্টে পতিত হন যে, পাহারাদার হিসেবে কাজ করেন এবং রাতে বাগানের বাতির আলোতে পড়াশোনা করতে থাকেন। দামেস্কের যুবরাজ সায়েফ উদ্দৌলা তাঁর প্রতিভা ও ধীশক্তির পরিচয় পেয়ে তাকে উচ্চ রাজপদ ও আকর্ষণীয় মাসহারা প্রদান করেন। কিন্তু জ্ঞানস্পৃহ দার্শনিক তাঁর প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহ করার জন্য মাত্র চারটি করে দিরহাম প্রতিদিন গ্রহণ করতেন। এই স্বল্প আয়ে তুষ্ট থেকে মহান দার্শনিক অধ্যয়ন ও গ্রন্থ প্রণয়নে ব্যাপৃত থাকতেন। তিনি ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কে ইন্তেকাল করেন এবং উমাইয়া কবরগাহে মারিয়ার পাশে সমাহিত হন।

 

আল-ফারাবি ছিলেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। তিনি তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তিনি দর্শন, গণিত, জ্যোতিষশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, তিনি সত্তরটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তিনি দর্শন, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন, তন্মধ্যে অর্ধেকসংখ্যক গ্রন্থ বিগত দার্শনিকদের রচনার ওপর টাকা ও সমালোচনা, বাকিগুলো তার মৌলিক রচনা। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে পঁচিশখানা বা কিছু অধিকসংখ্যক গ্রন্থ অদ্যাবধি জীবিত রয়েছে। তিনি যুক্তিবিদ্যার ওপর নয়খানি টাকা রচনা করেন। যথা-

(১) দি ইসাগোগ অব পরফিরি,

(২) দি ক্যাটেগরি (আল-মাকুলাত),

(৩) ইবায়া অথবা আত তফসির,

(৪) আল-কিয়াস, ১ম খণ্ড,

(৫) আল-বুরহান,

(৬) আল-জাদল,

(৭) আল- মাঘালিত,

(৮) আল-খাতারা এবং

(৯) আশশের।

এটা ছাড়া তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে তিনি ইনট্রোডাকশন টু লজিক, অ্যারাইজমেন্ট অব লজিক, ফিজিক্স, মিটিরিয়োলজি, অন দি সোল, অন দিন পাওয়ার অব দি সোল, অন দি ইউনিটি অ্যান্ড ६ ওয়ান, অন দি ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড দি ইনটেলিজিবল, গিয়েসাতুল মাদানিয়া, অরাউয়াল আহলিল, মাদানিতুল ফাজিলাহ, জওয়া মিনুস গিয়েসাত, ইজতিমাউ মাদানিয়া, মাদানিতুল তুগাল লুব, ইহসা আল-উলুম, ফুসুসউল হিকাম, কিতাব আল- মুমিকা আল-কবীর ইত্যাদি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 

২. দর্শন

ইসেছিলেন। তাঁর লিখিত অ্যারিস্টটলের গ্রন্থসমূহের সমালোচনা ও ঢাকা রচনার বহর হাল-কিম্পির ন্যায় আল-ফারাবিও গভীরভাবে অ্যারিস্টটলের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত আমরা অনায়াসে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ  জীবনকালের এক বিরাট অংশ অ্যারিস্টটলের অধ্যয়নে এবং তার মতবাদসমূহের টাকা রচনা ও সমালোচনায় ব্যয় করেছেন। অ্যারিস্টটলের দর্শনে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। এবং সে কারণে তাকে ‘মুয়াল্লিম সানি’ বা দ্বিতীয় অ্যারিস্টটল বলা হতো। কোনো দার্শনিক এরূপ সম্মানিত উপাধিতে ভূষিত হন নি। তিনি প্লেটো ও অ্যারিস্টটলকে দর্শনশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ মনীষী বলে অভিহিত করেছেন এবং তাদের মতবাদসমূহের সঙ্গে ইসলামের শিক্ষার সমন্বয় সাধনের জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। তাঁর মতে, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের মতবাদসমূহের মধ্যে খুঁটিনাটি বিষয়ে গরমিল থাকলেও তাঁদের মতবাদসমূহ মূলত অভিন্ন কিন্তু লক্ষ করার বিষয় এই যে, আল-কিন্দির মতো তাঁদের মতবাদসমূহ। তিনিও অ্যারিস্টটলের তথাকথিত থিয়োলজিকে অ্যারিস্টটলের মূল গ্রন্থ বলে গ্রহণ করেছেন, এটা যে নব্য-প্লেটোবাদীদের প্রক্ষিপ্ত গ্রন্থ প্লাটিনাস রচিত ইনিডস (Enneads)-এর শেষ তিনটি খণ্ডেরই বিস্তৃত আলোচনা বা ব্যাখ্যা, আল-ফারাবি সে বিষয়ে কোনো ধারণাই করতে পারেননি। এতদসত্ত্বেও অ্যারিস্টটলের দর্শনে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্য ও সূক্ষ্মদর্শিতা তাঁকে অ্যারিস্টটলের সমালোচক, ভাষ্যকার ও অনুসারীদের পুরোভাগে তাঁর আসন চিহ্নিত করেছে।

 

?তাঁর মতে, দর্শন অনুশীলনের লক্ষ্য হলো আত্মার পবিত্রতা অর্জন। আত্মার বিশুদ্ধি ছাড়া দর্শন আলোচনা অসম্ভব, কেননা জীবনে শ্রেয় ও প্রেয়ের আলোচনায় দর্শনের মর্মমূলে উপনীত থেকে পক্ষপাতশূন্য, সংকীর্ণতা বর্জিত উদার মানসিকতার প্রয়োজন। সত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ ও আধ্যাত্মিক প্রীতি ব্যতিরেকে জীবনের গভীর উপলব্ধি হতে পারে না। তিনি ছিলেন সত্যের নিষ্ঠাবান সাধক, তাই তিনি সত্যের খাতিরে প্রয়োজন হলে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ বা অ্যারিস্টটলের গৃহীত মতবাদের বিপক্ষে অভিমত প্রকাশ করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষকদের জন্য কতিপয় বিধি নির্দেশ করেছেন। প্রকৃত বিজ্ঞানসমূহের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত না হলে তিনি শিক্ষার্থীকে দর্শন অধ্যয়ন করতে নিষেধ করেছেন। কারণ মানুষের মন ক্রমশ মূর্ত বিষয় থেকে অমূর্ত বিষয়ে, অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়। গণিতশাস্ত্রের বিশেষভাবে শিক্ষার্থীর মতকে মূর্ত বিষয় থেকে অমূর্ত বিষয়ে অগ্রসর থেকে সাহায্য করে। তার মনকে সূক্ষ্ম বিষয় চিন্তা করতে ও ব্যক্ত করতে দীক্ষা দান করে। অনুরূপভাবে, যুক্তিবিদ্যা ও শিক্ষার্থীর মনের প্রস্তুতিতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে, এটা সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করতে সাহায্য করে। কাজেই দর্শন অনুশীলনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে গণিতের মতো যুক্তিবিদ্যার জ্ঞান অপরিহার্য। সর্বোপরি, আল-ফারাবি দর্শন অনুশীলনের পূর্বশর্ত হিসেবে চরিত্র গঠনের ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন যে, মনকে অমূর্ত বিষয় চিন্তা করার জন্য উপযোগী করতে হলে তাকে জৈবিক প্রলোভন ও আকর্ষণের ঊর্ধ্বে উন্নীত করা একান্ত প্রয়োজন। আত্মোৎকর্ষ ছাড়া জীবনের গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করা অসম্ভব- কেবল বুদ্ধিময় সত্তায় প্রদীপ্ত হতে পারলে দর্শনের গভীর তত্ত্ব মানুষের চিন্তায় উদ্ভাসিত হতে পারে অন্য পথে নয়।

 

আল-ফারাবির মতে, দর্শন সব বিজ্ঞানের আদি-বিজ্ঞান। দার্শনিক জ্ঞান লাভ করাই মানব জীবনের পরম লক্ষ্য। তার মতে, দর্শনশাস্ত্র জীবন-জগতের প্রকৃত জ্ঞান দান করে, বস্তুর স্বরূপের সঙ্গে পরিচিত করে। দর্শন একমাত্র শাস্ত্র যা জগতের অনন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে অখণ্ড ঐক্যসূত্র স্থাপন করতে পারে। তিনি মুতাজিলা চিন্তাবিদ ও দার্শনিক, উভয়বিধ চিন্তাগোষ্ঠীকে সমালোচনা করেন। মুতাজিলা চিন্তাবিদরা নির্বিচারে সাধারণ অভিজ্ঞতার ওপর তাঁদের যুক্তিশৈলী প্রতিষ্ঠিত করেন; আর দার্শনিকরা বস্তু জগতের ব্যাখ্যা করেন। তারা বস্তুজগৎ ও অতীন্দ্রিয় জগতের সমন্বয়ে পূর্ণজগৎ, পরিদৃশ্যমান ও অপ্রকাশকে নিয়ে যে পূর্ণ সত্তা সে সম্পর্কে কোনো ধারণা প্রদান করেন না। কাজেই তাঁর মতে, যুক্তিবিন্যাস উপযুক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং আদি কারণ বের করতে হবে। এবার বিস্তারিতভাবে আল-ফারাবির দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।

 

৩. যুক্তিবিদ্যা

আল-ফারাবি ছিলেন মুসলিম যুক্তিবিদদের অগ্রপথিক এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুক্তিবিদদের অন্যতম। তাঁর মতে, শুধু বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিশ্লেষণই যুক্তিবিদ্যার লক্ষ্য নয়, পরম্ভ ব্যাকরণ ও জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা যুক্তিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। ব্যাকরণ যুক্তিবিদ্যা থেকে স্বতন্ত্র; কেননা ব্যাকরণ কোনো জাতির ভাষা সম্পর্কে আলোচনা করে; আর যুক্তিবিদ্যা ভাষার উপাদান, পদের বিশ্লেষণের মাধ্যমে যুক্তিবাক্য ও যুক্তিবিন্যাসের দিকে অগ্রসর হয়।

 

তিনি যুক্তিবিদ্যাকে দুই ভাগে ভাগ করেন। এর প্রথম অংশ প্রত্যয় ও সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করে এবং দ্বিতীয় অংশ অবধারণ, যুক্তিবিন্যাস ও প্রমাণ সম্পর্কে আলোচনা করে। প্রত্যয় (ধারণা) ও বস্তুর মধ্যে কোনো অনিবার্য সম্পর্ক নেই অর্থাৎ প্রত্যয় সত্যও নয় আবার মিথ্যাও নয়। প্রত্যয় শুধু মনেই অবস্থান করে। প্রত্যয় দুই শ্রেণির। প্রথম শ্রেণির প্রত্যয় বস্তুর প্রত্যক্ষণ থেকে জ্ঞাত হয়ে থাকে— এই শ্রেণির প্রত্যয় সরলতম মানসিক উপাদান- বস্তুর মানসিক প্রতিবেদন। দ্বিতীয় শ্রেণির প্রত্যয় মনের সহজাত ধারণা। আত্মসচেতনতার মাধ্যমে আত্মা সরাসরি এই সহজাত ধারণা সম্পর্কে অবহিত হয়ে থাকে। আমাদের প্রত্যক্ষণজাত ধারণার সঙ্গে এর কোনো সাদৃশ্য নেই, কাজেই প্রত্যক্ষণজাত ধারণা বা প্রত্যয়ের সাহায্যে সহজাত ধারণাকে ব্যাখ্যা করা চলে না।

 

প্রত্যয়ের সমন্বয়ে অবধারণ গঠিত হয়। অবধারণ সত্য ও মিথ্যা উভয়ই থেকে পারে। অবধারণের যথার্থ নির্ধারণ করতে হলে আমাদেরকে যাচাই করতে হবে যে, আলোচ্য অবধারণটি স্বতঃসিদ্ধ ও স্বতঃপ্রমাণিত যুক্তিবাক্য থেকে নিঃসৃত অনুমানের ওপর প্রতিষ্ঠিত কি-না। কাজেই যুক্তিবিদ্যার কাজ হলো স্বতঃসিদ্ধ নীতিসমূহের বিশ্লেষণ- যুক্তিবিদ্যার আরম্ভ কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ নীতি থেকে। গণিত শাস্ত্র, অধিবিদ্যা এবং নীতিশাস্ত্র ও কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ নীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করে এবং এই স্বতঃসিদ্ধ নীতিসমূহের ভিত্তিতে এদের আলোচ্য বিষয়সমূহের বিচার-বিশ্লেষণ করে থাকে। যুক্তিবিদ্যাও কতগুলো স্বীকৃত সত্যের বা স্বতঃসিদ্ধের প্রেক্ষিতে পূর্বে অজান্ত কোনো বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত অনুমান করে। কাজেই যুক্তিবিদ্যা জাত থেকে অজ্ঞাতে উত্তরণ-জানা থেকে অজানায় গমন। প্রত্যয়কে অবধারণ, অবধারণকে যুক্তিতে রূপান্ত রিত করা যুক্তিবিদ্যার কাজ। কিন্তু উচ্চতর স্তরে যুক্তিবিদ্যা সার্বিক সত্যের আলোচনায় পর্যবসিত হয় এবং সার্বিক সত্যের নীতিসমূহ নির্ধারণের প্রয়াস পায়। এই পর্যায়ে যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। যুক্তিবিদ্যার স্বতঃসিদ্ধ নীতিসমূহের মধ্যে বিরোধ নিয়মকে (Law of Contradiction) আল-ফারাবি সর্বোচ্চ নীতি বলে মনে করেন। কেননা এই নীতির মাধ্যমে কোনো যুক্তিবাক্যের সত্যতা ও অসত্যতা নির্ধারণ করা যায়, কোনো যুক্তিবাক্যের নিশ্চয়তা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। এখানে ফারাবির চিন্তার সঙ্গে হেগেলীয় চিন্তাবিদ ব্রাডলীর ধারণার সাদৃশ্য দৃষ্ট হয়।

 

আধুনিক যুক্তিবিদদের মত, আল-ফারাবি যুক্তিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্বকে অভিন্ন মনে করেন। তাঁর মতে, যুক্তিবিদ্যা শুধু চিন্তার সঙ্গতি কিংবা জ্ঞানের পদ্ধতি নয়, বরং যুক্তিবিদ্যা জ্ঞানের পূর্ণ বিশ্লেষণ- তার উৎপত্তি, স্বরূপ, বৈধতার আলোচনা। যুক্তিবিদ্যা প্রত্যয়ের ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করে, অবধারণের অন্তর্নিহিত সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। যুক্তিবিদ্যা শুধু দর্শনের পরিপূরক নয়, দর্শনের এক অপরিহার্য অঙ্গ। এটা শুধু সত্য লাভের উপায় নয়, বরং এটা সত্যের দর্পণ। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, প্রমাণতত্ত্ব (Theory of Proof) নিশ্চয়াত্মক অস্তিত্বের অনুসারী নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানে পর্যবসিত হয়।

 

আল-ফারাবি জ্ঞানকে দুভাবে বিভক্ত করেন, নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান (Necessary knowldege) এবং সম্ভাব্য জ্ঞান (Possible knowledge)। নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান বুদ্ধিমাহা ও সুস্পষ্ট, কোনোরূপ শর্তাধীন নয় । প্রজ্ঞা সরাসরি এই জ্ঞান উপলব্ধি করে থাকে। এই জ্ঞান এর বিপরীতজ্ঞানের অসম্ভাব্যতা সপ্রমাণ করে। সম্ভাব্য সত্য সরাসরি বা শর্তাধীনভাবে উপলব্ধি হয় না- নিশ্চয়াত্মক সত্যের ওপর নির্ভর করে। নিশ্চয়াত্মক ও সম্ভাব্য জ্ঞানের মধ্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে, নিশ্চয়াত্মক ও সম্ভাব্য বস্তুর মধ্যেও তেমনি পার্থক্য বর্তমান। বস্ত্র দ্বিবিধ নিশ্চয়াত্মক ও সম্ভাব্য। বস্তু হয় বহির্ভাগতে, না হয় মনোজগতে অবস্থান করে।

 

আল-ফারাবি সামান্য সত্য (Universal truth) সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন। নব্য প্লেটোবাদীদের নিকট সামান্যের গুরুত্ব অত্যধিক। কিন্তু আল-ফারাবির মতে, বিশেষ সত্যকে (particulars) শুধু বস্তু ও সংবেদনের মাধ্যমে।

 

পাওয়া যায় না, বরং চিন্তার মধ্যেও বিশেষ সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। সামান্য সত্য বিশেষ বস্তুর মধ্যে অবান্তর লক্ষণ (Accidents) হিসেবেই বিরাজ করে না, বরং মনের ধারণা হিসেবেও অবস্থান করে। মানব মন ‘বিশেষ’ থেকে ‘সামান্যের ধারণায় উপনীত হতে পারে, বিশেষ সত্যের বিচারের মাধ্যমে সার্বিক সত্যে পৌঁছতে পারে, কিন্তু মানুষের এই অবগতির আগেও সামান্য সত্য অস্তিত্বশীল। কাজেই সামান্য সত্য মনের ধারণা মাত্র নয় বরং বিশেষ সত্যের মধ্য দিয়ে সামান্য সত্য বাস্তব সত্তা লাভ করে। ‘সামান্য’ বিশেষের পূর্ব থেকে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।’ অতঃপর আল-ফারাবি সামান্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যক্ত করতে অগ্রসর হন। ডি বাওর বলেন যে, সামান্যের সত্তা আছে কি-না কিংবা অস্তিত্ব ফলত বিধেয় কি-না- এই প্রশ্ন দর্শনের ইতিহাসে অনেক ক্ষতির কারণ হয়েছে। কিন্তু আল-ফারাবি এই প্রশ্নের যথাযথ নির্ভুল জবাব দিচ্ছেন। তাঁর মতে, অস্তিত্ব ব্যাকরণসিদ্ধ অথবা নৈয়ায়িক সম্পর্ক বিশেষ, এটা বাস্তবতার প্রকার (Aategory of actuality) নয়, যা বস্তু সম্পর্কে কোনো স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির উক্তি করে। কোনো বস্তুর অস্তিত্ব বলতে সেই বস্তুকেই বুঝায় ।

 

৪. অধিবিদ্যা

যুক্তিবিদ্যার মধ্যে যে চিন্তাধারা বা প্রবণতা কাজ করেছে, আল-ফারাবির মতে, জগতের আলোচনায় সেই একই প্রবণতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আল-ফারাবির মতে, জগতের সমুদয় বস্তু দুটি স্তরে বিভক্ত সম্ভাব্য বস্তু ও নিশ্চয়াত্মক বস্তু (Possible and Necessary being)। এই স্তরের মধ্যে তৃতীয় কোনো সত্তা নেই। প্রত্যেক সম্ভাব্য বস্তু একটি কারণ নির্দেশ করে, যা থেকে সেই বস্তু উদ্ভূত হয়। এই কারণটি আবার একটি পূর্ববর্তী কারণের পরিণতি, এভাবে পশ্চাৎগতিতে চলতে চলতে আমরা আদি কারণে উপনীত হই, যে কারণে পরে আর অগ্রসর হওয়া যায় না। সুতরাং নৈয়ায়িক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, কারণ শৃঙ্খলের শেষ প্রান্তে আমরা নিশ্চয়াত্মক সত্তাকে অনুমান করতে বাধ্য হই; কেননা কার্যকারণ শৃঙ্খল অনন্ত হতে পারে না। এই সত্তা শর্তবিহীন, অনোদ্ভূত, স্বয়ংসম্পূর্ণ, অপরিবর্তনীয় ও পরিপূর্ণ। এই আদি কারণের মধ্যে চিন্তা ও বস্তুর কর্তা ও কর্মের প্রভেদ লোপ পায়। আবার এই আদি কারণ বা পরম সত্তা প্রমাণসাপেক্ষ— এটা সমুদয় প্রমাণের ভিত্তি। এটা এমন নিশ্চয়ত্মাক সত্তা যার অস্তিত্বের ওপর অপর সব অস্তিত্বশীল বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এতে সত্য ও সত্তা, চিন্তা ও বস্তু একীভূত হয়। এই সীমায়িত হবে। এটা একাধারে বহিঃস্থ ও অন্তঃস্থ (external and internal) অন্তর্ব্যাপী সয় একক এবং একমাত্র সত্তা। এটা একদিক হলে অন্যান্য শক্তির দ্বারা এই সত্তা ও অতিবর্তী (immanent and transcendent)

 

এই আদিকারণ বা পরম সত্তাকে খোদা বলি। তাঁর মধ্যে সব বস্তু বিভিন্নতা লোপ পায় এবং সব বস্তু মিশে এক হয়ে যায়। এই আদি সত্তার সংজ্ঞা প্রদান করা যায় না। তবে মানুষ সমুদয় মহৎ ও শ্রেষ্ঠ গুণ খোদাতে আ করে। এই গুণাবলির কতগুলো খোদার স্বরূপ ব্যাখ্যা করে এবং অন্য সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্ক ঘোষণা করে। এই সমস্ত গুণ রূপক অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সম্পূর্ণ যুক্তিবিন্যাসের সাহায্যে আমরা খোদাকে যথাযথভাবে জানতে প না। দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে খোদা অজ্ঞেয় হলেও অপরিহার্য খোদার ধারণ জীবন জগতের সামগ্রিক ব্যাখ্যা অসম্ভব। খোদা অজ্ঞেয়। এই কারণে যে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে- সমস্ত জ্ঞানের অতীত। আবার খোদা সবকিছুর মূলীভূত কারণ। খোদা ে সব বস্তুর মূল, কাজেই জাগতিক বস্তুর জ্ঞানের মাধ্যমে খোদাকে জাा । দেখা যাচ্ছে যে, আল-ফারাবি সর্ব খোদাবাদের (Pantheism) সমর্থক। তাঁর মতে জাগতিক বস্তুনিচয় বা ঘটনাবলির মাধ্যমে খোদাকে জানা যায়; কারণ জাগতিক বস্তুসমূহ বা ঘটনাবলি খোদার প্রকাশ। খোদা পরম সত্তা, কাজেই পরম সত্তার জ্ঞান সব জ্ঞানে সার। প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য পরম সত্তা বা খোদার জ্ঞান লাভ করা। দর্শনশাস্ত্রের লক্ষ্য এই আদি কারণ, পরম সত্তা খোদাকে জানা। যেহেতু খোদা সমস্ত বস্তুর কারণ, সুতরাং খোদাকে উপলব্ধি করতে পারলে জগতের সমুদয় বস্তু সম্পর্কে উপলব্ধি হবে। যেন নিজেকে জানবার জন্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন। কাজেই জগতের কারণ খোদার ইচ্ছা নয়- খোদার চিন্তা।

 

আল-ফারাবি শক্তি বা স্পিরিটকে ছয়টি স্তরে বিভক্ত করেছেন। খোদা থেকে সবকিছু এসে থাকে। অনাদিকাল থেকে বস্তুসমূহের আকার খোদার মানসলোকে অবস্থিত ছিল। তাঁর প্রতিবিম্ব ( His Image) হলো প্রথম সৃষ্টি শক্তি (First Created Spirit)। এই প্রথম সৃষ্টশক্তি নিত্য তাঁর কাছ থেকে আসে এবং বহিঃস্থ স্বীয় মণ্ডলসমূহকে আলোড়িত করে। এই প্রথম সৃষ্টিশক্তির পর আসে একটির পর আরেকটি করে মণ্ডলসমূহের আটটি শক্তি। এই শক্তিসমূহ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও একক এবং এগুলো স্বর্গীয় পদার্থসমূহের (Celestial bodies) সংগঠক। এই নয়টি শক্তি দ্বিতীয় স্তবের সভা (Second grade of being) এবং এই নয়টি শক্তিকে স্বর্গীয় ফেরেশতা (Celestial Angels) বলা হয়। তৃতীয় স্তরে রয়েছে প্রজ্ঞা (Reason)। এটাকে পবিত্র শক্তি (Holy Spirit) বলা হয়, এটা স্বর্গ ও মর্তের সেতুস্বরূপ। প্রজ্ঞা মানব জাতির মধ্যে সক্রিয়। চতুর্থ স্তরে রয়েছে আত্মা। প্রজ্ঞা ও আত্মা তাদের মৌলিক একত্বে বিরাজ করে না, তারা মানুষের সংখ্যার অনুপাতে বর্ধিত হয়ে থাকে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্তরে যথাক্রমে আকার ও জড়ের অবস্থান। ষষ্ঠ স্তরে গিয়েই আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের অনুক্রম সমাপ্ত হয়। খোদা  স্বর্গীয় মণ্ডলসমূহের শক্তি এবং প্রজ্ঞা হলো নির্ভেজাল শক্তি (Spirit perse) কিন্তু আত্মা আকার ও জড় অশরীরী হলেও দেহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

 

আল ফারাবির মতে, শক্তিসমূহের কল্পনা থেকেই দেহ উৎপন্ন হয়। এরও ছয়টি স্ত ও রয়েছে, যথা- ভূ-মণ্ডল, মানবীর দেহ, ইতর প্রাণীর দেহ, উদ্ভিদ, খনিজ পদার্থ ও দ্রব্য আল-ফারাবির মতে, ভাগৎ সৃষ্টি এক চিরন্তন প্রক্রিয়া। খোদা নিজেকে চিন্তা করে প্রথম শক্তি (First Spirit) সৃষ্টি করেছেন; প্রথমে শক্তির নিজের স্রষ্টার কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় শক্তি (Second Spirit) সৃষ্টি করেছেন; দ্বিতীয় শক্তি নিজের ও স্রষ্টার কথা চিন্তা করে প্রথম দেহ বা সর্বোচ্চ স্বৰ্গীয় মণ্ডল (First Body or the uppermost celestial sphere) সৃষ্টি করেছেন। এভাবে সৃষ্টি প্রক্রিয়া ক্রমগতিতে উচ্চ থেকে নিম্নস্তরে নেমে গেছে। এই সমস্ত স্তর মিলিত হয়ে এক অখণ্ড ঐক্য সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর সৃষ্টি এবং রক্ষণাবেক্ষণ এক ও অভিন্ন প্রক্রিয়া। সমগ্র জগতের মধ্যে এই ঐশী ঐক্য প্রতিফলিত হয়েছে। এই সুন্দর পরিকল্পনার মধ্যে ঐশী মহত্ত্বও অভিব্যক্তি লাভ করেছে।” জগতের নৈয়ায়িক ও নৈতিক নিয়ম অভিন্ন। তাঁর মতে, জগতের প্রত্যেক বস্তুর স্বরূপ আধ্যাত্মিক। পদার্থকে তিনি আধ্যাত্মিক দ্রব্য বলে অভিহিত করেন। এখানে লিবনিজের সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য আছে।

 

পৃথিবীর স্বর্গীয় মণ্ডলসমূহের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হলেও এদের প্রভাব জগতের সামগ্রিক পরিকল্পনায় অপরিহার্য, বিশেষ বস্তুর ক্ষেত্রে নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা তাদের পারস্পরিক প্রভাবের ফল। জগতের সবকিছুই প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন এবং প্রাকৃতিক নিয়ম আমরা অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার সাহায্যে অবহিত হয়ে থাকি। আল-ফারাবি জ্যোতিষশাস্ত্রের মতো খণ্ডন করেন এবং বলেন যে, কোনো নক্ষত্র সৌভাগ্য আনয়ন করে কিংবা কোনো নক্ষত্র দুর্ভাগ্য আনয়ন করে এরূপ মতবাদ সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। এই জগতে যা ঘটে তা অনেকখানি সম্ভাব্য এবং এই সম্ভাব্য (The contingent) সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। স্বর্গীয় মণ্ডলের প্রকৃতি ভূ-মণ্ডলের প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র এবং অপেক্ষাকৃত পূর্ণাঙ্গ। স্বৰ্গীয় মণ্ডলসমূহ নিশ্চয়াত্মক নিয়মসমূহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই স্বর্গীয় মণ্ডলসমূহ এই পৃথিবীর ওপর শুধু কল্যাণ বর্ষণ করতে পারে। স্বর্গীয় মণ্ডলসমূহ কল্যাণদীপ্ত অকল্যাণের কোনো স্পর্শ সেখানে নেই অর্থাৎ স্বর্গীয় মণ্ডলে সবকিছুই কল্যাণকর এবং পৃথিবীর যা কিছু কল্যাণকর তা স্বর্গীয় মণ্ডল থেকে গিয়ে থাকে। স্বর্গীয় মণ্ডলে অনিষ্টের কোনো অস্তিত্ব নেই। অনিষ্ট জাগতিক অসম্পূর্ণতা থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে। এটা থেকে আল- ফারাবির সিদ্ধান্ত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, গাণিতিক জ্যোতির্বিদ্যার মাধ্যমেপ্রাপ্ত জ্ঞান সাব্য, জ্যোতিষশাস্ত্রের নীতিসমূহ সন্দেহাত্মক।

 

 

৫. মানবাত্মা

আল-ফারাবির মতে, মানুষ দুটি নীতি, শক্তি বা দ্রব্যের দ্বারা গঠিত দেহ ও আত্মা (body. and soul)। দেহ বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে গঠিত, দেহের দ্বারা সীমায়িত, পরিমাপ বিভাজ্য; আর আত্মা এসব দৈহিক গুণাবলির অতীত। দেহ এই সৃষ্ট জগতের একটি ফল বা কাজ ( Product) কিন্তু আত্মা হলো অতীন্দ্রিয় জগতের শেষ স্বতন্ত্র বুদ্ধিবৃত্তির শক্তি। দেহ পরিপূর্ণতা লাভে সমর্থ নয়। এর বিভিন্ন পরিবর্তন আত্মার ক্রিয়ার ফল। আত্মা হলো উপকরণ, দেহ হলো আধার। আত্মা অবিনশ্বর অপরিবর্তনীয় এবং জড়ের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করে। আত্মার মধ্যে কোনো ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু দেহের ক্রিয়াসমূহের পূর্ণতাদানের জন্য আত্মা অবিনশ্বর অপরিবর্তনীয় এবং জড়ের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করে। আত্মার মধ্যে কোনো ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু দেহের ক্রিয়াসমূহের পূর্ণতাদানের জন্য আত্মা বিভিন্ন দৈহিক অঙ্গকে ব্যবহার করে থাকে। আত্মা দেহকে পূর্ণতা দান করে, আর মন বা শক্তি (Mind or spirit – আক্কল) আত্মাকে পরিপূর্ণতা দান করে। আল-ফারাবির মতে, আত্মার অভিব্যক্তি নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরের দিকে নিয়োজিত। কাজেই আসল মানুষ হলো শক্তি (Spirit)। আল-কিন্দির মতো আল- ফারাবিও বিশ্বাস করতেন যে, মানবাত্মা চারটি বুদ্ধিবৃত্তিতে বিভক্ত হতে পারে। যথা-

(১) সুপ্ত বা সম্ভাব্য বুদ্ধিবৃত্তি (আক্কল হায়য়ূলানি)

(২) সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি (আক্কল বিল ফিল)

(৩) অর্জিত বুদ্ধিবৃত্তি (আক্কল মুস্তাফাদ)

(৪) চালক বুদ্ধিবৃত্তি (আক্কল ফা’ল) এই বুদ্ধিবৃত্তিগুলো বিভিন্ন স্তরে সজ্জিত- নিম্নস্তর থেকে ঊর্ধ্বস্তরে প্রভাবিত।

নিম্নস্তর বৃত্তি ঊর্ধ্বস্তর বৃত্তির পাথেয়। প্রথম বৃত্তি আক্কল ‘হায়ায়ুলানি’ বা সুপ্ত বুদ্ধিবৃত্তি। এই বুদ্ধিবৃত্তি সব জীবের মধ্যেই পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে এবং এই বৃত্তির সহায়তায় মানুষ বস্তু থেকে বস্তুর গুণ পৃথক করে থাকে। দ্বিতীয় বৃত্তির নাম ‘আক্কল বিল ফিল’ বা সক্রিয় বুদ্ধিবৃত্তি। এই বৃত্তি প্রথম বুদ্ধিবৃত্তিকে সক্রিয় করে তোলে। তৃতীয় বৃত্তির নাম ‘আক্কল মুস্তাফাদ’ বা অর্জিত বুদ্ধিবৃত্তি। এটা চালক বুদ্ধিবৃত্তির অনুপ্রেরণা’য় অর্জিত ও বিকশিত হয় । মানুষ চেষ্টা দ্বারা বৃত্তি অর্জন করে থাকে। চতুর্থ বৃত্তির নাম ‘আক্কাল ফাল’ বা চালক বুদ্ধিবৃত্তি— এটা খোদা প্ৰদত্ত বৃত্তি। এই বৃত্তি খোদার কাছ থেকে মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং মানুষের ঘুমন্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলে। এই শক্তিই মানুষকে ইষ্ট ও অনিষ্ট, ভালো ও মন্দ ন্যায় ও অন্যয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশে সাহায্যে করে। মানুষের মৃত্যুর পর এই চালক বুদ্ধিবৃত্তি-এর উৎস খোদায় প্রত্যাবর্তন করে এবং তাঁর সঙ্গে পুনরায় মিলিত হয়। আল-ফারাবির আত্মা সম্পৰ্কীয় মতবাদ পর্যালোচনায় দেখতে পাই যে, মানবাত্মা অমর, তবে তাঁর দর্শনে মানবাত্মার ব্যক্তিগত অমরতা স্থান পায়নি।

মানুষ ও পশু উভয়ই সুপ্ত বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী, কিন্তু উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। মানুষের মধ্যে আছে চালক বুদ্ধিবৃত্তি যা পশুর মধ্যে নেই। এই বৃত্তি খোদা প্রদত্ত এবং খোদা থেকে মানবদেহে প্রবিষ্ট হয়ে মানুষকে কর্মের প্রেরণা দেয় এবং মানুষের অর্জিত বৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে। মৃত্যুর পর এই চালক বুদ্ধিবৃত্তি আপন উৎসে প্রত্যাবর্তন করে এবং খোদার সঙ্গে পুনরায় মিলিত হয়। আত্মার উন্মেষের সঙ্গে আমাদের সুপ্ত বুদ্ধিবৃত্তি ইন্দ্রিয়ানুভূতির সীমা অতিক্রম করে প্রজ্ঞার জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করে এবং উন্নত ধরনের জ্ঞান অর্জন করে। নিম্ন বুদ্ধিবৃত্তি ঊর্ধ্বতর জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে এবং ক্রমোন্নতির মাধ্যমে খোদার জ্ঞান লাভে সমর্থ হয়ে থাকে। কিন্তু মৃত্যুর পর দেহমুক্ত হয়ে আত্মা দেশ ও কালের সীমা অতিক্রম করে সীমাহীনভাবে বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। প্রত্যেক আত্মা স্বকীয় আলোকের সাহায্যে আলোকিত হবে এবং সমগোত্রীয় বস্তুর প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে। পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভ করবে।

 

৬. নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় মতবাদ

আল-ফারাবির নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় মতবাদ অনেকটা ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। তাঁর মতে, যুক্তিবিদ্যা যেমন জ্ঞানের নীতি সম্পর্কে আলোচনা করে, তেমনি নীতিশাস্ত্র আচরণের নীতি সম্পর্কে আলোচনা করে, যদিও নীতির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের মূল্য তিনি স্বীকার করেছেন। নীতিশাস্ত্রের আলোচনায় আল-ফারাবি কখনো প্লেটোর সঙ্গে, কখনো অ্যারিস্টটলের সঙ্গে এক মত হয়েছেন; আবার মাঝে মাঝে মিস্টিক ও গোঁড়াপন্থীদের মতো উভয় দার্শনিককে অতিক্রম করে গেছেন। ধর্মতত্ত্ববিদদের অভিমতের বিরুদ্ধে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, প্রজ্ঞাই ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে; জ্ঞানই শ্রেষ্ঠধর্ম। নৈতিক নীতিসমূহের জ্ঞানই সর্বোচ্চ জ্ঞান। যিনি নৈতিক নিয়মাবলির তাৎপর্য অবহিত হয়ে তদ্রূপ কাজ করেন, তিনি যে ব্যক্তি নৈতিক নিয়মাবলির হৃদয়ঙ্গম না করে অন্ধভাবে সেইগুলোর অনুসরণ করে সে ব্যক্তি অপেক্ষা উত্তম।

 

ইতর প্রাণীর মতো মানুষের কামনা-বাসনা আছে। আত্মার স্বরূপ হলো কামনা- বাসনা। কিন্তু একমাত্র মানুষেরই ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার ক্ষমতা রয়েছে, অন্যায় পন্থার পরিবর্তে ন্যায়পথ নির্বাচনের ক্ষমতা রয়েছে। এই নির্বাচন ক্ষমতা তার বিচার-বুদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। মানুষের বিশুদ্ধচিন্তা স্বাধীন কিন্তু এই স্বাধীনতা নির্ভর করে প্রজ্ঞার নির্ধারিত অভিপ্রায়ের ওপর। এই স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও এটা পরিশেষে ঐশী প্রজ্ঞার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু মানুষের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ, কেননা দেহ তাঁর স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক। দেহের বন্ধনমুক্ত হলে বুদ্ধিময় আত্মা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। এই ধরনের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করাই মানব জীবনের লক্ষ্য। এক্ষেত্রে মিস্টিকদের সঙ্গে ফারাবির কোনো পার্থক্য নেই, ফারাবি মরমীবাদী হয়ে উঠেছেন।

 

রাষ্ট্রনীতিতে আল-ফারাবি ছিলেন আরব জাতির মধ্যে রাষ্ট্রনীতির জনক। তাঁর সময় পর্যন্ত শুধু প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ এবং ‘দি লজ’ গ্রন্থ দুটি অনূদিত হয়ে সাধারণো প্রচলিত ছিল। তখন অ্যারিস্টটলের কোনো গ্রন্থ অনূদিত হয়নি। উপরিউক্ত দুটি গ্রন্থকে সম্বল করে আল-ফারাবি তাঁর রাষ্ট্রনীতি গবেষণা শুরু করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে আল- ফারাবির পাঁচখানি মৌলিক গ্রন্থের অস্তিত্ব অদ্যাবধি দৃষ্ট হয়, গিয়েসাতুল মাদানিয়া, ‘আরাউয়াল আহলিল’, ‘মাদানিতুল ফাজলাত’ ‘জওয়ামিনুস সয়াসাত’ এবং ‘ইজতিমাউ মাদানিয়াত”। এটা ছাড়া তিনি প্লেটোর ‘দি লজ’ গ্রন্থটিরও অনুবাদ করেন। রাজনীতির ওপর লেখা তাঁর গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘সয়াসাত’ এবং ‘আরউ’ গ্রন্থদ্বয় সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি বহু আগে সাম্রাজ্যবাদের সুস্পষ্ট বর্ণনা দান করেছেন এবং এর কুফলের ভয়াবহতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, কতগুলো জাতি অন্য জাতির ওপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব খাটাতে চায় এবং এভাবে নিজের জীবন নিরাপদ, সুখময় ও ঐশ্বর্যময় করতে চায়, যার দরুন শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে গ্রাস করার জন্য সর্বদাই উৎসুক হয়। মাদানিভূল ভূগালুলুক বা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ওপর একরকম রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রভুত্ব বিস্তার করে, যার ফলে বিজিত জাতি হীনবশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সর্বদাই অপর রাষ্ট্রগুলোকে শত্রু মনে করে এবং তার দরুন নিজে সর্বদাই যুদ্ধার্থে প্রস্তুত থাকতে বাধ্য হয়।

 

খেলাফত সম্পর্কে আল-ফারাবির অভিমত এই যে, যদি একজন সর্বগুণান্বিত। আদর্শ শাসক না মিলে এবং শাসকের আদর্শ গুণাবলি যদি একাধিক লোকের মধ্যে দৃষ্ট হয়, তবে তারা সবাই ইসলামি রাষ্ট্রের স্থপয়িতার আদর্শের অনুসরণে সম্মিলিতভাবে শাসন কাজ চালাবেন। আল-ফারাবির এই অভিমত মন্ত্রিসভা পরিচালিত শাসনব্যবস্থার সমর্থন দান করে। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় দর্শনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, যদি কোনো সময় দেখা যায় যে রাষ্ট্রে দর্শনের স্থান নেই, তাহলে শাসনকাজে অন্যান্য সুষ্ঠু বিধান থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রে আদর্শ শাসকের অভাব দেখা দিবে, সামরিক রাষ্ট্রপতি যথার্থ শাসক হতে পারবেন না এবং রাষ্ট্রের অবনতি অবশ্যম্ভাবী হবে। তখন যদি শাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করতে কোনো জ্ঞানী দার্শনিক না পাওয়া যায় তাহলে। কিছুকাল পরে সে রাষ্ট্রের পতন ঘটবে। অর্থাৎ সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা কায়েমের জন্য শাসককে সর্বোচ্চ গুণাবলির অধিকারী হতে হবে, তাকে প্রজ্ঞানিত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে কেননা শাসকের বৈচিত্র্যই রূপায়িত হয় শাসনের মধ্যে। সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার আবশ্যিক শর্ত হলো উত্তম শাসক। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক জীবনেই নৈতিকতার সম্পূর্ণ রূপায়ণ হয়ে থাকে। রাষ্ট্র শুধু মানুষের ঐহিক উন্নতিই নিয়ন্ত্রণ করে না, তার পারত্রিক উন্নতিও বিধান করে। অজ্ঞ ব্যক্তির আত্মা প্রজ্ঞাবিবর্জিত বলে মানুষের মৃত্যুর পর তা বস্তুজগৎ বা জীব জগতের সঙ্গে মিলিত হবে।

 

 

পক্ষান্তরে আলোকদীপ্ত আত্মা বিশুদ্ধ শক্তির জগতে প্রত্যাবর্তন করবে। এই জগতের সাধনা বলে আত্মা যে স্তরে উন্নীত হবে তদনুযায়ী পরজগতে তার স্থান হবে। নৈয়ায়িক দিক দিয়ে এই জগৎ স্বতন্ত্র, কিন্তু অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে এই জগৎ ও পরজগৎ অভিন্ন, কেননা খোদা এই জগতের মধ্যে অনুস্যূত হয়ে আছেন। মরমীবাদীদের ভাবের তন্ময়তায় আল-ফারাবি বলেন যে, মৃত্যুর পর মানবাত্মা বিশ্ব আত্মার সঙ্গে মিলিত হবে। এবং পরিশেষে মানবাত্মার উৎস খোদার সঙ্গে মিলিত হবে।

 

আল-ফারাবিকে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক বলা হয়ে থাকে। পরবর্তী দার্শনিকদের ওপর কারাবির প্রভাব অনস্বীকার্য। দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন শাখায় ছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। অগাধ পাণ্ডিত্য ও অপূর্ব ধীশক্তির জন্য তিনি ‘মুয়াল্লিম সানি’ উপাধীতে বিভূষিত হইয়ছিলেন। ম্যা কারাডি ভস্কের (M Carra-de-vaux) মতে, আল-ফারাবির যুক্তিবিদ্যা পাণ্ডিত্যের নৈয়ায়িক চিন্তাধারার ওপর চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিল।

 

 

৭.গুরুত্ব

আল ফারাবি ছিলেন অভিব্যক্তিবাদের একজন বলিষ্ঠ প্রবক্তা। ডারউইন ও স্পেন্সার যান্ত্রিক অভিব্যক্তিবাদের সমর্থক ছিলেন, আর আল-ফারাবি ছিলেন বুদ্ধির বিবর্তনে বিশ্বাসী। মানুষ জৈবিক অভিব্যক্তির সর্বোচ্চ স্তর বলে উদ্ভিদ ও প্রাণী সমুদয় কার্যাবলির অংশীদার। জন্ম থেকে মুত্যু পর্যন্ত মানুষ অভিব্যক্তির সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অভিব্যক্তির পথে অগ্রসর হতে থাকে। আল-ফারাবি গুণ ও অস্তিত্বের মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শন করেন, পরবর্তী প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দর্শনে এই পার্থক্যবিষয়ক মতবাদ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে। তিনি খোদার অস্তিত্ব সম্পর্কে যে বিশ্বতাত্ত্বিক যুক্তি (Cosmological Argument) প্রদান করেন, পরবর্তী শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা তা গ্রহণ করেন এবং সেন্ট টমাস একুইনাসও সে যুক্তি সমর্থন করেন। পদার্থ সম্পর্কে তিনি যে মতবাদ পোষণ করতেন (বস্তুর মধ্যেই তার বিকাশের সম্ভাবনা আছে) তা আমাদের যুগের শক্তিবাদের অত্যন্ত কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে। যে, ফারাবি যুগতিক্রমী চিন্তানায়ক ছিলেন- তাঁর পরবর্তী যুগের চিন্তাকেও তিনি প্রভাবিত করেছেন।

 

আরো জানুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *