?> সুদ: সুদের পরিচয়, প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস। - Best Information
সুদ

সুদ: সুদের পরিচয়, প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস।

সুদ: সুদের পরিচয়, প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস।

সুদ অর্থনীতির সবচেয়ে পুরনো ও জটিল একটি বিষয়। মিসর, গ্রীস, রোম, ভারতবর্ষ প্রভৃতি এলাকায় প্রাচীনকালে সুদ সম্পর্কে আইন রচনার প্রয়োজন হয়। বেদ, তাওরাত ও ইনজিলে সুদকে একটি সমস্যা হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে। সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটলের মতো প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এবং হিন্দু ও ইহুদি সংস্কারকগণ সুদী কারবারের নিন্দা করেছেন। আল-কুরআনে চারটি পর্যায়ে সুদ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।

আধুনিক অর্থনীতিতেও সুদী কারবার একটি সমস্যা। সুদের হার নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যে বিতর্ক বিদ্যমান রয়েছে, অর্থনীতির আর কোন ক্ষেত্রে এমন মতপার্থক্য দেখা যায় না। ফলে অর্থনীতিতে সুদের অস্তিত্বের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।

 

ইসলামে ‘রিবা’ বা সুদ

‘রিবা’ আরবী ভাষার শব্দ। এর অর্থ হলো বৃদ্ধি, আধিক্য, অতিরিক্ত, স্ফীতি, সম্প্রসারণ ইত্যাদি। ঋণের বিপরীতে সময়ের সাথে যেকোন বৃদ্ধিই হচ্ছে ‘রিবা’। কুরআন মজীদে এ অর্থেই ‘রিবা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে সুদ । যাকে ইংরেজিতে বলে Interest বা Usury |

 

তাফসীরে তাবারী’র তৃতীয় খণ্ডে বলা হয়েছে:

“রিবা হচ্ছে সেই বাড়তি অর্থ যার বিনিময়ে ঋণদাতা ঋণ পরিশোধের সময়টা আরো কিছু দিনের জন্য বাড়িয়ে দেয়।” ইবনুল আরাবী ‘আহকামুল কুরআন’-এর প্রথম খণ্ডে বলেছেন:

“রিবা হচ্ছে সে বাড়তির দাম, যা কোন মালের বিনিময় নয়।

 

 সুদী লেনদেনের বৈশিষ্ট্য

সুদের সংজ্ঞা থেকে সুদী কারবারের ৩টি বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়:

  • ১. ঋণের আসল বৃদ্ধি পাওয়া,
  • ২.সময়ের সাথে সাথে ঋণের আসল বৃদ্ধির সীমা বা পরিমাণ বা হার পরিবর্তন হওয়া,
  • ৩. উক্ত দু’টি উপাদানকে শর্ত হিসেবে গ্রহণ করা।

ঋণ সংক্রান্ত কোন লেনদেনে এ তিনটি বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেলে তা সুদী লেনদেন হিসেবে চিহ্নিত হবে। ঋণের উদ্দেশ্য কিংবা ঋণগ্রহীতার আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণে তাতে কোন ব্যতিক্রম হবে না।

 

‘রিবা’র বা সুদ এর প্রকারভেদ

ইসলামী শরীয়াহ্ অনুযায়ী ‘রিবা’ বা সুদ দুই ধরনের। যথা

১. ‘রিবা নাসিয়া’ ও

২. ‘রিবা দল’।

 

 রিবা নাসিয়া

সাধারণত ঋণের ক্ষেত্রে ‘রিবা নাসিয়া’র উদ্ভব হয়। ঋণের ওপর সময়ের ব্যবধানের প্রেক্ষিতে পূর্বনির্ধারিত অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করলে তা হবে ‘রিবা নাসিয়া’। ঋণদাতা কোন অর্থ বা পণ্য ঋণ হিসেবে দেয়ার বিনিময়ে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সময়ের ব্যবধানে পূর্বনির্ধারিত হারে বা পরিমাণে ঋণ বাবদ দেয়া অর্থ বা পণ্যের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করলে তাকে বলা হয় “রিবা নাসিয়া’।

 

ধরা যাক, ক খ-কে ১০০ টাকা এক বছরের জন্য এই শর্তে ধার দেয় যে, এক বছর পর খ উক্ত ১০০ টাকার সাথে অতিরিক্ত আরও ২০ টাকা ফেরত দেবে। তাহলে এই অতিরিক্ত কুড়ি টাকা হবে রিবা নাসিয়া’। এভাবে ঋণদাতা যদি ঋণগ্রহীতাকে ১০০ কেজি লবণ এই শর্তে ধার দেয় যে, ছয় মাস পর ঋণগ্রহীতা ১২০ কেজি লবণ ফেরত দেবে, তাহলে এই অতিরিক্ত ২০ কেজি লবণ হবে ‘রিবা নাসিয়া’।

 

 রিবা ফদল

সমজাতীয় দ্রব্য হাতে হাতে বিনিময়ের ক্ষেত্রে ‘রিবা ফদল’-এর উদ্ভব হয়। কোন দ্রব্যের সাথে একই জাতীয় দ্রব্য বাড়তি পরিমাণ বিনিময় করলে দ্রব্যের উক্ত অতিরিক্ত পরিমাণকে ‘রিবা ফদল’ বলা হয়। যেমন, এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সাথে দুই কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা হলে নিম্নমানের খেজুরের ঐ অতিরিক্ত এক কেজিই হবে ‘রিবা ফদল’। এ ব্যাপারে নবী করীম ($)-এর একটি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হলো:

আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ

“সোনার সাথে সোনা, রূপার সাথে রূপা, গমের সাথে গম, যবের সাথে যব, খেজুরের সাথে খেজুর এবং লবণের সাথে লবণ বিনিময়ের ক্ষেত্রে সমান সমান এবং হাতে হাতে বিনিময় হওয়া উচিত। এরূপ বিনিময়ে যে বেশি বা কম দেয় বা নেয়, সে সুদী কারবার করে। এক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই সমান।”

হযরত আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা) আরও বর্ণনা করেছেন : হযরত বিলাল (রা) একবার রাসূলে করীম (58) এর কাছে কিছু উন্নত মানের খেজুর নিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে জিজেস করলেন, তুমি কোথা থেকে এ খেজুর আনলে? বিলাল (রা) উত্তরে বললেন, ‘আমাদের খেজুর খারাপ ছিল। তাই আমি দ্বিগুণ পরিমাণ খারাপ খেজুরের পরিবর্তে ভাল খেজুর বদলিয়ে নিয়েছি। রাসূল (B) বললেন, ‘আহ! এটা তো সুদের মতই হলো, এটা তো সুদের মতই। কখনও এরূপ করো না। ভাল খেজুর পেতে চাইলে প্রথমে তোমার খেজুর বাজারে অন্য দ্রব্যের বিনিময়ে বিক্রি করবে। তারপর সে পণ্যের বিনিময়ে ভাল খেজুর কিনে নেবে।’

 

কোন কোন ফক্বীহর মতে, শুধুমাত্র হাদীসে উল্লেখিত ছয়টি পণ্যের ব্যাপারেই “রিবা ফদল’-এর সীমা নির্ধারিত। কিন্তু অধিকাংশ শরীয়াহ্ বিশেষজ্ঞ মনে করেন হাদীসে উল্লেখিত ক’টি পণ্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হাতে হাতে অন্য যেকোন পণ্য বদলের ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য হবে। উল্লেখ্য যে, “রিবা ফদলে’র বিষয়টি হাদীসের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হয়েছে।

 

ইসলামে সুদ শর্তহীনভাবে নিষিদ্ধ

শরীয়াহ বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মতভাবে একমত যে, ইসলামে সব ধরনের সুদ নিষিদ্ধ। শরীয়ার পর্যালোচনা ও গভীর অনুশীলনের পর তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। এ ব্যাপারে ইসলামী জ্ঞান ও গবেষণা জগতের সকল বিশেষজ্ঞদের অনুমোদন রয়েছে। শরীয়াহ বিশেষজ্ঞদের সকল আন্তর্জাতিক সংস্থা এ ব্যাপারে অভিন্ন ও দ্ব্যর্থহীন রায় বা ফাতওয়া দিয়েছেন। সাধারণভাবে তাঁরা সুদের সংজ্ঞায় বলেছেন, মূল ঋণের ওপর পূর্বনির্ধারিত লাভই ‘সুদ’।

সুদ নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ স্পষ্ট। কোন কোন মহলে অজ্ঞতার কারণে এ ব্যাপারে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। কুরআন-হাদীসের অনুসারী বলে দাবি করার পরও যারা সুদ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন তাদের বক্তব্য মূলত দু’টি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত ।

 

সরল ও নিম্নহারের সুদ

কিছু ধারণা, সরল ও নিম্নহারের সুদের ব্যাপারে ইসলামে নিষেধাজ্ঞা নেই। তাদের মতে, ইসলাম শুধু চক্রবৃদ্ধি বা উচ্চহারের সুদ নিষিদ্ধ করেছে। এই উচ্চ সুদ স্বল্প সময়ের মধ্যে মূলের ওপর দ্বিগুণ চারগুণ হারে বেড়ে যায় ।

এই যুক্তির পক্ষে তারা কুরআন মজীদের সূরা আলে ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে ।

“হে ঈমানদারগণ, এই চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া ত্যাগ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর; আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।”

এই শ্রেণীর লোকেরা আল-কুরআনের একখানা মাত্র আয়াত উদ্ধৃত না করে। সমগ্র কুরআন সামনে রাখলে দেখবেন, মক্কা ও মদীনা মুনাওয়ারায় সময়ের ব্যবধানে চারটি স্তরে সুদ সম্পর্কিত আয়াত নাযিল হয়েছে। প্রতিটি সময়ের একটি রয়েছে। প্রতিবার আয়াত নাযিলের রয়েছে স্বতন্ত্র পটভূমি ও প্রেক্ষাপট। সামগ্রিক বিষয় একসাথে না দেখে, কুরআন থেকে বিধান অনুসরণের সঠিক নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ না করে বিচ্ছিন্নভাবে কোন আয়াত বা তার অংশ উদ্ধৃত করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সুদ সম্পর্কিত সকল আয়াত সামনে রাখলে তারা এ ধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। এছাড়া উদ্ধৃত আয়াত দ্বারাও এ কথা প্রমাণ করা যাবে না যে সরল সুদকে এখানে বৈধ করা হয়েছে। কোন মদখোরকে কেউ যদি বলেন মদের মধ্যে ডুবে থেকো না, তার অর্থ এই নয় যে মদের ওপর ভেসে থাকা যাবে।

পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে :

“পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য (বৈধ)। “(সূরা নিসা : ২৯)

..অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল ও সুদ হারাম করেছেন।…”(সূরা বাকারা : ২৭৫)

এ আয়াত চক্রবৃদ্ধি প্রাসঙ্গিক নয়; বরং সাধারণভাবে সুদের নিষিদ্ধতা ঘোষক। সুতরাং এটাই সুদ হারামের ভিত্তি এবং চক্রবৃদ্ধি সুদ তো ভয়াবহ শোষণ ও বৈষম্যের নির্মাতা হিসেবে আরো ঘৃণ্য, পরিত্যাজ্য।

 

 ভোগ্য ঋণের সুদ বনাম উৎপাদন ঋণের সুদ

কেউ কেউ একথা বলতে চান যে, ব্যবহার্য পণ্য সংগ্রহ বা ভোগ্য ঋণের বেলায় সুদ পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ঋণ গ্রহণ বা উৎপাদন ঋণের বেলায় সুদ নিষিদ্ধ নয়। এই ধারণার পেছনে তাদের যুক্তি হলো, প্রথমত বাণিজ্যিক ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা দিয়ে ব্যবসা করেন লাভের উদ্দেশ্যে। কাজেই তার উপার্জিত লাভ থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়াতে আপত্তির কারণ নেই। তাদের দ্বিতীয় যুক্তি হলো, রাসূলুল্লাহ (16)-এর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেয়া ঋণের বেলায় সুদ গ্রহণ ও প্রদান তাই তাদের যুগে মূলত ভোগ-ব্যয়ের উদ্দেশ্যেই ঋণের লেনদেন হতো। বর্তমান যুগে মতে অবৈধ না হওয়াই যুক্তিযুক্ত। ব্যবসায়িক সুদ বা ব্যাংকিং সুদকে তারা বৈধ বলতে চান। তাদের এ যুক্তি সঠিক নয় এ জন্য যে, ব্যবসায়ে লাভের সম্ভাবনার পাশাপাশি লোকসানেরও ঝুঁকিও থাকে। সুদের কারবারে লোকসানের ঝুঁকি পুরোটাই উদ্যোক্তার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে মূলধনের যোগানদাতা পূর্বনির্ধারিত নিশ্চিত লাভের সুযোগ ভোগ করেন; এটা ন্যায় বিচার হতে পারে না।

 

কুরআন মজীদে সুদ প্রসঙ্গ

সুদ সম্পর্কে কুরআন মজীদের প্রথম আয়াত নাযিল হয় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর মক্কী যুগে ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে। এ আয়াতে বলা হয়েছে

“মানুষের ধন বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা যে সুদ দিয়ে থাকো, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ধনসম্পদ বৃদ্ধি করে না, কিন্তু যে যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য দিয়ে থাকো, তা-ই বৃদ্ধি পায়; তারাই সমৃদ্ধিশালী।”(সূরা রূম : ৩৯)

এ আয়াতে সুদ ও যাকাত সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণার ওপর আঘাত করা হয়েছে। সেকালে সুদখোর পুঁজিপতিরা মনে করত যে, সুদের মাধ্যমে তাদের সম্পদ বাড়ছে এবং যাকাত দিলে বা দান-খয়রাত করলে তাদের সম্পদ কমে যাবে । ঋণগ্রহীতারা মনে করত যে, তাদের কাছ থেকে সুদ খেয়ে ধনীরা তাদের সম্পদ বাড়াচ্ছে। উপরের আয়াতে সুদ ও যাকাত সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ ধারণার প্রতিবাদ করা দ্বিতীয় আয়াত চতুর্থ হিজরী সন বা তার কাছাকাছি সময়ে ইহুদিদের অতীত কীর্তিকলাপ উল্লেখ প্রসঙ্গে নিষ্ঠুর অর্থলোভী ইহুদিদের সুদখোরীর কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বলেন :

“এবং তাদের সুদ গ্রহণের জন্য, যদিও তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং অন্যায়ভাবে লোকের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য, আর আমি তাদের মধ্যে অবিশ্বাসীদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি তৈরি রেখেছি।”(সূরা নিসা : ১৬১)

সুদ সম্পর্কে অন্য বিধান নাযিল হয় সূরা আলে ইমরানে। রাসূলে করীম এর মাদানী যুগে উহুদ যুদ্ধের পর এ আয়াতে বলা হয়েছে:

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা এই চক্রবৃদ্ধি সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।”(সূরা আলে ইমরান : ১৩০)

লক্ষ করার বিষয়, সুদ সংক্রান্ত প্রথম আয়াত নাযিলের প্রায় এগার বছর পর এ সম্পর্কে উপযুক্ত তৃতীয় আয়াত নাযিল হয়। এ সময় মদীনার নাগরিকদের সহযোগিতায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছে। ইসলামী সমাজের উপযোগী আইন-কানুন, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বাস্তবায়নের কাজ তখন শুরু হয়েছে।

সুদ সম্পর্কে আল-কুরআনের সর্বশেষ আয়াত নাযিল হয় মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবন মিশন যখন সম্পূর্ণ হতে চলেছে, সে সময়। উমর (রা) রিবা সংক্রান্ত সূরা বাকারার আয়াতকে রাসূল (সা)-এর ওপর নাযিলকৃত সর্বশেষ আয়াত বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনু আব্বাস বলেন, “শেষ যে আয়াত রাসূল (সা)-এর ওপর নাযিল হয়েছিল তা ছিল আয়াতে রিবা ।

কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা বলেন:

“যারা সুদ খায়, তারা সেই ব্যক্তিরই মত দাঁড়াবে যাকে শয়তান তার স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এজন্য যে, তারা বলে : ক্রয়- বিক্রয় তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল ও সুদকে হারাম করেছেন। যার কাছে তার রবের এ নির্দেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, তবে অতীতে যা হয়েছে তা তারই; এবং তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারে। আর যারা আবার আরম্ভ করবে, তারাই জাহান্নামী। সেখানে তারা স্থায়ী হবে।”(সূরা বাকারা : ২৭৫)

“আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-খয়রাতকে বাড়িয়ে দেন। • আর আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপীকে ভালবাসেন না।”(সূরা বাকারা : ২৭৬)

“যারা ঈমান আনে, নেক কাজ করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাদের পুরস্কার তাদের রবের কাছে রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই ও তারা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা বাকারা : ২৭৭)

“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর সুদের যা বকেয়া আছে, তা ছেড়ে দাও, যদি তোমরা মুমিন হও।”(সূরা বাকারা : ২৭৮)

“যদি তোমরা না ছাড়ো, তবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। কিন্তু যদি তোমরা তওবা কর, তবে তোমাদের মূলধন তোমাদেরই। এতে তোমরা অত্যাচার করবে না এবং অত্যাচারিতও হবে না”(সূরা বাকারা : ২৭৯)

এভাবে একটি অতি পুরনো ও জটিল অসুখ থেকে সমাজকে মুক্ত করার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা এ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও সহজ পদ্ধতিই অবলম্বন করেছেন।

 

সুদ সম্পর্কে মহানবী (৪)-এর কয়েকটি হাদীস

→ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (s) সুদদাতা ও সুদগ্রহীতা উভয়ের ওপর লা’নত দিয়েছেন। (মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)।

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের চুক্তিপত্রের লেখক ও সাক্ষী সকলের ওপর লা’নত দিয়েছেন এবং বলেছেন, তারা সকলে সমান অপরাধী। (মুসলিম)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সুদভিত্তিক মুদ্রা ব্যবসায়ীদের জাহান্নামের খবর পৌঁছে দিও।(তাবারানী)

→ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সুদের ৭০টি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের অপরাধের পরিমাণ হলো মায়ের সাথে জেনায় (ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া(ইবনে মাজা)

হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা ৭টি নিশ্চিত ধ্বংসকারী বিষয় থেকে আত্মরক্ষা করবে। তার মধ্যে তৃতীয়টি হলো সুদ । (বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, নাসায়ী)

 

সুদ সম্পর্কে বিভিন্ন যুগের মনীষীদের অভিমত সুদ হচ্ছে অর্থনীতির সবচেয়ে প্রাচীন ও জটিল সমস্যা। সুদ শোষণের হাতিয়ার, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মেরুদণ্ড। মানব জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির পথে সুদ প্রধান বাধা। সুদের অভিশাপ থেকে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে মুক্ত করা এবং বিকল্প ব্যবস্থার প্রবর্তন ইসলামী ব্যাংকের প্রধান নীতি ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকৌশল ।

 

সুদের বিরুদ্ধে ইসলামী ব্যাংকের সংগ্রাম নতুন কোন ব্যাপার নয়। মানুষের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সূচনাকাল থেকেই এ লড়াই চালু রয়েছে। মিসর, গ্রীস, রোম ও ভারতবর্ষের মত প্রাচীন সভ্য দেশগুলোতে বহুকাল আগেই সুদ বিষয়ক আইন-কানুন প্রণীত হয়। দুনিয়ার সকল প্রধান ধর্মে সুদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বেদ, তাওরাত, ইনজিল প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থে সুদ সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। রোমান আইনশাস্ত্রে এবং হিন্দু ধর্ম-দর্শনে সুদের নিন্দা করা হয়েছে।

 

ইহুদী সংস্কারকগণ সুদকে নিষিদ্ধ মনে করতেন। ঈসায়ী ধর্মবেত্তা ও পাদ্রীগণ তাওরাত ও যাবুরের বিধান অনুসারে সুদ নিষিদ্ধ করেছেন। সক্রেটিস, প্লেটো ও এরিস্টটলের মতো প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকগণ সুদকে ঘৃণার চোখে দেখেছেন। অর্থকে পণ্যের মতো বেচাকেনা করাকে তাঁরা কৃত্রিম জালিয়াতি কারবার বলে নিন্দা করেছেন।

 

আরবের জাহিলী যুগেও সুদের অর্থকে সাধারণভাবে অপবিত্র মনে করা হতো। ইউরোপীয় দেশগুলোতে ধর্ম ও আইনের চোখে সুদ নিষিদ্ধ ও নীতিবিরুদ্ধ গণ্য হতো। লন্ডনের অধিবাসীরা সুদখোর ইহুদিদের শোষণে ক্ষিপ্ত হয়ে মধ্যযুগে বহু ইহুদিকে হত্যা করেছিল। জনগণের চাপে বাধ্য হয়ে প্রথম এডওয়ার্ড ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেন থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করেছিলেন। সেই সাথে সুদের ব্যবসাকে তিনি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছিলেন।

 

আধুনিককালের একটি নতুন অর্থনৈতিক দর্শনের স্রষ্টা কার্ল মার্কস সুদের ব্যবসায়ীকে ‘বিকট শয়তান’ নামে অভিহিত করেছেন। সুদখোরকে তিনি তুলনা করেছেন ডাকাত ও সিঁদেল চোরের সাথে। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে সুদ শ্রমিক সমাজের ওপর একটি অসহনীয় বোঝা’। এটি ধনীকে আরো ধনী এবং গরীবকে আরো গরীবে পরিণত করে।

 

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা লর্ড কীনস ১৯৩৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দা মুকাবিলার জন্য সুদের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের সম্ভাব্যতা প্রমাণ করে তিনি বলেছেন, এভাবেই পুঁজিবাদী সমাজের অনেক দোষ-ত্রুটি দূর করা সম্ভব। সুদভিত্তিক বিনিয়োগের পরিবর্তে উৎপাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।

 

এ উপমহাদেশে সুদী কারবারের মন্দ প্রভাব সম্পর্কে ভারতের একটি সরকারী কমিশনের (বালুহ কমিশন) রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে:

“অধিকাংশ মানুষ ঋণী হয়ে জন্মায়, ঋণগ্রস্ত অবস্থায় জীবন কাটায় এবং ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই পরপারে পাড়ি জমায়। এমনকি মৃত্যুর পরও উত্তরাধিকারীদের মাথায় সে ঋণের বোঝা চাপিয়ে রাখে।

 

বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই সুদের বিরোধী। সুদের বিরুদ্ধে তারা যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম করেছে। সুদের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ও ঘৃণার পরিচয় এদেশের নানা পুরাণ ও উপাখ্যানে প্রকাশ পেয়েছে। এদেশের নানা লৌকিক বিশ্বাস ও আচরণে জনগণের সুদবিরোধী মনোভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ বিশ্বাস করেন যে, সাত জন সুদখোরের নাম লিখে গরুর গলায় ঝুলিয়ে দিলে সে গরুর ঘায়ের পোকা পড়ে যায়।”

 

সন্দেহ নেই, সুদ সম্পর্কে জনগণের এরূপ মনোভাব তাদের বিশ্বাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। সুদের হিংস্র থাবা তাদেরকে বারবার ক্ষত-বিক্ষত, রিক্ত-নিঃস্ব ও বিপন্ন করেছে। এ অভিজ্ঞতা সুদ সম্পর্কে তাদের বোধ ও বিশ্বাসের শিকড় দৃঢ় করেছে। এদেশের বহু জননায়ক মহাজনী সুদের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে জনগণের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন । আধুনিককালের প্রাতিষ্ঠানিক সুদের বিরুদ্ধে এবং সুদভিত্তিক লেনদেনের ব্যাপারে এদেশের মানুষের নেতিবাচক মনোভাব স্থায়ী ও অবিচল ।

 

সুদের অভিশাপে পৃথিবীর মানুষ আজ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আধুনিক দুনিয়ার শক্তিশালী ব্যাংকব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সুদ সমাজে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যকে দ্রুত বাড়িয়ে তুলছে। সম্পদ ও দায়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টিতে সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থা পালন করছে দক্ষ ও কুশলী ভূমিকা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সুদের গুরুভার কঠিন দুরবস্থার সৃষ্টি করেছে। সুদের এ অভিশাপ মুকাবিলায় বিশ্বব্যাংক ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো বিকল্প ব্যবস্থা উদ্ভাবনের চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৮৪ সালে ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় স্বীকার করা হয়েছে যে, সুদের উচ্চহারই বিশ্বের সর্বত্র উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে।

 

আধুনিক পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের বিকাশের অনেক আগে ইসলাম সুদের অপকারিতা সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থিত করেছে। সুদকে আল- কুরআনে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আল্লাহ ও রাসূল (সা)-এর পক্ষ থেকে উচ্চারণ করা হয়েছে যুদ্ধের ঘোষণা।

 

সুদ নিষিদ্ধ করার সাথে সাথে ইসলাম আর্থিক কায়-কারবারের হালাল বিকল্প- ব্যবস্থা তুলে ধরেছে। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা ইসলামের এ নির্দেশনার আলোকে আর্থিক ক্ষেত্রে সুদের বিকল্প ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করছে। ইসলামী ব্যাংক তার কোন লেনদেনে সুদ গ্রহণ বা প্রদান করে না। সুদের বিকল্প হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে ক্রয়-বিক্রয় ও লাভ- লোকসান অংশীদারী নীতির ভিত্তিতে। আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে সুদমুক্ত করার লক্ষ্যে সুদের বিকল্প ব্যবস্থা প্রবর্তন ইসলামী ব্যাংকের একটি প্রধান নীতি ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ।

 

ইসলামী বিনিয়োগ ব্যবস্থার ফলে উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় লাভ-লোকসান বিবেচনা করা হয় না। পূর্ব-নির্ধারিত হারে সুদ আদায় করা হয়। সুদসহ আসল আদায় না হওয়া পর্যন্ত তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ঋণগ্রহীতা সুদের জালে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে সে রিক্ত, নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়।

 

সুদভিত্তিক পদ্ধতি সমাজের আয়ের ক্ষেত্রে অসমতা সৃষ্টি করে। সম্পদ-বণ্টন প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা। সম্পদ ও দায়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক অগ্রগতির ধারাকে করে তোলে বিপর্যন্ত। জনগণের স্বভাব- প্রকৃতি, চাহিদা, তাদের বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের পরিপন্থী এ ব্যবস্থা মানবজাতির জন্য বহু অকল্যাণের জন্ম দিয়েছে।

 এ অবস্থার মুকাবিলায় ইসলামী ব্যাংক সুদ সম্পূর্ণ বিলোপ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *