?> পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা: ধনতান্ত্রিক/পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা কী? এর উৎপত্তি

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা: ধনতান্ত্রিক/পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা কী,এর উৎপত্তি ও বৈশিষ্ট্য

     ধনতান্ত্রিক/পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা (Capitalism/Capitalistic Economy)কী,এর উৎপত্তি বৈশিষ্ট্যসমূহ

 ধনতান্ত্রিক/পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা (Capitalism/Capitalistic Economy) (১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লাবের মধ্য দিয়ে সমগ্র ইউরোপে ধনতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হয়। বর্তমান বিশ্বে বিশুদ্ধ ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা নেই। ১৯৩০ সালের মহামন্দার পূর্ব পর্যন্ত ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাকেই সকল অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার মনে করা হতো। কিন্তু ১৯৩৬ সালে J.M. Keynes-এর The General Theory of Employment, Interest and Money গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার অসারতা প্রমাণ হয়। তবে বর্তমানে পুনরায় ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাকে মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

 

যে অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি সম্পদের মালিকানা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র (Laissez faire) বিদ্যমান থাকে তাকে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বলা হয়) ভি, আই লেনিন বলেন, “ধনতন্ত্র হলো উৎপাদনের উন্নত স্তর যেখানে শুধু মানব শ্রমের উৎপাদন নয়, বরং মানব শ্রমশক্তি নিজেই পণ্যে পরিণত হয়।”

 

ধনতন্ত্র হলো এমন একটি অর্থব্যবস্থা যে অর্থব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তি উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। ব্যক্তি স্বাধীনভাবে উপকরণ বিক্রি করে এবং তার আয় দিয়ে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে। এজন্য এ ব্যবস্থাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ব্যবস্থাও বলা হয়। এ ব্যবস্থাতে বাজার প্রক্রিয়া (market mechanism) বা মূল্য ব্যবস্থার মাধ্যমে (price mechanism) অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা হয়। বিভিন্ন পণ্য ও উপকরণের বাজার পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে গঠন করে বাজার প্রক্রিয়া। তেমনিভাবে বিভিন্ন পণ্য ও উপকরণের মূল্য পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে গঠিত হয় মূল্যব্যবস্থা। সুতরাং যে অর্থব্যবস্থায় সকল উপকরণের ব্যক্তি মালিকানা বিদ্যমান এবং সরকারি হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে দাম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকল অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় তাকে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বলে। আবার এ ধরনের অর্থনীতিকে মুক্ত বাজার অর্থনীতিও (open/free market economy) বলা হয়।

 

ধনতন্ত্র বিকাশের জন্য চারটি শর্তের প্রয়োজন হয়। যথা- (১) উৎপাদিত পণ্যের বাজার (২) পণ্য উৎপাদনের জন্য উন্নত যন্ত্রপাতি (৩) শ্রমশক্তি বিক্রয়ে বাধ্য শ্রমিকগণ (৪) কিছু সংখ্য লোকের হাতে প্রচুর অর্থ।

 

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা এর বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics of Capitalistic Economy)

১. ব্যক্তি উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে আত্মনিয়োগ করে। ফলে ব্যক্তি নিজ বিবেচনায় কী, কোথায়, কীভাবে উৎপাদন করা হবে, তা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। একারণে এরূপ ব্যবস্থাকে স্বাধীন উদ্যোগের অর্থনীতি বলা হয়।

২. পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তে ভোক্তাই রাজা (consumer is the king)। ভোক্তা যে দ্রব্যের জন্য বেশি মূল্য দিতে রাজি সে দ্রব্যের অধিক মুনাফা লাভের আশায় উৎপাদনকারীরা বেশি উৎপাদন করে। কী কী দ্রব্য কতটুকু উৎপাদিত হবে তা দ্রব্য বাজারে চলমান মূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।

৩.ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ স্বার্থ সংরক্ষণে সদা তৎপর থাকে। ব্যক্তি তার আয় ও পণ্যের দাম দেওয়া সাপেক্ষে সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি সর্বোচ্চকরণের চেষ্টা করে। অন্যদিকে, উৎপাদনকারী বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সর্বাধিক মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে।

৪. ব্যক্তিস্বার্থ ও পছন্দের স্বাধীনতা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাবের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং পণ্য ও সেবার লেনদেনে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়।

৫. পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তে উৎপাদনের উপকরণসমূহ অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের সম্পদের মালিকানা থাকে ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে। তবে এ মালিকানা অসীম নয় বরং কতিপয় বিধি বিধানের আলোকে ব্যক্তিগত মালিকানা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তে স্বীকৃত।

৬. উৎপাদিত পণ্যকে কতটুকু ভোগ করবে সেটাও মূল্য ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

৭. ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় পুঁজির কেন্দ্রীভূতকরণের মাধ্যমে উন্নত ও বৃহৎ আকারের যন্ত্রচালিত শিল্প কারখানার বিকাশ ঘটে। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সম্প্রসারণের ফলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটে।

৮. Karl Marx তার ‘Das Capital’ গ্রন্থে উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্বে (theory of surplus value) প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, কীভাবে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণির সৃষ্টি হয়। উদ্বৃত্ত মূল্য পুঞ্জীভূতের ফলে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তে শ্রমিক ভিখারিতে পরিণত হয়।

৯. পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তে আয় ও সম্পদের অসমতা দেখা দেয়। উদ্বৃত্ত মূল্য বা মুনাফার মালিক পুঁজিপতি হওয়ার কারণে সমাজে পুঁজিপতি বা বিত্তবান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আয়ের অসম বণ্টন প্রকট থেকে প্রকটতর হতে থাকে।

 ১০. উৎপাদন কৌশলের পরিবর্তন, পুঁজিপতিদের মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা এবং বৃহৎ আকারের উৎপাদন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ফলে ব্যাপক শ্রম বিভাগ সৃষ্টি হয়।

১১. পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো স্বয়ংক্রিয় দাম ব্যবস্থা। প্রতিটি পণ্য, সেবা ও উপকরণের দাম তাদের স্ব-স্ব চাহিদা ও যোগানের পারস্পরিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে পারস্পরিক দরকষাকষির মাধ্যমে প্রতিটি পণ্য ও সেবার দাম নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ থাকে না।

  চিত্রে ভূমি অক্ষে দ্রব্যের পরিমাণ এবং লম্ব অক্ষে দাম নির্দেশিত। DD = চাহিদা, SS যোগান পরস্পর E বিন্দুতে ছেদ করায় ভারসাম্য দাম OP এবং ভারসাম্য পরিমাণ OQ নির্দেশ করে।

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তে
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তে

 

১২. সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা এবং মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন পরিচালিত হওয়ায় সমাজে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির উদ্ভব ঘটে।

১৩. বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা তে শ্রমিকের মজুরির উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করা হয় এবং শ্রমিকদেরকে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ করাতে বাধ্য করে। ফলে শ্রমিক শোষিত হয়।

১৪. ধনী আরও ধনী এবং গরিব আরও গরিব হওয়ায় এবং মালিক শ্রেণি ন্যূনতম মজুরি প্রদানের ফলে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *