?> মুশারাকা পরিচিতি ও মুশারাকা বিনিয়োগ পদ্ধতি - Best Information
মুশারাকা বিনিয়োগ পদ্ধতি

মুশারাকা পরিচিতি ও মুশারাকা বিনিয়োগ পদ্ধতি

মুশারাকা বিনিয়োগ পদ্ধতি (Investment System of Musharaka)

মুশারাকা বা শিরকাত ইসলামী ব্যাংকের একটি স্থায়ী ও সর্বজনস্বীকৃত অনুমোদিত বিনিয়োগ পদ্ধতি। মুশারাকা হচ্ছে এমন অংশীদারি কারবার যেখানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাভ করার উদ্দেশ্যে পুঁজি যোগান দেয়, কারবার ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করে এবং কারবারের লাভ-ক্ষতিতে অংশ নেয়। কারবারে লাভ হলে। অংশীদারগণ পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে তা ভাগ করে নেয়; আর লোকসান হলে অংশীদারগণ নিজ নিজ পুঁজির আনুপাতিক হারে তা বহন করেন।

মুশারাকা পরিচিতি(Introduction of Musharaka)

মুশারাকা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ শরীক বা অংশীদার হওয়া। মুশারাকা পরিভাষাটি আরবি শব্দ শিরকাত বা শরীকাত মূল শিরক থেকে উদ্‌গত হয়েছে। শিরকাত/শরীকাত/শিরক মানে অংশীদারিত্ব, শরিক হওয়া, শরিক করা বা অংশীদার হওয়া। অংশীদারিত্ব বুঝাতে আরবি ভাষায় শিরক ও শিরকাত দু’টি শব্দরূপ ব্যবহৃত হয়। তাই ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে শিরকাত মানে অংশীদারিত্ব। সমসাময়িক অর্থনীতিবিদগণ ও ব্যাংকারদের মধ্যে মুশারাকা শব্দটি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে শিরকাত শব্দটির তুলনায় মুশারাকা শব্দটির অর্থ সীমিত।

মুশারাকা মূলত একটি অংশীদারি কারবার। ‘মুশারাকা’ বলতে এমন একটি অংশীদারি কারবারকে বুঝায় যেখানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একত্রিত হয়ে লাভের উদ্দেশ্যে কারবার পরিচালনা করে এবং কারবারের লাভ-ক্ষতিতে অংশগ্রহণ করে। এ কারবারে সব অংশীদারের কম-বেশি পুঁজি থাকবে। পুঁজি কম, বেশি বা সমান হতে পারে। কারবারে লাভ হলে অংশীদারগণ পূর্বনির্ধারিত হারে তা ভাগ করে নেয় এবং লোকসান হলে নিজ নিজ পুঁজি অনুসারে তা বহন করে।

পারিভাষিক সংজ্ঞা ইসলামী শরী’আহ্ ও ফকিহদের দৃষ্টিকোণ থেকে মুশারাকার কয়েকটি প্রামাণ্য সংজ্ঞা নিম্নরূপ-

১. আবদুর রকীব লিখেছেন, আইনের ভাষায় কোনো ব্যবসায় দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মিলনই শিরকাত। সুতরাং বলা যায় দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অংশীদারিত্বই শিরকাত।

২. ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (Islamic Development Bank) প্রদত্ত মুশারাকার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “Musharaka is an Islamic financing technique that adopts ‘equity sharing’ as a means of financing projects. Thus, embraces diferent types of profit and loss sharing partnerships. The partners (entrepreneurs, bankers etc ), share both capital and management of project so that profits will be distributed among them according to agreed ratio and loss is shared as per that equity participation (raito).”>

অর্থাৎ, “মুশারাকা হলো মূলধনে অংশীদারিত্ব বা ইক্যুইটি শেয়ারিং-এর ভিত্তিতে কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগের একটি ইসলামী অর্থায়ন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে লাভ- লোকসানভিত্তিক বিভিন্ন অংশীদারি কারবার গড়ে ওঠে। এ প্রকল্পের লাভ বা ক্ষতি অংশীদারগণকে বহন করতে হয়। অংশীদারগণ (উদ্যোক্তা, ব্যাংক ইত্যাদি) প্রকল্পে মূলধন সরবরাহ করেন ও ব্যবস্থাপনায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে চুক্তির শর্তানুযায়ী লাভের অংশ এবং মূলধন অনুপাতে লোকসান বণ্টন হয়।”

৩. দি অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস (AAOFT) প্রদত্ত মুশারাকার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “Musharaka is a form of partnership between the Islamic Bank and its clients whereby each party contributes to the capital of partnerships in equal or verifying degrees to establish a new project or share in an existing one and whereby each of the parties becomes an owner of the capital on a permanent or declining basis and shall have his due share of profits,অর্থাৎ, “মুশারাকা হলো ইসলামী ব্যাংক এবং এর গ্রাহকের মধ্যে এক ধরনের অংশীদারি কারবার যেখানে প্রত্যেক অংশীদার সমান বা ভিন্ন মাত্রায় কোনো নতুন কিংবা প্রতিষ্ঠিত প্রকল্পে মূলধন গঠনে অংশ নেয় এবং যেখানে প্রত্যেক অংশীদার স্থায়ী কিংবা ক্রমহ্রাসমান ভিত্তিতে মূলধনে মালিকানা লাভ করে এবং মুনাফার প্রাপ্য অংশ পায়।”

৪. ব্যাংক কোম্পানি আইন (সংশোধন) ১৯৯৫-এ মুশারাকার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “Musharaka means such an agreement under which a portion of capital of anything is provided by a bank conducted in accordance with the Islamic Sharaih and the other portion is given by the customer and in which profit in distributed in such proportion as mentioned in the agreement and loss is distributed in proportion to the capital.” অর্থাৎ, “মুশারাকা অর্থ এমন চুক্তি যার অধীন কোনো কাজে মূলধনের এক অংশ ইসলামী শরী’আহ্ মোতাবেক পরিচালিত কোনো ব্যাংক এবং অপর অংশ গ্রাহক যোগান দেয় এবং যে কাজের লাভ চুক্তিতে উল্লিখিত অনুপাতে এবং লোকসান মূলধন অনুপাতে বণ্টিত হয়।”

৫. সেন্ট্রাল শরী’আহ বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস্ অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত ও বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরিত (প্রস্তাবিত) ইসলামী ব্যাংক কোম্পানি আইন’-এ মুশারাকার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “মুশারাকা” (Musharaka) এমন এক ব্যবসায়িক চুক্তিকে বুঝাবে, যার অধীনে কোনো কারবারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে মূলধনের এক অংশ ব্যাংক কোম্পানি এবং অপর অংশ গ্রাহক যোগান দিবে। উক্ত ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফা চুক্তিতে উল্লিখিত অনুপাতে এবং লোকসান মূলধন অনুপাতে বণ্টিত হবে।”১৫৪

৬. ড. এম. নাজাতুল্লাহ সিদ্দিকী-এর মতে, “শিরকাতের অর্থ হচ্ছে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কোনো কারবারে নির্ধারিত পরিমাণে মূলধন নিয়ে সকলে মিলে কারবার এবং লাভ-লোকসানে নির্ধারিত পরিমাণে অংশীদার থাকার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে যৌথভাবে কারবার করা। (এখানে মূলধন ও শ্রম উভয় পক্ষেরই নির্ধারিত থাকতে হবে।) “১৫৫

৭. অধ্যাপক মুহাম্মদ শরীফ হুসাইন-এর মতে, “মুশারাকাহ্ হচ্ছে এমন অংশীদারি কারবার যেখানে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান লাভ করার উদ্দেশ্যে কারবার করার জন্যে পুঁজি যোগান দেয়, কারবার পরিচালনা করে এবং কারবারের লাভ-ক্ষতিতে অংশ নেয়। কারবারে লাভ হলে অংশীদারগণ পূর্বনির্ধারিত অনুপাতে তা ভাগ করে নেয়; আর লোকসান হলে প্রত্যেক অংশীদার তার পুঁজির আনুপাতিক হারে তা বহন করে।

৮. ড. এম. এ. হামিদের মতে, “Musharaka means partnership. There are two partners- the bank and the clients or the entrepreneurs. They agree to contribute their mutually agreed share to their capital required for operating the business, share profit in an agreed ratio and share loss in the proportion of their capital employed in the business, – অর্থাৎ, “মুশারাকা অর্থ অংশীদারি কারবার। এখানে দু’জন অংশীদার রয়েছেন- ব্যাংক স্বয়ং এবং উদ্যোক্তা। তারা ব্যবসার জন্যে পরস্পর সম্মত অংশ অনুসারে মূলধন ও শ্রম যোগান দেবে এবং স্বীকৃত অনুপাত অনুসারে মুনাফার অংশ ভাগ করে নেবে। তবে লোকসানের অংশ বহন করে ব্যবসায়ে বিনিয়োজিত অনুপাত অনুসারে মূলধনের

ক. ড. এম. এ. মান্নান-এর মতে,ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে অংশ নেয়ার প্রথম পদ্ধতি হচ্ছে মুশারাকা বা অংশীদারিত্ব। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকগুলো অংশীদারি চুক্তির ভিত্তিতে গ্রাহকের সাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কোনো প্রকল্পে অংশগ্রহণ করে। ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েই চুক্তিতে উল্লেখিত শর্ত মোতাবেক কারবারে পুঁজি যোগান দেয় এবং পূর্বে স্থিরকৃত হারে কারবারের মুনাফা ভোগ করে নেয়। এ পদ্ধতিতে ব্যাংকের পক্ষে ক্রমহ্রাসমান এবং অপর অংশীদারের পক্ষে ক্রমবর্ধমান মালিকানা নীতিও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ইসলামী শরী’আহর দলিল(Evidence of Islamic Shariyah)

ইসলামী আইনের চারটি প্রধান উৎস কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা মুশারাকা বৈধ। সকল মাযহাবে মুশারাকা কারবারকে বৈধ বলা হয়েছে।

১. আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে ইরশাদ করেছেন, فَهُمْ شُرَكَاء فِي الثَّلث

অর্থাৎ, “তারা তিন ভাগের এক ভাগের মধ্যে সম-অংশীদার হবে।

আল্লামা আব্দুল হাই লাখনভী বলেন, উক্ত আয়াতটি শিরকাতুল ইনান বা শিরকাতুল মিলক বিল জাবার-এর দলিল হিসেবে প্রযোজ্য।

২. আল-কুরআনে আরও বলা হয়েছে,

وَإِن كَثِيرًا مِّنَ الْخُلَطَاءِ لَيَبْغِى بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصُّلِحَتِ وَقَلِيلٌ مَّا هُمُ

অর্থাৎ, “আর শরিকদের অনেকেই একে অন্যের ওপর সীমালঙ্ঘন করে থাকে। তবে তারাই এরূপ করে না যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে।

এ আয়াতে আল্লাহ ন্যায়পরায়ণ অংশীদারদের অংশীদারি কারবারকে অনুমোদন করেছেন। একই সাথে এক অংশীদার অন্য অংশীদারের প্রতি যে অবিচার করে থাকে তা উল্লেখ করেছেন। একই সাথে ঈমানদার ও নেক অংশীদার যে অন্য অংশীদারের প্রতি জুলুম করে না তাও উল্লেখিত হয়েছে। মুশারাকা ব্যবসায় অপছন্দনীয় হলে আল্লাহ তা নিষিদ্ধ করতেন।

৩. মুশারাকা পদ্ধতিতে কারবার প্রাক-ইসলামী আরবে চালু ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর মহানবী (সা.) স্বয়ং ও তাঁর সঙ্গী-সাথিগণ এ পদ্ধতিতে কারবার করেছেন। মহানবী (সা.) এ ধরনের কারবারে নিজের সম্মতি জানিয়েছিলেন। তিনি নিজেও এ পদ্ধতিতে কারবার করেছেন। এটিই হলো মুশারাকা বৈধ হওয়ার অকাট্য। প্রমাণ।

৪. মহানবী মুহাম্মদ (সা.) নির্দেশিত বহু হাদীস থেকে মুশারাকা কারবারের বৈধতা প্রমাণিত হয়। মুশারাকা কারবার সম্পর্কে হাদীসে কুদসী রয়েছে। عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَفَعَهُ قَالَ: إِنَّ اللهَ يَقُولُ: أَنَا ثَالِثُ الشَّرِيكَيْنِ مَا لَمْ يَخْنُ أَحَدُهُمَا صَاحِبَهُ، فَإِذَا خَانَهُ خَرَجْتُ مِنْ بَيْنِهِمَا

অর্থাৎ, “হযরত আবু হুরাইরা (রা.) মহানবী (সা.)-এর নাম করে বললেন, তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তা’আলা বলেন, দু’জন অংশীদারের (অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কোনো ব্যবসায় করলে তাদের) সাথে আমি (আল্লাহ) তৃতীয় জন হয়ে থাকি যতক্ষণ না তাদের একজন তার অপর সাথি (অংশীদার) এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা খিয়ানত করে। আর যখনই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আসি ।

৫. রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে মুশারাকা ব্যবসা করেছেন। হাদীসের বাণী-

عَنِ السَّائِبِ. قَالَ: أَتَيْتُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَجَعَلُوا يُثْنُونَ عَلَيَّ وَيَذْكُرُونِي، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَا أَعْلَمُكُمْ يَعْنِي بِهِ، قُلْتُ: صَدَقْتَ بِأَبِي التَ وَأُتِي : كُنتَ شَرِيكي فَنِعْمَ الشَّرِيكُ كُنتَ لَا تُدَارِي، وَلَا تُمَارِي

অর্থাৎ, “হযরত সায়েব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (মক্কা বিজয়ের দিন) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসলাম, তখন তাঁর সাহাবিগণ আমার প্রশংসা করতে লাগলেন এবং আমার অতীতের কথা স্মরণ করতে লাগলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন, আমার মা বাবা আপনার জন্য কুরবানী হোক! আপনি ছিলেন আমার ব্যবসার উত্তম শরিক। আপনি কোনো বিবাদ ও দ্বন্দ্ব করতেন না।

৬. ইবনুল মুনযির বর্ণনা করেছেন, শিরকাত পদ্ধতির পক্ষে সকল যুগের আইনবেত্তাগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

মুশারাকা/শিরকাতের প্রকারভেদ(Classification of Musharaka Shirkat)

ফকিহগণের মতে মুশারাকা প্রধানত দুই প্রকার । যথা :

  • ১. শিরকাতুল মিলক বা মালিকানায় অংশীদারিত্ব
  • ২. শিরকাতুল উকুদ বা চুক্তিভিত্তিক অংশীদারিত্ব

মুশারাকার প্রকারগুলো সম্পর্কে আমরা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করবো :

১. শিরকাতুল মিল্‌ক বা মালিকানায় অংশীদারিত্ব (Shirkat-al-Milk – Share in ownership) : কোনোরূপ চুক্তি (লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে ব্যবসায় করার চুক্তি) ব্যতীত দুই বা ততোধিক ব্যক্তির কোনো বস্তুতে অংশীদার বা মালিক হওয়াকে ‘শিরকাতুল মিলক’ বলা হয়। অন্যকথায়, চুক্তিবদ্ধ না হয়ে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কোনো সম্পত্তির মালিক হলে তাকে শিরকাতুল মিল্‌ক বলে। উত্তরাধিকার, ওয়াসিয়াত বা উইল, দান বা অন্য কোনো ঘটনার ফলে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে এ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। ঘর-বাড়ি, জায়গা-জমি, দালানকোঠা বা অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা লাভ এ ধরনের শিরকাতের অন্তর্ভুক্ত। কোনো ব্যক্তি যখন মারা যান তখন উত্তরাধিকারিগণ মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মীরাস বা উত্তরাধিকার লাভ করেন। এরূপ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারিগণের মধ্যে কোনো নতুন চুক্তি সম্পাদন হয় না; বরং ইসলামী আইন মোতাবেক মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে মালিকানা লাভ করে। এক্ষেত্রে ‘শিরকাতুল মিল্‌ক’ বা মালিকানায় অংশীদারিত্বের উদ্ভব ঘটে। আবার দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনো জিনিস ক্রয় করে মালিকানায় অংশীদারিত্ব লাভ করলেও শিরকাতুল মিলকের উদ্ভব হয়।

মুফতি মুহাম্মদ তাকী উসমানী লিখেছেন, কোনো বস্তুতে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির যৌথ মালিকানা (Joint ownership) সাব্যস্ত হওয়াকে শিরকাতুল মিলক বলে এতে যৌথ মালিকগণ তাদের স্ব স্ব অংশ অনুযায়ী ঐ সম্পত্তি বা ঐ সম্পদ থেকে অর্জিত আয় ভোগ করেন। বস্তুত শিরকাতুল মিল্‌ক লাভ-লোকসানে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে স্বতঃস্ফূর্ত চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত কোনো অংশীদারি কারবার নয়; বরং সম্পত্তির ওপর যৌথ মালিকানাই এর মূল কথা। যথার্থ অর্থে অংশীদারি কারবার একে বলা যায় না। কেউ ইন্তিকাল করলে তার সম্পদের ওপর ওয়ারিশদের যৌথ মালিকানা অর্জিত হয় ।

শিরকাতুল মিল্‌ক বা মালিকানায় অংশীদারিত্ব আবার দুই ভাগে বিভক্ত। যথা-

. শিরকাতুল মিলক বিল ইখতিয়ার (key) খ. শিরকাতুল মিল্‌ক বিল জাবার (Suspe ক. শিরকাতুল মিল্‌ক বিল ইখতিয়ার (Leasy beltorage)(Shirkat-al Milk Bill Ikhtiyariyyah)

নিজেদের ইচ্ছায় বা ঐচ্ছিকভাবে কোনো সম্পদের ওপর যৌথ মালিকানা লাভ করা। যৌথ মালিকানাভুক্ত সম্পদ বিভাজ্য হওয়া সত্ত্বেও অংশীদারগণ যদি সেই সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি না করেন এবং যৌথ মালিকানায় রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা হলে তাকে শিরকাতুল মিল্ক বিল ইখতিয়ার বলে। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কোনো সম্পদ হেবার মাধ্যমে বা উপহার হিসেবে লাভ করলেও এ ধরনের শিরকাত উদগত হয়।

খ. শিরকাতুল মিল্‌ক বিল জাবার (Shirkat-al Milk Bill Jabriyya) বাধ্যতামূলকভাবে কোনো সম্পদের ওপর একাধিক ব্যক্তির যৌথ মালিকানা অর্জন। যৌথ মালিকাধীন সম্পদ যখন অবিভাজ্য হয়, অথচ অংশীদার বা মালিকগণ তা যৌথ মালিকানায় রাখতে বাধ্য হয়, তাহলে তাকে শিরকাতুল মিল্ক বিল জাবার বা বাধ্যতামূলক মালিকানাভিত্তিক অংশীদারিত্ব বা বাধ্যতামূলক চুক্তিবিহীন অংশীদারিত্ব বলে।

শিরকাতুল মিলুকের বিধান হচ্ছে, সম্পদের কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হলে তা মালিকানাস্বত্ব অনুপাতে মালিকগণকে বহন করতে হবে। আর সম্পদ থেকে কোনো আয় অর্জিত হলে মালিকানাস্বত্ব অনুপাতে অথবা পূর্ব-চুক্তি মোতাবেক তা মালিকদের মধ্যে বণ্টিত হবে। সকল মালিকের অনুমতি ব্যতীত এককভাবে কেউ সম্পদ ব্যবহার, বিক্রি বা দান করতে পারবেন না।

 

২. শিরকাতুল উকুদ বা চুক্তিভিত্তিক অংশীদারিত্ব (Shirkat-al Ukud) : দুই বা ততোধিক ব্যক্তি যৌথ বিনিয়োগ ও কারবারের ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত লাভ/ক্ষতি ভোগ/বহনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলে তাকে শিরকাতুল উকুদ বা চুক্তিভিত্তিক অংশীদারিত্ব বলে। ১৬৯ এ ধরনের শিরকাত সাধারণত নিজেদের ইচ্ছায় চুক্তি করে গড়ে তোলে। যেমন : দুই বা ততোধিক ব্যক্তি একত্রিত হয়ে চুক্তি করে কোনো জিনিস কিনে নিল বা যৌথ শ্রমদানের চুক্তির মাধ্যমে একত্রে কোনো সম্পদ অর্জন করল ইত্যাদি। এ ধরনের মালিকানা তাদের সকলের ইচ্ছার ভিত্তিতেই সৃষ্টি হয়। শিরকাতুল উকুদ (স) বা চুক্তিভিত্তিক অংশীদারিত্ব আবার চার ভাগে বিভক্ত। যথা :

  • ক. শিরকাতুল মুফাওয়াদা (এজি) বা সম-অংশীদারি কারবার;
  • খ. শিরকাতুল ইনান বা অসম অংশীদারি কারবার;
  • গ. শিরকাতুল আবদান (সা ) বা শারীরিক শ্রমভিত্তিক অংশীদারিত্ব, বা শিরকাতুস সানায়েবা পেশাভিত্তিক অংশীদারিত্বঃবা শিরকাতুল আ’মাল বা শ্রমভিত্তিক অংশীদারিত্ব;
  • ঘ. শিরকাতুল ওয়াজুহ বা সুনামভিত্তিক অংশীদারি কারবার,

ক. শিরকাতুল মুফাওয়াদা বা সম-অংশীদারি কারবার(Shirkat-al Mufawidah)

যে কারবারের অংশীদারগণ সমপরিমাণ পুঁজি যোগান দেন, কারবারে সমভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং লাভ-লোকসান সমানভাবে ভাগ করে নেন, তাকে শিরকাতুল মুফাওয়াদা বা সম-অংশীদারি কারবার বলে। এ ধরনের শিরকাতে অংশীদারগণ পরস্পর পরস্পরের এবং প্রত্যেকে অন্য সকলের আমানতদার (Trustee) ও প্রতিনিধি (Agent) বা উকিল (Wakil) হিসেবে কাজ করেন। এরূপ কারবারে অংশীদারগণ তৃতীয় পক্ষের নিকট ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে দায়ী থাকেন।

খ. শিরকাতুল ইনানবা অসম অংশীদারি কারবার (Shirkat-al Inan)

কোন অংশীদারি কারবারে প্রত্যেক অংশীদারের মূলধন (Equity), লাভ, ব্যবসায়ে সময়দান ও দায়িত্ব-কর্তব্য যদি অসমান হয়, সে অংশীদারি কারবারকে শিরকাতুল ইনান বা অসম অংশীদারিত্ব বা স্বাধীন অংশীদারিত্ব বলে। এক্ষেত্রে কারবারে লাভ হলে অংশীদারগণ অসমান লাভ নেয় এবং লোকসান হলে পুঁজির অনুপাতে তা বহন করে। শিরকাতুল ইনান কারবারের অংশীদারদের প্রত্যেকেই প্রত্যেকের এবং অপরের সকলের প্রতিধিনি; কিন্তু জামিনদার নন। সুতরাং এ কারবারে তৃতীয় পক্ষের নিকট অংশীদারদের দায়িত্ব ব্যক্তিগত যৌথ নয়। শিরকাতুল ইনান পদ্ধতিতেই অধিকাংশ অংশীদারি ব্যবসায় পরিচালিত হয়ে থাকে।

গ. শিরকাতুল আবদান (ভালো), বা শারীরিক শ্রমভিত্তিক অংশীদারিত্ব/শিরকাতুস সানায়ে বা পেশাভিত্তিক অংশীদারিত্ব/শিরকাতুল আ’মাল বা শ্রমভিত্তিক অংশীদারিত্ব(Shirkal-al Abadan/Amal/Sanai)

যে কারবারে অংশীদারগণ শ্রম ও তাকে পুঁজি করে যৌথভাবে গ্রাহকদেরকে বিভিন্ন সেবা প্রদান করার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং গ্রাহক থেকে অর্জিত পারিশ্রমিক পূর্ব- নির্ধারিত হারে পরস্পরের মাঝে বণ্টিত হয়, তাকে শিরকাতুল আ’মাল বলে। যেমন : দু’জন দর্জি এ মর্মে চুক্তিবদ্ধ হলো যে, তারা উভয়ে গ্রাহককে সেলাইসংক্রান্ত সেবা প্রদান করবেন এবং তারা এর প্রতি লক্ষ্য না রেখে তা উভয়ের মাঝে সমহারে বণ্টন হবে। এরূপ চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করাকে শিরকাতুল আ’মাল বলে। একই পেশার দুই বা ততোধিক ব্যক্তি যখন কোনো অংশীদারি পেশাভিত্তিক কারবার শুরু করে এবং পেশা বা কাজ থেকে প্রাপ্ত আয় চুক্তি অনুসারে ভাগ করে নেয়, তাকে শিরকাতুল সানাই বা আবদান বলে। এ অংশীদারি কারবারে অংশীদারগণ পুঁজি বিনিয়োগ করে না; বরং তাদের দক্ষতা ও শ্রম দিয়ে কারবারে অংশগ্রহণ করে। যেমন : যদি দুই বা ততোধিক রাজমিস্ত্রি এ শর্তে চুক্তি করে যে, তারা সকলেই কাজ সংগ্রহ করে কাজটি সম্পাদন করবেন এবং মজুরি সবাই চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত হারে ভাগ করে নেবেন তা হলে এক্ষেত্রে কারবারটি হবে শিরকাতুল সানাই বা পেশাভিত্তিক অংশীদারিত্ব। এ পদ্ধতিকে শিরকাতুত তাকাব্বুল (কাজ সংগ্রহভিত্তিক অংশীদারিত্ব), শিরকাতুল আবদান বা শারীরিক শ্রমভিত্তিক অংশীদারিত্বও বলে।

ঘ. শিরকাতুল ওয়াজুহ বা সুনামভিত্তিক অংশীদারি কারবার (Shirkat-al Wajuh)

ওয়াজুহ্ অর্থ সততা, সুনাম, মর্যাদা ইত্যাদি। সুনাম, সুখ্যাতি ও সততাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে যে অংশীদারি কারবার পরিচালিত হয় তাকে শিরকাতুল ওয়াজুহ বা সুনামভিত্তিক অংশীদারি কারবার বলে। অংশীদারগণ যদি এ মর্মে চুক্তিপত্র করেন যে, তারা সকলে পুঁজি বা মূলধন ছাড়া ব্যবসায়ী মহলে স্বীয় সুনাম, মর্যাদা, খ্যাতি ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে বাকিতে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে নগদ মূল্যে বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করবেন এবং এ ব্যবসায় মুনাফা বা লোকসান হলে তা সকলেই চুক্তি মোতাবেক ভাগ করে নিবেন। এ পদ্ধতিকে বলে শিরকাত আল-ওয়াজুহ। অথবা, যে কারবারে অংশীদারগণ পুঁজি বিনিয়োগ করে না; বরং স্বীয় পরিচিতি ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে ব্যবসায় পণ্য বাকিতে ক্রয় করে নগদ বিকি করে, এতে যে লাভ হয় তা পূর্ব-নির্ধারিত হারে অংশীদারগণ বণ্টন করে নেয়। অন্যথায় কোনো অংশীদারি কারবারে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি যদি এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, তারা নগদ পুঁজি বিনিয়োগ করবে না বা করতে পারবে না, বরং পুঁজি ব্যতীত সুনাম, খ্যাতি, পরিচিতি, মর্যাদা ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিতে বাকিতে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে নগদে বিক্রি করবে এবং এতে যে লাভ- লোকসান হবে তা প্রত্যেকে পূর্ব-নির্ধারিত হারে ভাগ করে নেবেন; তা হলে এ ধরনের চুক্তিকে শিরকাতুল ওয়াজুহ বলে। এ ধরনের অংশীদারি কারবারে মুনাফা চুক্তিপত্র অনুযায়ী সমান সমান বা কম-বেশি করা যাবে; কিন্তু লোকসান হলে তার দায়-দায়িত্বও অংশ অনুপাতে প্রত্যেক বহন করবেন।স্থায়িত্বের ভিত্তিতে মুশারাকার শ্রেণিবিভাগ স্থায়িত্বের ভিত্তিতে মুশারাকা দু’প্রকারের হতে পারে। যেমন:

  • ক. মুশারাকা দাইমা বা স্থায়ী মুশারাকা (Permanent Musharaka)(Diminishing
  • খ. মুশারাকা মুতানাকিসাহ বা ক্রমহ্রাসমান মুশারাকা Musharakah /Declining Musharakah)

ক. মুশারাক দাইমা বা চলমান মুশারাকা বা স্থায়ী মুশারাকা(Permanent Musharaka)

এ ধরনের মুশারাকায় ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকের সাথে সম অথবা অসম পরিমাণ মূলধন যোগান দেয়, বাৎসরিক মুনাফা চুক্তি অনুযায়ী ভাগ করে নেয় বা লোকসান হলে মূলধন অনুপাতে বহন করে এবং চুক্তির মেয়াদ সুনির্দিষ্ট থাকে না। তাই এ ধরনের মুশারাকাকে মুশারাকা মুসতামিরাহ্ চলমান মুশারাকা বা মুশারকা তাম্মাহ বলে। যদিও এ ধরনের কারবার বিলুপ্তি (Liquidation) পর্যন্ত চলতে পারে তথাপি কোনো অংশীদার ইচ্ছা করলে তার অংশে বিলুপ্তির আগেও হস্তান্তর করতে পারে। এ ধরনের মুশারাকা চুক্তিতে কোনো মেয়াদ উল্লেখ থাকে না। এ পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক উদ্যোক্তার মাধ্যমে কোনো প্রকল্প বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য অর্থায়ন করতে পারে। মূলধনের শেয়ার অর্জন করার মাধ্যমেও ব্যাংক কোনো চলতি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন করতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাংক উক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অংশ নেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে। এ জাতীয় স্থায়ী মুশরাকা সাধারণত বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে করা হয়, যদিও ব্যাংক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) গ্রাহকদেরকে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে।

খ. মুশারাকা মুতানাকিসাহ বা ক্রমহ্রাসমান মুশারাকা(Diminishing Musharakah/Declining Musharakah)

মুশারাকা মুতানাকিসাহ একটি ইজতিহাদী উদ্ভাবন। এটা একটি যৌথ কারবার বা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে। Practical Encyclopedia of Islamic Bank-এর ভাষ্য মতে, এটা একটি অংশীদারিত্বের ব্যবসায় যাতে ব্যাংক তার গ্রাহক অংশীদারকে মালিক হিসেবে মূলধন খাটানোর অধিকার দেয় উভয়ের মধ্যে সম্পাদিত কার্যক্রম অনুযায়ী এককভাবে বা বিভিন্ন পর্যায়ে। মালিকানায় ব্যাংকের অংশ অপর অংশীদার কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধ করবে এবং যে অংশ পরিশোধ করবে তার মালিকানা অর্জন করবে। (“A partnership whereby the bank gives the partner the right to supersede it as owner in its stead, in one or several stages according to agreement reached & to the type of operation, by setting aside regularly part of the yielded to the proceeds as installments refund the share given by the bank.”)

মুশারাকা মুতানাকিসাহ সম্পর্কে ওআইসি ফিকহ্ একাডেমির রায়ে বলা হয়েছে- এটি একটি নতুন ধরনের মুয়ামালাহ। এ পদ্ধতিতে কোনো আয়ুবর্ধক বা উৎপাদনশীল প্রকল্পে দু’পক্ষ অংশীদার হয়। অংশীদারদ্বয়ের কোনো একপক্ষ দ্বিতীয় পক্ষের অংশ ক্রমান্বয়ে ক্রয়ের অঙ্গীকার করে থাকে। এক্ষেত্রে ক্রেতার অংশের আয় থেকে তা ক্রয় করা কিংবা অন্য কোনো উৎসের অর্থ থেকে তা ক্রয় করা উভয়ই সমান। এটা এক বিশেষ ধরনের মুশারাকা, যেখানে চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহক ব্যাংকের মুনাফার অংশ পরিশোধের সাথে সাথে সম্পদের ওপর ব্যাংকের অংশও পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করার ফলে ব্যাংকের মালিকানা ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং সাথে সাথে গ্রাহকের মালিকানা বাড়তে থাকে। চুক্তির মেয়াদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার মূলধনকে কিছুসংখ্যক একদে বিভক্ত করা হয় এবং গ্রাহক নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তির মেয়াদের মধ্যে প্রত্যেকটি একক ক্রয় করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। এভাবে ক্রয়ের ফলে গ্রাহকের মালিকানা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং মেয়াদান্তে গ্রাহক সম্পদের বা ব্যবসার সম্পূর্ণ মালিকানা অর্জন করে।

যে সমস্ত সম্পদ থেকে নিয়মিত আয় হওয়া সম্ভব সে সমস্ত ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি উপযোগী। এ পদ্ধতিতে সম্পদের ওপর গ্রাহকের পূর্ণ মালিকানা অর্জন সম্ভব বিধায় এটা গ্রাহককে উৎসাহিত করে।

শিরকাতের আরো কতিপয় প্রকার(Another Types of Musharaka)

ইমাম মালেক (র.) এবং তাঁর অনুসারিগণ শিরকাতের আরো কতিপয় প্রকরণ বর্ণনা করেছেন। যেমন :

ক. তিব্বী শিরকাত : এই পদ্ধতি অনুযায়ী একাধিক চিকিৎসক যৌথভাবে একটি হাসপাতাল বা ক্লিনিক স্থাপন করতে পারেন। হাসপাতালে বা ক্লিনিকে যে মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট ও ওষুধপত্র লাগবে তা তাঁরা শরীকানার ভিত্তিতে খরিদ করবেন। অতঃপর রোগীদের চিকিৎসা করে যে আয় হবে তা পূর্বচুক্তি অনুযায়ী সকলের মধ্যে বণ্টিত হবে।

 

খ. তালীমি শিরকাত : এই পদ্ধতিতে একাধিক শিক্ষক একত্রে মিলে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারেন এবং টিউশন ফি বাবদ যে আয় হবে তা পূর্বচুক্তি অনুযায়ী তাদের মাঝে বণ্টিত হবে।

গ. যার’ঈ শিরকাত : এই পদ্ধতি অনুযায়ী একাধিক কৃষক যৌথভাবে জমি, কৃষিযন্ত্রপাতি, বীজ প্রভৃতি সংগ্রহ করে চাষাবাদের কাজ করতে পারেন। এতে যদি কেউ শুধু পুঁজি, আবার কেউ শুধু শ্রম বিনিয়োগ করেন তাহলেও চলবে। তবে কারবারের মুনাফা পূর্বচুক্তি অনুযায়ী সকলের মধ্যে বণ্টিত হবে।

ঘ. মাদানী শিরকাত : এই পদ্ধতি অনুযায়ী একাধিক লোক মিলে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য একটি যৌথ কোম্পানি গড়ে তুলতে পারেন

ঙ. শিরকাতে হামল ও নকল : এই পদ্ধতি অনুযায়ী একাধিক লোক মিলে মাল পরিবহনের জন্য ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি’ গঠন করতে পারেন।

মুশারাকার বৈশিষ্ট্য(Characteristics of Musharaka)

মুশারাকা বিনিয়োগ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলো নিন্মরূপ-

১. মুশারাকা বা শিরকাত দ্বিপাক্ষিক/অংশীদারি কারবার। কারবারে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেয় গ্রাহক ও ব্যাংক। উভয়ের পুঁজি সমান অথবা কম-বেশি হতে পারে।

২. চুক্তি মোতাবেক আনুপাতিক হারে মূলধন যোগান ও অর্জিত মুনাফায় অংশগ্রহণের শর্তে শিরকাত বা অংশীদারি কারবার পরিচালিত হয়। মুশারাকা পদ্ধতিতে অর্থায়নের (Financing) উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিনিয়োগকৃত পুঁজির অনুপাতে ঐ ব্যবসার সম্পদে অংশীদার হওয়া।

৩. অংশীদারদের এ স্বাধীনতা রয়েছে যে, তারা তদের পারস্পরিক সন্তুষ্টিতে প্রত্যেকের জন্য মুনাফার অনুপাত সাব্যস্ত করতে পারে। তবে যে অংশীদার সুস্পষ্টভাবে নিজেকে ব্যবসার জন্য কাজ করার দায়িত্ব থেকে পৃথক করে নেয়, সে তার পুঁজির অনুপাত অপেক্ষা অধিক মুনাফার দাবি করতে পারে না।

৪. মুশারাকা বা শিরকাত স্থায়ী বা অস্থায়ী হতে পারে।

৫. কারবার সমাপ্তির পর চূড়ান্তভাবে লাভ-লোকসান নির্ণয়ের পর তা অংশীদারদের মধ্যে বণ্টিত হয় বলে গ্রাহক যথাযথভাবে যাবতীয় হিসাব সংরক্ষণ করবেন। ব্যাংকে নিজে অথবা মনোনীত নিরীক্ষক দিয়ে এ হিসাব পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ করাতে পারে।

৬. লোকসান প্রত্যেককেই তাদের পুঁজির অনুপাতে বহন করতে হবে। অন্যথায় বিনিয়োগকারী/অর্থযোগানদাতা তার পুঁজির অনুপাতে ব্যবসার লোকসানেও অবশ্যই অংশীদার হতে হবে। স্বাভাবিক ব্যবসায়িক লোকসান হলে তা মূলধন অনুপাতে বণ্টিত হবে; কিন্তু লোকসান ( Loss) যদি পরিচালক বা তার কোনো কর্মচারী কিংবা প্রতিনিধি কর্তৃক শর্ত লঙ্ঘন, অবহেলা, অদক্ষ পরিচালনা, অব্যবস্থাপনা অথবা বিশ্বাসভঙ্গের কারণে হয়ে থাকে; সেক্ষেত্রে পরিচালক ও ব্যবস্থাপকগণই সমস্ত লোকসান বহন করতে বাধ্য থাকবেন।

৭. ব্যবসায় পরিচালনায় সকল অংশীদার অংশগ্রহণ করতে পারেন কিংবা চুক্তি। মোতাবেক এক বা একাধিক অংশীদার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ব্যবসায় যথাযথভাবে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্যে পরিচালক ও ব্যবস্থাপকগণ দায়ী। থাকেন। নিয়মিত পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান মুশারাকা কারবারের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য অত্যাবশ্যক। এজন্য কারবারের যথাযথ তদারকি ও পর্যবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত জনশক্তি থাকতে পারে।

৮. কারবারের মালামাল নগদ অথবা বাকি উভয় প্রকারেই বিক্রি করা যেতে পারে। মূলধন নগদ টাকা কিংবা পণ্যসামগ্রী উভয় প্রকারই হতে পারে।

৯. মুশারাকা কারবার মূলত আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা এবং তাকওয়ার (পরহেজগারির) ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে থাকে। মুশারাকা বা অংশীদারদের অবশ্যই সুন্দর নৈতিক চরিত্র থাকতে হবে।

১০. ব্যাংক মুশারাকা চুক্তিতে যেকোনো যুক্তিসঙ্গত শর্তারোপ করতে পারে। যেমন- কোনো গ্রাহক ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো পণ্য লোকসানে বিক্রি করতে পারবেন না।

মুশারাকা বিনিয়োগের শর্তাবলি(Terms of Musharaka Investment)

মুশারাকা বিনিয়োগের শর্তাবলি নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

ক. চুক্তি সম্পাদন সম্পর্কিত শর্তাবলি(Terms Related to Contract)

১. চুক্তি : মুশারাকা কারবারের মূল ভিত্তি হচ্ছে চুক্তি। অংশীদারদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হতে হবে। এই চুক্তিপত্রে প্রত্যেক অংশীদারের প্রদেয় মূলধনের পরিমাণ, মুনাফার অংশ, কারবারের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা এবং অংশীদারদের বেতন-ভাতা বিষয়ে নিয়ম ও শর্তাবলি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। আল- কুরআনের নির্দেশ অনুসারে চুক্তি লিখিত হওয়াই বাঞ্ছনীয় ।

২. সাক্ষী : আল্লাহ তায়ালার বিধান অনুযায়ী চুক্তি দু’জন পুরুষ সাক্ষী অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা সাক্ষীর সম্মুখে লিখিত হওয়া বাঞ্ছনীয় ।

৩. বিরোধ নিষ্পত্তি : ভবিষ্যতে বিরোধের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে চুক্তিতে সম্ভাব্য সকল বিষয়ের উল্লেখ থাকতে হবে।

৪. চুক্তি বাতিল প্রসঙ্গে: দু’জন অংশীদারের ক্ষেত্রে একজনের মৃত্যু হলে মুশারাকা চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। এরপর অন্যপক্ষ কর্তৃক এই চুক্তিতে মুশারাকা ব্যবসায় পরিচালনা করা বৈধ হবে না। তবে দুই জনের অধিক শরিক হলে একজনের মৃত্যুতে মুশারাকা চুক্তি বাতিল হবে না। 

খ. মূলধন বিনিয়োগসংক্রান্ত শর্তাবলি(Terms Related to Capital)

১. অংশীদারগণ সমান অথবা অসমভাবে মূলধন যোগান দিতে পারেন। অন্যকথার সকল অংশীদারের মূলধন সমান হওয়া শর্ত নয়।

২. মূলধন নগদে অথবা সম্পদেও দেওয়া যায়। অধিকাংশ ফকিহর মত হচ্ছে মুশারাকার মূলধন নগদ অর্থ হতে হবে। কিছুসংখ্যক ফকিহ পণ্য/সম্পদকে মুশারাকার মূলধন হিসেবে গণ্য করা বৈধ বলেছেন। তবে সম্পদ প্রদান করলে সম্পদের মূল্য কোনো দক্ষ পেশাদার সার্ভেয়ার বা মূল্যায়নকারী দ্বারা মূল্যায়ন করে অংশীদারের সম্মতিতে নির্ধারিত হতে হয়। এ নির্ধারিত মূল্যই সংশ্লিষ্ট অংশীদারের শেয়ার মূলধন হিসেবে বিবেচিত হয়। ফকিহদের কেউ কেউ বলেছেন, এমন পণ্যকে মুশারাকার মূলধন হিসেবে গ্রহণ করা যাবে ব্যবসার শুরুতেই যার মূল্য নির্ধারণ করে নগদ অর্থে রূপান্তর করা যায়।
৩. মুশারাকা মূলধনের পরিমাণ, ধরন ও শ্রেণি নির্দিষ্ট হতে হবে।

৪. মুশারাকা কারবারে কোনো অংশীদারের মালিকানাধীন সম্পদকে মুশারাকার মূলধন হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, তবে অংশীদারের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সম্পদ স্বত্ব ত্যাগ করে মুশারাকা ব্যবসায় প্রদান করা হলে অসুবিধা নেই।

৫. মুশারাকা কারবারে কোনো অংশীদারের বিশেষ কোনো সম্পদকে মূলধনের সাথে মিশ্রিত করা বৈধ নয়।

৬. অংশীদারগণ কর্তৃক বিনিয়োগকৃত মূলধন একটি একক তহবিল এবং সত্তা হিসেবে পরিগণিত হয়।

৭. ‘লাভের জন্য ঝুঁকি’ এ নীতির ওপর ভিত্তি করে মুশারাকা কারবার পরিচালিত ।তাই কোনো অংশীদার অপর অংশীদারের মূলধনের নিরাপত্তা দিতে পারে না।

গ. অংশীদারদের ক্ষমতাসংক্রান্ত শর্তাবলি(Terms Related to Power of Partners)

১. প্রত্যেক অংশীদার মুশারাকা কারবারে তার নিজের পক্ষ থেকে এবং অংশীদারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ।

২. মুশারাকা বিনিয়োগে সকল অংশীদারের সম্পত্তি ছাড়া কোনো অংশীদার ব্যবসায়ের জন্য ধার করতে অথবা ব্যবসায়ের ফান্ড থেকে তৃতীয় পক্ষকে অর্থ ধার দিতে অথবা দান করতে অথবা অনুদান দিতে পারবেন না ।

৩. প্রত্যেক অংশীদারের ব্যবসায়িক কারণে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষমতা থাকবে।

৪. অংশীদারগণ মুশারাকা কারবারের কাজ করার জন্য শ্রমিক নিয়োগ করতে পারবেন এবং পারিশ্রমিক মুশারাকা কারবার থেকে বহন করতে হবে; কিন্তু কোনো অংশীদার যদি এমন কাজ করার জন্যে শ্রমিক নিয়োগ করেন যে কাজ ঐ অংশীদারের দায়িত্বে ছিল তাহলে এমন শ্রমিকের খরচ সংশ্লিষ্ট অংশীদার বহন করবেন। কারণ যেহেতু অংশীদারির চুক্তিটি মূলধন এবং ব্যবস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এবং কারবারের মুনাফাও এ দুয়ের ওপর নির্ভর করে।

ঘ. ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত শর্তাবলি(Terms Related to Management)

১. সাধারণ নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক অংশীদার মুশারাকা কারবারের ব্যবস্থাপনা (Management) ও পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং কাজ করার অধিকার রাখেন। তবে সম্মত হলে যেকোনো একজন অথবা সুনির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করলে কারবার পরিচালনায় কোনো বাধা নেই। যদি সকলে কারবার। পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন তবে চুক্তির শর্তানুযায়ী সকল বিষয়ে একে অপরের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হন এবং সাধারণ অবস্থায় প্রত্যেকের কাজ সকলের কাজ হিসেবে পরিগণিত হয়। কোনো অংশীদার ইচ্ছা করলে কারবার ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ থেকে বিরতও থাকতে পারেন; কিন্তু এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় অংশীদারগণ (Sleeping partners) তাদের বিনিয়োগকৃত মূলধন অনুপাত অপেক্ষা অধিক লাভ পাবেন না, বরং মূলধনের পরিমাণ অনুপাতে পাবেন। 

২. মুশারাকা কারবারের প্রত্যেক অংশীদার কারবারে ব্যবস্থাপনার কাজ যেমন-

পরিকল্পনা প্রণয়ন, নীতি নির্ধারণ, বাস্তবায়ন, তত্ত্বাবধান ইত্যাদি কর্ম সম্পাদন করতে পারেন। আবার কোনো একজন অংশীদারও তা সম্পাদন করতে পারেন।

৩. যদি একজন অংশীদার ব্যবস্থাপনার সকল কাজ সম্পাদন করেন তাহলে তিনি প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বেতন/ভাতার অধিকারী হবেন।

৪. আগের দিনের ফকিহগণ কারবার পরিচালনায় অংশগ্রহণের জন্যে কোনো অংশীদারকে বেতন-ভাতা ইত্যাদি প্রদান অনুমোদন করতেন না; কিন্তু আধুনিককালের ফকিহদের একটি অংশের মতে, ম্যানেজিং পার্টনার অংশীদার হিসেবে কারবারের লাভ- লোকসানের ভাগী হবার পাশাপাশি ম্যানেজার হিসেবে বেতন নিতে পারবেন। যদি এ ব্যাপারে সকল অংশীদারের সম্মতি থাকে। মুশারাকা কারবারে সকল অংশীদারই মূলধনের যোগান দানের বিনিময়ে লাভ-লোকসানের অংশীদার হন এবং অংশীদারদের মধ্যে কেউ কারবার পরিচালনায় অংশ নিলে তিনি তার কাজের জন্য পারিশ্রমিক পাওয়ার হকদার।

৫. মুশারাকা কারবারে কোনো অংশীদার তার নিজস্ব কোনো খরচ কারবার থেকে বহন করতে পারেন না; কিন্তু কারবারের উদ্দেশ্যে অংশীদারের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ইত্যাদি খরচ কারবার বহন করবে।

ঙ. মুনাফা বা লাভ বণ্টনের নীতিসংক্রান্ত শর্তাবলি(Terms of Distribution of Profit)

১. মুশারাকা কারবারের শুরুতেই অংশীদারদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যবসায়ে লাভ হলে কে কত অংশ পাবেন তা চুক্তিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। ব্যাংক কিংবা গ্রাহক অর্থাৎ মুশারাকা ব্যবসায়ে কোনো পক্ষের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ লাভ ঠিক করা বৈধ নয়। অর্থাৎ লাভের অনুপাত বা শতকরা হার নির্ধারণ করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই কোনো অংশীদারকে নির্দিষ্ট অঙ্কের মুনাফা শর্ত করা যাবে না। লাভের জন্য ঝুঁকিবহন নীতি বজায় থাকবে।

২. লাভ পরিমাণযোগ্য হতে হবে, অন্যথায় লাভ বণ্টনের সময় অথবা চুক্তির বিলুপ্তির সময় বিরোধের আশঙ্কা থাকে।

৩. অর্জিত লাভের ওপর মুনাফা বণ্টনের অনুপাত প্রয়োগ হবে। মূলধনের ওপর কোনো নির্ধারিত হার অথবা কোনো নির্ধারিত বা অনির্ধারিত অংশ (যেমন : প্রতি বছর মূলধনের ১০% অথবা ১,০০,০০০ টাকা) মুনাফা বণ্টনের ভিত্তি হতে পারবে না এবং তা হলে চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে। অন্যকথায় মুশারাকা কারবারে বিভিন্ন অংশীদারদের মধ্যে মুনাফা আনুপাতিক হারে যেমন : অর্ধেক, এক-তৃতীয়াংশ, এক- চতুর্থাংশ অথবা শতকরা হারে যেমন : ৩০%, ৪০%, ৫০% ইত্যাদি নির্ধারিত হতে হবে।

৪. চুক্তির শর্তানুযায়ী অংশীদারগণের মধ্যে অর্জিত লাভ মূলধন অনুপাতে বণ্টিত হতে পারে। ইমাম মালেক (রহ) এবং ইমাম শাফেয়ী (রহ)-এর মতে প্রত্যেক অংশীদারকে তার মূলধনের পরিমাণ অনুপাতে লাভ প্রদান করা মুশারাকা যথার্থ ও বিশুদ্ধ হওয়ার জন্যে পূর্বশর্ত। অতএব কোনো অংশীদার যদি মোট মূলধনের ৪০% বিনিয়োগ করে তাহলে সে লভ্যাংশের ৪০% ই পাবে। সুতরাং লভ্যাংশের ৪০% অপেক্ষা কম বা বেশি নির্ধারণ করে কোনো চুক্তি করা হলে তা শরী’আহর দৃষ্টিতে বৈধ হবে না।

৫. কোনো সক্রিয় অংশীদারের মুনাফা প্রাপ্তির অনুপাত অন্যদের তুলনায় বেশি হতে পারে। অন্যকথায় অংশীদারদের মধ্যে কেউ যদি মুশারাকা কারবারে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন অথবা কার্যাবলি বাস্তবায়নের কাজে অংশগ্রহণ করেন তাহলে। এসব কাজের বিপরীতে তার জন্যে লভ্যাংশ নির্ধারণ করা যাবে; এটা তার প্রাপ্য অধিকার। আর অবশিষ্ট অংশীদাররা মূলধনের অনুপাতে লভ্যাংশ পাবেন অথবা সবার। সম্মতির ভিত্তিতে পূর্বনির্ধারিত হার অনুযায়ি লভ্যাংশ পাবেন।

৬. অংশীদারগণ তাদের মুনাফা প্রাপ্তির অনুপাত কম-বেশি করতে পারেন মুশারাকা কারবারে কোনো অংশীদারের মুনাফার অংশ তার পুঁজির অনুপাতে না হলে দোষ নেই। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ)-এর মতে, অংশীদারদের পারস্পরিক আলোচনাসাপেক্ষে লভ্যাংশের হার বিনিয়োগকৃত পুঁজির অনুপাত অপেক্ষা কম বা বেশি হতে পারে। সুতরাং ৪০% বিনিয়োগকারীর জন্যে লাভের ৬০-৭০% এবং ৬০% বিনিয়োগকারীর জন্যে শুধু ৩০-৪০% গ্রহণ করা বৈধ হবে।

৭. ইমাম আবু হানিফা (রহ) মুনাফার হার প্রসঙ্গে ইমাম মালেক (রহ), ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের (রহ) দু’ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় সাধন করে বলেছেন, সাধারণ অবস্থায় লভ্যাংশের হার বিনিয়োগকৃত পুঁজির অনুপাত অপেক্ষা কম বা বেশি হতে পারবে; কিন্তু কোনো অংশীদার যদি চুক্তিপত্রে এ মর্মে সুস্পষ্ট শর্তারোপ করে যে, তিনি কখনো ব্যবসায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন না এবং মুশারাকার পুরো মেয়াদে তিনি নিষ্ক্রিয় অংশীদার (Sleeping Partners) হিসেবে থাকবেন, এমতাবস্থায় তার লভ্যাংশের হার বিনিয়োগকৃত পুঁজি অপেক্ষা বেশি হতে পারবে না। ১৮৭

চ. লোকসান বণ্টন সংক্রান্ত শর্তাবলি(Terms for Distribution of Loss)

১. মুশারাকা কারবারে লোকসান হলে সকল অংশীদারের মধ্যে তাদের স্ব-স্ব মূলধন অনুপাতে বণ্টিত হয়। লোকসানের অংশ অবশ্যই পুঁজির অনুপাত অনুযায়ী হতে হবে। এটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। কোনো অংশীদারকে যদি তার পুঁজির অনুপাতের চেয়ে অধিক বা কম লোকসানের অংশ দেওয়ার শর্ত করা হয়, তাহলে মুশারাকা চুক্তি অবৈধ ও বাতিল বলে গণ্য হবে।

২. মুশারাকা ব্যবসায়ে লোকসান হলে মূলধন অনুপাতে তা সকল অংশীদারকে বহন করতে হবে। চুক্তিবলে লোকসান থেকে কোনো পক্ষকে অব্যাহতি প্রদান বৈধ নয়। যেমন এ মর্মে কোনো পক্ষের মুশারাকা চুক্তি করা যে, তিনি ব্যবসায়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ পুঁজি সরবরাহ করবেন আর মাসে মাসে কিংবা বছরে ব্যবসার আয় থেকে তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা দেয়া হবে; কিন্তু তাঁর পুঁজি অক্ষত থাকবে। এরূপ চুক্তি করা মুশারাকার ক্ষেত্রে শরী’আহ্ নীতির পরিপন্থি।

৩. মুশারাকা ব্যবসায়ে লোকসান হলে এবং এ লোকসান যদি অংশীদারদের মধ্যে থেকে যারা পরিচালনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছেন তাদের অনীহা অথবা চুক্তির শর্তাবলির পরিপন্থি কোনো কার্যকলাপের জন্যে না হয়ে থাকে তাহলে অংশীদারগণের মূলধনের অংশ অনুপাতে লোকসানের অংশ বহন করবেন। এ ক্ষেত্রে তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হলেও অন্য কোনো হার নির্ধারণ করা যাবে না।

৪. মুশারাকা ব্যবসায়ে লোকসান হলে অংশীদারদের মধ্যে যিনি পরিচালনার দায়িত্বে আছেন তার ওপর সব ক্ষতির বোঝা চাপানো যাবে না। তবে ক্ষতি যদি তার ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে এবং তা প্রমাণিত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ তার কাছ থেকে আদায় করা যাবে।

ছ. মুশারাকার বিলোপসাধন-সংক্রান্ত শর্তাবলি(Terms for Termination of Musharaka)

১. কারবারের উদ্দেশ্য অর্জিত হলে মুশারাকার বিলুপ্তি ঘটে বা কারবার সমাপ্ত করা যায়।

২. চুক্তির শর্তানুযায়ী কোনো অংশীদার যেকোনো সময় অন্য অংশীদারদের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে মুশারাকার বিলোপ ঘটাতে পারেন। অন্যকথায় প্রত্যেক অংশীদার যেকোনো সময় অপর অংশীদারকে নোটিস প্রদান করে মুশারাকা বিলুপ্ত করার অধিকার রয়েছে। এ ধরনের নোটিসের মাধ্যমে মুশারাকা কারবার বিলুপ্তি হয়ে যাবে।

৩. মুশারাকা কারবার চলাকালীন যদি কোনো অংশীদার মৃত্যুবরণ করেন তাহলে মৃত ব্যক্তির অংশীদারিত্ব বিলুপ্তি হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে মৃতের উত্তরাধিকারিগণ ইচ্ছে করলে তার অংশীদারিত্ব উঠিয়ে নিতে পারবেন অথবা মুশারাকা চুক্তি অব্যাহত রাখতে পারবেন।

৪. যদি কোনো অংশীদার বিকৃত মস্তিষ্ক, উম্মাদ, পাগল, কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যায়।এবং মুশারাকা কারবার পরিচালনায় অযোগ্য বিবেচিত হয়, তাহলে মুশারাকা কারবারের বিলুপ্তি ঘটে।

৫. কারবার সমাপ্তকরণের সময় সকল সম্পদ নগদ আকারে থাকলে তারা নিজ নিজ অংশ অনুযায়ী বণ্টন করে নেবেন।

৬. কারবার সমাপ্তকরণের সময় সম্পদ নগদ অর্থের আকারে না থাকলে সেক্ষেত্রে সকল সম্পদকে নগদে রূপান্তর করতে হবে। অথবা সম্পদ যে অবস্থায় আছে সে অবস্থাতেই বণ্টন করে নিতে হবে। সম্পদ নগদে রূপান্তর করা এবং না করা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হলে সম্পদ নগদে রূপান্তর না করার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে; কিন্তু সম্পদটি ভাগ করা না গেলে যেমন- মেশিনারিজ, তা হলে তা বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ বণ্টন করতে হবে।

৭. যদি কোনো অংশীদার কারবারের বিলোপসাধন করতে চান ও অন্যরা কারবার চালু রাখার পক্ষপাতী হন তখন পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে কারবার চালু রাখা যেতে পারে।

জ. ব্যবসায় বিলুপ্ত না করে
মুশারাকা বিলুপ্ত করা যদি কোনো অংশীদার মুশারাকা বিলুপ্ত করতে চান, অপরদিকে অন্য অংশীদার বা অংশীদারগণ ব্যবসায় অব্যাহত রাখতে চান, তাহলে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে তা করা যেতে পারে। যে সকল অংশীদার ব্যবসায় অব্যাহত রাখতে ইচ্ছুক, তারা বিলুপ্তি কামনাকারী অংশীদারের অংশ ক্রয় করে নিবেন। কেননা, কোনো অংশীদারের মুশারাকা বিলুপ্তি করার অর্থ এটা নয় যে, এই মুশারাকা কারবার অন্যান্য অংশীদারের সাথেও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’

এরূপ ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব বিলুপ্তিকারীর অংশের মূল্য পারস্পরিক আলোচনা ও সম্মতির ভিত্তিতে নির্ধারণ করা জরুরি। যদি উক্ত অংশীদারের মূল্য নির্ধারণে মতবিরোধ দেখা দেয় এবং অংশীদারদের সর্বসম্মতিক্রমে কোনো মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে মুশারাকা প্রত্যাহারকারী অংশীদারি স্বয়ং ব্যবসার পণ্যসামগ্রী (যেভাবে আছে সেভাবেই) বণ্টন করে অথবা পণ্যসামগ্রী বিক্রি করতে তারল্যে রূপান্তরিত করে তার অংশ নিয়ে অন্যান্য অংশীদার থেকে পৃথক হয়ে যেতে পারবেন।

এখানে প্রশ্ন সৃষ্টি হয় যে, মুশারাকায় চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পূর্বে অংশীদারগণ এ শর্তারোপ করতে পারবেন কিনা যে, সকল অংশীদার বা অধিকাংশ অংশীদারের সম্মতি ব্যতীত ব্যবসার সম্পদ বণ্টন কিংবা তরল আকৃতিতে রূপান্তরিত করা যাবে না এবং কোনো একক অংশীদার অংশীদারিত্ব থেকে পৃথক হতে চাইলে তার অংশ অন্য অংশীদারের নিকট বিক্রি করে দিতে হবে। ব্যবসার সম্পদ বণ্টন বা তরল আকৃতিতে রূপান্তরিত করার জন্য তিনি অন্যান্য অংশীদারকে বাধ্য করতে পারবেন না।

ইসলামী ফিকহের গ্রন্থাবলিতে এ প্রশ্নের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে বাহ্যিকভাবে শরী’আহর দৃষ্টিতে এতে কোনো অসুবিধা নেই; বরং অংশীদারগণ মুশারাকা চুক্তির শুরুর লগ্নে এ ধরনের শর্তে আবদ্ধ হতে পারবেন। কোনো কোন হাম্বলী ফকিহ্ এ ধরনের শর্তে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট অনুমতি দিয়েছেন।

এই নতুন শর্তটি বিশেষত আধুনিক প্রেক্ষাপটে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা, বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায় সফলতার জন্য অংশীদারিত্ব অব্যাহত রাখার দাবি করা হয়। শুধু একজন অংশীদারের দাবির প্রেক্ষিতে ব্যবসার সম্পদ তরল আকৃতিতে রূপান্তর বা বণ্টন করার জন্যে অন্য অংশীদারদের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে।

একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে যদি কোনো ব্যবসায় শুরু করা হয় এবং প্রকল্পের যাত্রালগ্নে অংশীদারদের কোনো একজন যদি সম্পদের তারল্য চায়, তাহলে এক্ষেত্রে তাকে বিনা কারণে সম্পদের তারল্য বা বণ্টনের স্বাধীনতা প্রদান করার জন্যে অংশীদারদের উন্নয়নের জন্য এমনিভাবে মারাত্মক ক্ষতি হবে, যেমনিভাবে সমাজের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্যে ক্ষতিকারক হয়। তাই এ ধরনের শর্ত ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *