মূলধন কী, মূলধনের বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলি
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মূলধন বলতে ব্যবসায়ে নিয়োজিত অর্থকে বোঝায়। কিন্তু অর্থনীতিতে মূলধন শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। মানুষের শ্রমের দ্বারা উৎপন্ন সম্পদের যে অংশ সরাসরি ভোগের জন্য ব্যবহার না হয়ে পুনরায় অধিকতর উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয় তাকেই অর্থনীতিতে মূল*ধন বলে। অর্থনীতিবিদ বম-বাওয়ার্ক বলেন, ” মূল*ধন হলো উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান”
এডাম স্মিথ এর মতে, “যে সকল দ্রব্য বা সম্পদ থেকে কিছু আয় উপার্জন করা যায় তাই মুলধন।”
সুইডেনের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ উইকসেলের মতে, “সঞ্চিত শ্রম ও সঞ্চিত প্রাকৃতিক সম্পদের যুক্ত ফলই মূল*ধন ।”
মূলধনের যথার্থ সংজ্ঞা সম্পর্কে যে বিভ্রান্তি দেখা দেয় তা নিরসনের জন্য কেয়ার্নব্রুস (Cairncross) মূলধনের তিনটি রূপ উল্লেখ করেন- (ক) বস্তুগত মূল*ধন , যেমন- উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি; (খ) অর্থকরী মূল*ধন , যেমন- ব্যবসায় বাণিজ্যে নিয়োজিত অর্থ; (গ) ঋণ মূল*ধন যেমন শেয়ার, বন্ড ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য, ভোগ্যদ্রব্য ও উৎপাদক দ্রব্যের মধ্যে কোনোরূপ গুণগত পার্থক্য নেই। একটি দালানকে বাসগৃহ হিসেবে ব্যবহার করা হলে তা ভোগ্যপণ্য, কিন্তু সেখানে যদি কোনো শিল্প -কারখানা স্থাপন করা হয়, তাহলে সেটি মূল*ধন হিসেবে গণ্য হবে।
সুতরাং, বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে যেসব দ্রব্য মানুষের শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত হয়ে আবার অধিক উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় তাকে মূলধন বলে। এ অর্থে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কলকারখানা, গুদামঘর প্রভৃতি হলো মূলধন। আধুনিককালে অর্থ অধিক উৎপাদনে সহায়তা করে। মূল*ধন বলতে উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত মানব সৃষ্ট বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীসহ অর্থের ঐ অংশও মূলধন হিসেবে বিবেচিত হয়, যা অধিক উৎপাদনের জন্য উৎপাদনে বিনিয়োজিত হয়। এজন্য সরাসরি উৎপাদনে বিনিয়োজিত অর্থসহ শেয়ার, ডিবেঞ্চার ও বিভিন্ন ঋণপত্রে নিয়োজিত অর্থও মূল*ধন হিসেবে পরিগণ্য হয়।
মূল*ধন এক প্রকার সম্পদ, যা অধিক উপার্জনে বা আয় সৃষ্টিতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, অনেক সম্পদ আছে যা মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় কিন্তু আয় উপার্জন করে না কিংবা অধিক আয় সৃষ্টি করে না। যে সম্পদ শুধু ভোক্তার জন্য ব্যবহার হয়, তা মূলধন নয়। আবার ব্যবহারভেদে কোনো জিনিসও মূলধন হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে গৃহে ব্যবহারের জন্য টেবিল এবং চেয়ার শুধুই সম্পদ। কিন্তু একজন ব্যবসায়ী যদি তার ব্যবসায়ের কাজে অফিসে ব্যবহারের জন্য টেবিল, চেয়ার ক্রয় করেন, তখন তা মূল*ধন এবং সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে।
মূলধন এর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Capital )
উৎপাদন হলো প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। উৎপাদনের প্রাথমিক উপকরণ হলো শ্রম ও ভূমি এবং উভয় বস্তুগত বিষয়। মূলধনের কতকগুলো লক্ষণীয় দিক বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মূলধনের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
১. মূলধন উৎপাদনের উৎপাদিত উপাদান: উৎপাদনে জমি ও শ্রমিক মৌলিক উপাদান হিসেবে গণ্য হয়। মূল*ধন উৎপাদনের নিরেট মৌলিক উপাদান নয়। তবে মূলধন উৎপাদন ক্ষেত্র থেকেই সৃষ্টি হয়। উৎপাদিত দ্রব্য পুনরায় উৎপাদন কাজে ব্যবহার হলে তা মূল*ধন হিসাবে বিবেচিত হয়। কাজেই প্রকৃতির প্রাথমিক দান হিসাবে মূল*ধন গণ্য হয় না।
২.মূলধন সঞ্চয়ের ফল: উৎপাদন বা আয়ের একটি অংশ যা বর্তমানে ব্যয় হয় না হয়ে, পরবর্তীতে তা সঞ্চয় আকারে উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। সঞ্চিত সম্পদ মূলধন সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। সঞ্চয় বেশি হলে দেশে মূল*ধন গঠনের পরিমাণও বেশি হয়। কারণ সঞ্চয়ের ওপর মূল*ধন গঠন নির্ভর করে।
৩. মূলধন হলো অস্থায়ী উপাদান: জমি স্থায়ী উপাদান। মূলধন ব্যবহারের মাধ্যমে নিঃশেষ হয়। উৎপাদনে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, বাড়িঘর সবই ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সুতরাং, মূলধনকে অস্থায়ী উপাদান বলা যায়।
৪. মূলধনের উৎপাদন ব্যয়: অনেক সময় ভূমির যোগান দাম ধরা হয় না। তাই ভূমির কোনো উৎপাদন ব্যয় নেই মনে করা হয়। কিন্তু মূলধন মানুষের দ্বারা উৎপাদিত এবং পুনরায় উৎপাদন কাজে ব্যবহার হয়। তাই মূলধনের উৎপাদন খরচ অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।
৫. মূলধন গতিশীল: উৎপাদনের অন্যান্য উপাদান অপেক্ষা মূলধন তুলনামূলকভাবে গতিশীল। কারণ মূলধন বিভিন্ন খাতে ব্যবহার যোগ্য এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্থানান্তরযোগ্য।
৬. মূলধন বিভিন্ন বস্তুর জটিল সমষ্টি: মূলধনকে সমজাতীয় দ্রব্য হিসাবে গণ্য করা যায় না। বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়া থেকে মূলধন সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন উৎপাদিত বস্তু একত্র করে যন্ত্রপাতি তৈরি হয়। বিভিন্ন বস্তুর সমষ্টিকরণের মাধ্যমেই মূল*ধন পাওয়া যায়।
৭. মূলধন ভবিষ্যৎ আয়ের উৎস: মূলধন ভবিষ্যৎ আয়ের উৎস হিসাবে কাজ করে। মূল*ধন ব্যবহারের ফলে উৎপাদনের বৃদ্ধি পায় । ফলে তা ভবিষ্যতে অধিক আয়ের পথ সৃষ্টি করে।
৮. মূলধন নিষ্ক্রিয় উপাদান: মূল*ধন নিজে কোনো কিছু উৎপাদন করতে পারে না তাই মূল*ধন হলো নিষ্ক্রিয় উপাদান। মূলধন অমৌলিক উপাদান। শ্রম ছাড়া মূল*ধন সক্রিয় নয়।
৯.অতীত শ্রমের ফল: মূল*ধন হলো অতীত শ্রমের ফল। এটি প্রকৃতি প্রদত্ত ভূমির মতো কোনো উপকরণ নয়। কলকারখানা, যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল প্রভৃতি যা মূলধন হিসাবে বিবেচিত তা অতীত শ্রম দ্বারা সৃষ্ট।
১০. মূলধন সমজাতীয় নয়: মূলধনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, সকল মূলধন সমজাতীয় নয়। বাস্তবে মূল*ধন হলো স্বতন্ত্র ক্রিয়াসম্পন্ন বিবিধ বস্তুর একটি জটিল সমষ্টি। তাই বিভিন্ন মূলধনের মধ্যে গুণগত পার্থক্য রয়েছে এবং তাদের উৎপাদনশীলতাও এক রকম নয়।
মূলধনের কার্যাবলি (Functions of Capital)
আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা প্রধানত মূলধনের ওপর নির্ভরশীল। একসময় মূলধনকে ‘প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি’ (engine of growth) বলা হতো। উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের পার্থক্যের মূলে রয়েছে মূলধনের প্রাপ্যতার পার্থক্য। যে দেশ মূলধনে যত বেশি উন্নত সে দেশ উৎপাদনে তত বেশি উন্নত। উৎপাদন পদ্ধতি জটিল এবং বৃহদায়তন হওয়ায় মূলধনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান উৎপাদন পদ্ধতিতে মূলধন নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সম্পাদন করে:
১. প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার: অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশের সকল সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। খনিজ, বনজ, জলজ সম্পদসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার একমাত্র মূলধনের ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমেই সম্ভব। এ সকল সম্পদ আহরণ, উত্তোলন ও ব্যবহার করতে মূলধন একান্ত প্রয়োজন।
২.অর্থনৈতিক ও সামাজিক বুনিয়াদ গঠন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ও সামাজিক বুনিয়াদ গঠন করা প্রয়োজন। উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ শক্তি, সেচ ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যাংক প্রভৃতি মৌলিক শিল্প কারখানা গঠন করতে মূলধনের একান্ত প্রয়োজন।
৩. শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি: উৎপাদনক্ষেত্রে উন্নতমানের মূলধন ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ে। বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠা ও শ্রমবিভাগ প্রবর্তনের ফলে আমেরিকা, জাপান, জার্মানি প্রভৃতি দেশের শ্রমিকেরা দক্ষতা অর্জন করেছে।
৪. বেকার সমস্যা দূরীকরণ: অধিক হারে মূল*ধন গঠিত হলে দেশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা, রাস্তাঘাট, ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ও বেকারত্ব হ্রাস পায়।
৫. কৃষি ও শিল্পের আধুনিকীকরণ: কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে উন্নত যন্ত্রপাতি ও মূলধনী দ্রব্য ব্যবহারের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন কৌশল আধুনিক হয়।
৬.উৎপাদন বৃদ্ধি: উৎপাদন ক্ষেত্রে উন্নত ও অধিক পরিমাণ মূলধন ব্যবহৃত হলে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। ফলে উৎপাদনও বাড়ে।
৭. উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করে; উৎপাদন ক্ষেত্রে অধিক মূল*ধন ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এজন্য উৎপাদনের গড় ব্যয় কমে যায়। জনসাধারণ কম দামে পণ্য ক্রয় করতে পারে এবং মোট সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায়।
৮. শ্রমবিভাগ প্রবর্তন: অধিক পরিমাণ মূল*ধন ব্যবহৃত হলে উৎপাদন পদ্ধতিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা যায়। ফলে বিভিন্ন অংশের দায়িত্ব বিভিন্ন শ্রমিক শ্রেণির ওপর ন্যস্ত করা যায়।
৯.জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: অধিক মূলধন ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। এ কারণে মজুরি বাড়ে এবং শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
১০. আবিষ্কারের সূচনা করে: শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ফলে শ্রমিকদের অনুসন্ধিৎসা সৃষ্টি হয়। একই যন্ত্র নিয়ে বার বার কাজ করার ফলে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি ও কৌশল আবিষ্কার করতে পারে।
১১. শিল্পোন্নয়ন: শিল্পোন্নয়ন মূলত মূলধনের ওপর নির্ভরশীল। কেননা মূলধনের যোগান বাড়লে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠে
১২. উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা: উৎপাদন ক্ষেত্রে সঠিক মূল*ধন ব্যবহৃত হলে উৎপাদন অবিরাম গতিতে চলতে থাকে এবং উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
সুতরাং, অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলধনের গুরুত্ব অনেক বেশি। আধুনিক ও উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থা প্রসারের জন্য মূল*ধন ব্যবহার অপরিহার্য। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মূলধনের স্বল্পতার জন্যই উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভেঙে উন্নয়ন ঘটাতে মূলধনই একমাত্র হাতিয়ার।