?> ইমাম আবু দাউদ (র)-এর জীবনী ও তাঁর সুনান গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য।
ইমাম আবু দাউদ (র)-এর জীবনী ও তাঁর সুনান গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য

ইমাম আবু দাউদ (র)-এর জীবনী ও তাঁর সুনান গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য।

ইমাম আবু দাউদ (র)-এর জীবনী:

উপস্থাপনা : ইমাম আবু দাউদ (র) হাদীসের সুবিশাল পরিমণ্ডলে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি স্বীয় মহিমা ও স্বকীয়তায় সবিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। হাদীস গবেষণার ক্ষেত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের পরেই হাদীসবিশারদগণ তাঁর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকেন। ইলমে হাদীসে তাঁর অবদান চিরদিন অক্ষয় ও অম্লান হয়ে থাকবে।

ইমাম আবু দাউদ (র)-এর জীবনচরিত :

জন্ম ও বংশ পরিচয় : নাম সোলায়মান, কুনিয়াত আবু দাউদ। পিতার নাম আশয়াস। তাঁর পুরো নাম আবু দাউদ সোলায়মান ইবনুল আশয়াস ইবনে ইসহাক আল আসাদী আস সিজিস্তানী ! ইমাম আবু দাউদ ২০২ হিজরী মোতাবেক ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কান্দাহার ও চিশতের নিকটবর্তী সিজিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ঊর্ধ্বতন পুরুষ ইমরান আরব দেশের অধিবাসী এবং আসাদ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইমরান তার সমকালের সিফফীনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, এবং হযরত আলী (রা)-এর পক্ষে যুদ্ধ করে শহীদ হন ।

শিক্ষাজীবন : ইমাম আবু দাউদের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। সম্ভবত নিজ গ্রামেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। দশ বছর বয়সে তিনি নিসাপুরের এক মাদরাসায় ভর্তি হন। এখানেই তিনি প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আসলামের কাছে হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। হাদীসে উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্য তিনি মিসর, সিরিয়া, হেজায, ইরাক, খোরাসান প্রভৃতি বিখ্যাত হাদীস গবেষণা কেন্দ্রসমূহ ভ্রমণ করেন এবং তদানীন্তন সুবিখ্যাত মুহাদ্দিসগণের নিকট থেকে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। বসরা যাওয়ার পূর্বে তিনি খোরাসানে বিভিন্ন মুহাদ্দিসের নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন ।

তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণ হলেন-

  1. ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল,
  2. সমান ইবনে আবু শাইবা,
  3. কৃতাইবা ইবনে সাঈদ,
  4. ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন প্রমুখ ।

 

৩. কর্মজীবন : ইমাম আবু দাউদ শিক্ষাজীবন শেষ করে ইলমে হাদীসের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি হাদীস চর্চা, গবেষণা ও শিক্ষাদানে সারা জীবন কাটিয়ে দেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি হাদীসশাস্ত্রের অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো

১. সুনানে আবু দাউদ,
২.  মারাসীলে আবু দাউদ,
৩.  আন নাসেখ ওয়াল মানসুখ,
৪.  ফাযায়েল আনসার,
৫.  মারেফাতুল আওকাত,
৬.  কিতাবু বদউল অহী,
৭.  আর বন্দু আলাল কাদারিয়্যা,
৮.  মুসনাদে মালেক ইবনে আনাস,
৯.  আল মাসায়েল,
১০. মা তাফাররাদা বিহী আহলুল আসমার ইত্যাদি।

৪. ছাত্রবৃন্দ: গ্রন্থ রচনার সাথে সাথে তিনি শিক্ষাদানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-

  1. ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত তিরমিণী,
  2. ইমাম আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শোয়াইব আন নাসায়ী,
  3. আবু আওয়ানা,
  4. আবু বিশর আদদুলাভী,
  5. আলী ইবনে হাসান ইবনুল আবদ,
  6. আবু উসামা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল মালেক,
  7. আবু সাঈদ ইবনে আরাবী,
  8. ইবনে ওয়াসা এবং
  9. স্বীয় পুত্র আবু বকর প্রমুখ।

 

৫.চরিত্র: তিনি ছিলেন আবেদ, যাহেদ, খোদাভীরু ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ। দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের প্রতি তাঁর কোনো মোহ ছিল না। এ প্রসঙ্গে ইমাম দাসাহ উল্লেখ করেন, ইমাম আবু দাউদের জামার একটি হাতা প্রশস্ত ও একটি হাতা সংকীর্ণ ছিল। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, যে হাতাটি প্রশস্ত তার মধ্যে আমি লিখিত হাদীসগুলো রেখে দেই এবং সংকীর্ণ হাতার মধ্যে এ জাতীয় কিছু নেই।

মুসা ইবনে হারুন বলেন, ইমাম আবু দাউদ দুনিয়াতে হাদীসের খেদমত এবং আখেরাতে জান্নাত লাভের জন্য সৃষ্টি হয়েছেন। আমি তাঁর থেকে উত্তম কোনো ব্যক্তিকে দেখিনি । ইমাম হাকেম (র) বলেন, নিঃসন্দেহে ইমাম আবু দাউদ তাঁর সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। ঐতিহাসিক ইবনে তাগরিদী বলেন, তিনি ছিলেন হাদীসের হাফেয, সমালোচক ও সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত খোদাভীরু এক মহান ব্যক্তি ।

 

৬. মাযহাব: নওয়াব সিদ্দিক হাসানের মতে, ইমাম আবু দাউদ শাফেয়ী মাযহাবের ছিলেন।

আবু ইসহাক সিরাজী, আল্লামা ইবনে তাইমিয়া প্রমুখের মতে, তিনি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। কেননা তিনি তাঁর গ্রন্থে হাম্বলী মাযহাবের পক্ষে দলীল পেশ করা যায়, এমন সব হাদীসের প্রাধান্য দিয়েছেন।

অবশ্য কেউ কেউ বলেছেন, তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। তবে সঠিক কথা হলো, তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন মুজতাহিদ ছিলেন।

 

ইন্তেকাল : হাদীসশাস্ত্রের এ মহান ব্যক্তি ২৭৫ হিজরী বসরা নগরে ইন্তেকাল করেন ।

 

হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আবু দাউদ (র)-এর অবদান : হাদীসশাস্ত্রে ইমাম আবু দাউদের অবদান অপরিসীম। তিনি শিক্ষাগ্রহণ শেষে হাদীসের খেদমতে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সারা জীবন সাধনা করে তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন এবং শিক্ষাদানের মাধ্যমে বহুসংখ্যক মুহাদ্দিস গড়ে তোলেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান ‘সুনানে আবু দাউদ’, যা সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ। তিনি পাঁচ লক্ষ হাদীস হতে যাচাইবাছাই করে চার হাজার আটশত হাদীস নিয়ে এ গ্রন্থ সংকলন করেন। এর হাদীসসমূহ আহকাম সম্পর্কিত এবং অধিকাংশ মাশহুর পর্যায়ের। ফিকহশাস্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি এ গ্রন্থটি সজ্জিত করেন। ইমাম বুখারীর পরে ফিকহ সম্পর্কে তিনিই ছিলেন অধিক জ্ঞানসম্পন্ন মনীষী। মুহাদ্দিসগণ তাঁর এ হাদীস গ্রন্থকে প্রামাণ্য দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এজন্য ফিকহশাস্ত্র বিশারদগণ বলেছেন, একজন মুজতাহিদের পক্ষে ফিকহের

মাসয়ালা বের করার জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআন মাজীদের পরে সুনানে আবু দাউদই যথেষ্ট। মুহাদ্দিস যাকারিয়া (র) বলেন, ইসলামের মূলমন্ত্র হলো আল্লাহর কিতাব, আর ইসলামের প্রামাণ্য গ্রন্থ হলো সুনানে আবু দাউদ
সুনান গ্রন্থ প্রণয়নে ইমাম আবু দাউদ (র) এর অনুসৃত পদ্ধতি : এ অমর গ্রন্থ প্রণয়নে ইমাম আবু দাউদ (র) কতিপয় নিয়ম পদ্ধতির অনুসরণ করেন। নিম্নে পয়েন্ট আকারে তা উল্লেখ করা হলোঃ

১.হাদীস নির্বাচন পদ্ধতি : ইমাম আবু দাউদ (র) হাদীস নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ববর্তী মনীষীগণের অর্থাৎ ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র)-এর পদ্ধতি গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে প্রথমে রাবী নির্বাচন করেন। উসুলে হাদীসের নীতিমালা অনুযায়ী রাবীগণের সংরক্ষণ ক্ষমতা ও স্বীয় শায়খের সাথে ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাবীগণকে পাঁচভাগে ভাগ করা হয়। যথা

  • সংরক্ষণ ক্ষমতা এবং স্বীয় শায়খের সাথে ঘনিষ্ঠতাও বেশি।
  • সংরক্ষণ ক্ষমতা অত্যধিক কিন্তু স্বীয় শায়খের সাথে ঘনিষ্ঠতা কম।
  • সংরক্ষণ ক্ষমতা কম কিন্তু স্বীয় শায়খের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেশি।
  • সংরক্ষণ ক্ষমতা কম এবং স্বীয় শায়খের সাথে ঘনিষ্ঠতাও কম।
  • দুর্বল এবং অপরিচিত রাবী।

ইমাম আবু দাউদ (র) চার শ্রেণির রাবীগণের থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। চতুর্থ শ্রেণির রাবীগণের থেকে হাদীস বর্ণনা করলেও তাদের দোষত্রুটি উল্লেখ করেছেন।

২. হাদীস গ্রহণনীতি : ইমাম আবু দাউদ (র) হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজস্ব যে নীতি এবং শর্তারোপ করেছেন, তা নিম্নরূপ

  1. বুখারী ও মুসলিম (র)-এর শর্তাবলি অনুসরণ।
  2. নিজের দৃষ্টিতে । হাদীসগুলো সংকলনের শর্তারোপ ।
  3. সহীহ হাদীসের প্রধান দুটি গ্রন্থ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে যেসব হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে, সেসব সনদসূত্রে তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
  4.  প্রধান হাদীস গ্রন্থদ্বয়ে হাদীস গ্রহণের যে শর্ত অনুসৃত হয়েছে তাতে উত্তীর্ণ সকল হাদীসই গ্রহণযোগ্য।
  5. যেসব হাদীস সর্বসম্মতভাবে ও মুহাদ্দিসীনে কেরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিত্যক্ত হয়নি ও যে সবের সুনদ ‘মুত্তাসিল’ বা ধারাবাহিক বর্ণনা পরস্পর সূত্রে কোনো বর্ণনাকারীই উহা নয়, তা অবশ্যই গ্রহণীয়।
  6. চতুর্থ পর্যায়ের বর্ণনাকারীগণের মধ্যে উত্তম বর্ণনাকারী হতে বর্ণিত হাদীসও গ্রহণযোগ্য।
  7. প্রকৃত সহীহ হাদীসের সমর্থন পাওয়া গেলে ইমাম আবু দাউদ (র) এমন হাদীসও গ্রহণ করেছেন, যার বর্ণনাকারী যয়ীফ ও অজ্ঞাতনামা।

ইমাম আবু দাউদ (র) -দের নিকট প্রেরিত চিঠিতে তাঁর সুনান গ্রন্থটি প্রণয়নের মানহাজ সম্পর্কে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা হলো

১. যথা সম্ভব সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীস সংকলন।
২. দুর্বল হলেও উচ্চমানের সনদটি গ্রহণ করা।
৩. সংক্ষেপকরণের নিমিত্ত প্রতিটি বাবের অধীনে একটি বা দুটি হাদীস উল্লেখ করা।

৪. শব্দের আধিক্য না থাকলে কোনো হাদীস দ্বিরুক্ত না করা।

৫. দীর্ঘ হাদীসকে উদ্দেশ্যের আলোকে সংক্ষেপকরণ।
৬. মুত্তাসিল এবং মুসনাদ হাদীস পাওয়া না গেলে মুরসাল হাদীস উল্লেখ করা

৭. কোনো মাতরুক হাদীস বর্ণনা না করা।

৮. মারুফ হাদীস না পাওয়ার শর্তে মুনকার হাদীস বর্ণনা করা ।
৯. স্বীয় চাহিদানুযায়ী একই পদ্ধতিতে সুনান গ্রন্থটি প্রণয়ন করা।

৩. সুনানের গ্রন্থনা পদ্ধতি : সিহাহ সিত্তার অপরাপর হাদীসসমূহের ন্যায় ইমাম আবু দাউদ (র) তাঁর সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থটিকে সাধারণত ফিকহী তারতীব অনুযায়ী বিন্যাস করেন।

 

সুনানে আবু দাউদের বৈশিষ্ট্যসমূহ : সুনানে আবু দাউদ স্বীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।

নিম্নে সুনানে আবু দাউদের উল্লেখযোগ্য
বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো।
১. সুনান গ্রন্থ : সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ সুনানে আবু দাউদ। আর এ হাদীস গ্রন্থ সুনান পর্যায়ভুক্ত। এতে শরীয়তের হুকুম-আহকাম এবং ব্যবহারিক জীবনের প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি ও আদেশ-নিষেধ সংবলিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে এবং ফিকহের কিতাবের ন্যায় অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে সাজানো হয়েছে।

২. অত্যধিক যাচাই বাছাইকরণ:  ইমাম আবু দাউদ (র) পাঁচ লক্ষ হাদীস থেকে যাচাই বাছাই করে মাত্র ৪ হাজার ৮ শত সহীহ হাদীসের মাধ্যমে এ গ্রন্থ সংকলন করেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু দাউদ নিজেই বলেন

عن رسول الله صلى الله عليه وسلم خمس مائة الف حديث انتخبت منها ما معني هذا الكتاب.

অর্থাৎ, আমি রাসুলে কারীম (স)-এর পাঁচ লক্ষ হাদীস লিপিবদ্ধ করেছিলাম। তার মধ্য থেকে যাচাই বাছাই করে মনোনীত হাদীস এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছি।

৩. দলীল উপস্থাপনা : সুনানে দাউদে মাসয়ালা বর্ণনাক্ষেত্রে ইমামগণের মতামতের আলোকে পেশকৃত দলীল উপস্থাপন করা হয়েছে। ফলে তার মানগত ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবু দাউদ সম্পর্কে ফকীহগণের মন্তব্য

إنها تكفي للمجتهد بعد كتاب الله تعالى অর্থাৎ, একজন মুজতাহিদের পক্ষে ফিকহের মাসয়ালা বের করার জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআনের পরে সুনানে আবু দাউদই যথেষ্ট।

৪. সুশাসিয়াতের সন্নিবেশ : সুনানে আবু দাউদে সাহাবীর স্তর থেকে ইমাম আবু দাউদ (র) পর্যন্ত তিন রাবীবিশিষ্ট অনেক সুলাসিয়াত স্থান যা এর মর্যাদাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

৫. শিরোনাম স্থাপন : ইমাম আবু দাউদ (র) তাঁর হাদীস গ্রন্থে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহ ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে উপস্থাপন করেছেন।

৬. মন্তব্য পেশ : বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে মন্তব্য পেশ করা সুনানে আবু দাউদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো হাদীসের সনদ অথবা মতনে আপত্তিকর কিছু দেখলে ইমাম আবু দাউদ “কলা আবু দাউদ” বলে মন্তব্য পেশ করেছেন।

৭. হাদীসের সর্বজনগ্রাহ্য সংকলন: বিপুল গ্রহণযোগ্যতার কারণে সুনানে আবু দাউদ সর্বজনগ্রাহ্য সংকলনের মর্যাদা অর্জন করেছে। এ সম্পর্কে স্বয়ং ইমাম আবু দাউদ (3) ما ذكرت في كتابي حديثاً اجتمع الناس على تركه –

অর্থাৎ, জনগণ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে পরিত্যক্ত কোনো হাদীসই আমি এতে উদ্ধৃত করিনি।

৮. রেওয়ায়াতে বিশেষ শব্দের প্রাধান্য: সুনানে আবু দাউদে হাদীসসমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে হাদ্দাসানা ও আনয়ানাহ পদ্ধতিদ্বয় প্রাধান্য পেয়েছে।

৯. সিহাহ সিতার অন্যতম গ্রন্থ:  সুনানে আবু দাউদ সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ। এ প্রসঙ্গে হাফেয আবু জাফর ইবনে যোবায়ের গরনাতী বলেছেন, ফিকহ সম্পর্কিত হাদীসসমূহ সামগ্রিক ও সবিস্তারে সংকলিত হওয়ার কারণে সুনানে আবু দাউদের যে বিশেষত্ব আছে, তা সিহাহ সিত্তার অপর কোনো গ্রন্থে নেই।

১০. ইসলামের লালন-গ্রন্থ সুনানে আবু দাউদের প্রাধান্য বর্ণনা করতে গিয়ে

মুহাদ্দিস আল্লামা যাকারিয়া সাজী (র) বলেন كتاب الله عز وجل أصل الإسلام وكتاب السنين لأبي داود عهد الإسلام . অর্থাৎ, ইসলামের মূলমন্ত্র হলো পরাক্রমশালী মহানুভব আল্লাহর কিতাব, আর ইসলামের লালন-গ্রন্থ হলো সুনানে আবু দাউদ। অর্থাৎ আমি আমার এ জামে গ্রন্থে কেবল সহীহ হাদীসই সংযোজিত করেছি। এতদ্ব্যতীত জারে বহু সহীহ হাদীস আমি ছেড়ে দিয়েছি। গ্রন্থের আকার দীর্ঘ ও বিশাল হওয়ার আশঙ্কায় তা গ্রন্থে শামিল করি নি।

ইমাম মুসলিম (র)-এর অভিমত : ইমাম মুসলিম (র) বলেন, আমি আমার কিভাবে যেসব হাদীস স্থান দিয়েছি তার সবই সহীহ, কিন্তু আমি এ কথাও বলি না যে, এর বাইরে যেসব হাদীস রয়েছে তা সবই দুর্বল।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র)-এর অভিমত থেকে বুঝা যায়, অনেক সহীহ হাদীস তাঁরা সংকলন থেকে বাদ দিয়েছেন। তাছাড়া ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অনেক সহীহ হাদীস সিহাহ সিত্তার সংকলকগণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হননি। বস্তুত সিহাহ সিত্তার হাদীসসমূহ সহীহ, কিন্তু তার বাইরেও বহু হাদীস এমন রয়ে গেছে যা এসব গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হাদীসসমূহের সমপর্যায়ের সহীহ। নিম্নে এমনি বিশুদ্ধ হাদীসের কয়েকটি সংকলনের নাম প্রদত্ত হলো

১. মুয়াত্তা-ই মালেক : ইমাম মালেক (র) কর্তৃক প্রণীত মুয়াত্তা গ্রন্থটি বিশুদ্ধতম হাদীসের একটি নির্ভরযোগ্য সংকলন। মুহাদ্দিসীনে কেরাম একে বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম শাফেয়ী (র) মুয়াত্তা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন

ما على ظهر الأرض كتاب بعد كتاب الله أصح من كتاب مالك . অর্থাৎ, আল্লাহর কিতাবের পর ইমাম মালেক (র) কর্তৃক সংকলিত হাদীসের কিতাব অপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ গ্রন্থ দুনিয়ার বুকে আর একটিও নেই।

২. সুনানে দারেমী : ইমাম দারেমী (র) প্রণীত সুনানে দারেমী অন্যতম হাদীস গ্রন্থ, যাতে সহীহ হাদীসসমূহ সংকলিত হয়েছে। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র)-এর মতে, এটা সিহাহ সিত্তার সমপর্যায়ের না হলেও বিশুদ্ধ হাদীসের একটা সংকলন ।

৩. আল মুস্তাদরাক : ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র)-এর গ্রন্থ সংকলনের পর অবশিষ্ট সহীহ হাদীসসহ সংগ্রহ ও তার ভিত্তিতে প্রণীত গ্রন্থ হলো ইমাম হাকেম নিসাপুরীর আল মুস্তাদরাক। ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) তাঁদের গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় যেসব বিশুদ্ধ হাদীস ত্যাগ করেছিলেন, ইমাম হাকেম সেসব সহীহ হাদীস অনুসন্ধান করে তুলাদণ্ডে ওযন করে আল মুস্তাদরাকে গ্রন্থিত করেন।

৪. আল ইলযামাত ও কিতাবুস সুনান ইমাম দারে কুতনী (র) প্রণীত এ গ্রন্থদ্বয় বিশুদ্ধ হাদীসের সংকলন। তিনি কঠোর শর্তের আলোকে যাচাই বাছাই করে এ গ্রন্থদ্বয় সংকলন করেন

৫. সহীহ ইবনে হিব্বান : ইমাম আহমদ ইবনে হিব্বান (র) প্রণীত হাদীস সংকলনের নাম সহীহ ইবনে হিব্বান। এ গ্রন্থটিতে বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ সংকলিত ও গ্রন্থিত হয়েছে। সহীহাইনের পর এ গ্রন্থটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
৬. আল মুখতারাহ: ইমাম জিয়াউদ্দীন মাকসেদী সংকলিত অত্র গ্রন্থটি বিশুদ্ধ হাদীসের একটি সংকলন। এ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসসমূহ সহীহ হিসেবে স্বীকৃত ।
৭. আল মুস্তাকা : কয়েকজন বিখ্যাত মুহাদ্দিসের সম্মিলিত প্রয়াসে সংকলিত সহীহ আল মুস্তাকা বিশুদ্ধ হাদীস সংকলন হিসেবে স্বীকৃত। এসব মুহাদ্দিসের মধ্যে কাসেম ইবনে আসবাগ, ইবনুস সাকান, ইবনুল জারুদ, আবদুল্লাহ ইবনে আলী (র) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আল মুস্তাকা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হাদীসসমূহ বিশুদ্ধতা ও প্রামাণ্যে সর্বশীর্ষে।

৮. সহীহ আবু আনওয়াহ এ গ্রন্থটির সংকলক হলেন ইমাম ইয়াকুব ইবনে ইসহাক (র)। তাঁর সংকলিত অত্র গ্রন্থটি সহীহ হিসেবে প্রমাণিত।
৯. সহীহ ইবনে খোযায়মা : সহীহ ইবনে খোযায়মা বিশুদ্ধ হাদীসের অন্যতম সংকলন হিসেবে স্বীকৃত।
১০. আল মুজাম শিততাবারানী : ইমাম তাবারানী (র) কর্তৃক সংকলিত আল মুজাম গ্রন্থত্রয় বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ হিসেবে প্রমাণিত। তাঁর গ্রন্থত্রয়ের নাম হলো

المعجم الأوسط . و المعجم الصغير .. المعجم الكبير .د

১১. মুসনাদ-ই আহমদ (র) : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সংকলিত হাদীস মুসনাদে আহমদ গ্রন্থের নাম হিজরী তৃতীয় শতকের প্রথমভাগে একে বলা হতো হাদীসশাস্ত্রের বিশ্বকোষ ।

 

উপসংহার : সিহাহ সিত্তার প্রায় সবকটি হাদীসের বিশুদ্ধতা সকল মুহাদ্দিসের ঐকমত্যে প্রমাণিত, কিন্তু এসব গ্রন্থে অনেক বিশুদ্ধ হাদীস স্থান পায়নি সংশ্লিষ্ট গ্রন্থকারের নিজস্ব শর্ত, যথাযথভাবে না পৌঁছা, কলেবর বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে। তাঁদের কর্তৃক সংগ্রহ ও সংকলন না করা সেসব বিশুদ্ধ হাদীস অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। সুতরাং বিশুদ্ধ হাদীসের ব্যাপারে সিহাহ সিত্তার তালিকা বহির্ভূত এসব গ্রন্থও ইলমে হাদীসের পরিপূরক বিশুদ্ধ গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *