নির্দেশমূলক বা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কাকে বলে(Command or Socialistic Economy),এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
নির্দেশমূলক বা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এর প্রবক্তা হলেন কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেলিন, স্ট্যালিন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর লেলিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রের গোড়াপত্তন হয়। এরপর ১৯২৩ সালে NEP (New Ecohomic Policy)-এর মাধ্যমে মূলত সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। তারপর। ১৯৩০ সালে স্ট্যালিন রাশিয়ায় মার্কসীয় অর্থনীতির মাধ্যমে ‘Stalinist Growth Model’ নামে Planned বা Command বা Socialistic Economy
চালু করেন। বর্তমানে সেখানে উত্ত আদলের অর্থনীতি চালু নেই এবং ১৯৮৫ সালে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে। নির্দেশমূলক বা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা হলো এমন এক ধরনের অর্থব্যবস্থা যেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকে এবং সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির পরিবর্তে রাষ্ট্রের এবং উৎপাদিত পণ্য সমাজের মানুষের কাজের পরিমাণ ও যোগ্যতা অনুযায়ী বণ্টিত হয়। Paul Al Samuelson-এর মতে, “সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি হলো এমন এক ধরনের অর্থনীতি যেখানে শ্রম ব্যতীত অন্যান্য উপকরণের মালিকানা সমাজের হাতে থাকে।
রাষ্ট্র বা সরকার কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নীমিতালা প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফলে এ সমাজে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি বিরাজ করে। বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্রে উপকরণের ব্যক্তি মালিকানা নেই। এরূপ অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে কোন কোন দ্রব্য ও সেবা কী পরিমাণে, কোথায় এবং কীভাবে উৎপাদিত হবে তা নির্ধারণ করে। আবার দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সম্পদের বণ্টন এবং উৎপাদিত পণ্য ও সেবার বণ্টন একই কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি’ও (command economy) বলা হয়। রাশিয়া, চীন, কিউবা বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র প্রচলিত হয়। তবে বর্তমানে কিউবা ব্যতীত অন্য কোথাও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এর নেই।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Command Economy)
নির্দেশমূলক বা সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এর প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো
১. বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্রে সম্পদ বা উপকরণের ব্যক্তিমালিকানা নেই, যৌথভাবে সমাজের সকল সদস্য সম্পদের মালিক।
২.সম্পদের মালিকানা রাষ্ট্রীয় বা যৌথভাবে সমাজের, সেজন্য শ্রমিক শ্রেণি শোয়িত হয় না
৩.কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রতিটি পণ্যের দাম নির্ধারিত হয়। তবে চাহিদা ও যোগানের প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়।
৪. ধনতন্ত্রে যেমন ভোক্তাই সর্বেসর্বা বা ভোক্তাই রাজা সমাজতন্ত্রে ভোক্তা এরূপ স্বাধীনতা ভোগ করে না। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রব্য ও সেবা ভোগ করে থাকে
৫.তাত্ত্বিক সমাজতন্ত্রের বণ্টননীতি হলো ‘প্রত্যেকে পাবে তার প্রয়োজন অনুবাদ (to all according to his needs) তবে বাস্তবে সমাজতান্ত্রিক দেশে যে নীতি চালু আছে তা হলো প্রত্যেরে পাবে তার কাজ অনুযায়ী’ (to all according to his works)। রাষ্ট্রের প্রয়োজন এবং সার্বিক উন্নয়ন বিচিত্র্যয় রেখে রেশন কার্ডের মাধ্যমে আয় ও সম্পদ বণ্টন করা হয়।
৬.ধনতন্ত্রের ন্যায় শ্রমের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে শ্রমিকের মজুরি নির্ধারিত হয় না বরং কাজের পরিমাণ ও গুণগত মান অনুযায়ী শ্রমিকের মজুরি প্রদান করা হয়।
৭. উপকরণের মালিকানা সামাজিকভাবে স্বীকৃত হওয়ায় মালিক-শ্রমিক বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। ফলে উৎপাদন শক্তি (productive force) এবং উৎপাদন সম্পর্ক এর মধ্যে কোনো বিরোধ থাকে না।
৮. উৎপাদনের লক্ষ্য মুনাফা অর্জন নয়, বরং সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ অর্জন।
৯. সকল অর্থনৈতিক কার্যকলাপ; যেমন— উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন প্রভৃতি স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত সকল তথ্যের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
১০. মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণসহ বৃদ্ধ বয়সে খাদ্য, চিকিৎসার ব্যবস্থা, বা অন্য যেকোনো কর্মদক্ষতা হারানো প্রভৃতির ঝুঁকি বহন করে থাকে সরকার।
১১. সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা তে মুনাফাভিত্তিক উৎপাদন পরিচালিত হয় না এবং যৌথভাবে সকলেই উৎপাদিত পণ্যের অংশীদার বলে শ্রমিক শোষিত হয় না।
১২. কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নীতি নির্ধারণ ও কার্যক্রম গৃহীত হয় এবং আঞ্চলিক পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করে বলে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
১৩. রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করা হয় বলে অতি বা কম উৎপাদন দেখা যায় না।
১৪. সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এর মূল লক্ষ্য হলো দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে উৎপাদন ও বণ্টন নিশ্চিত করে সর্বাধিক সামাজিক কল্যাণ অর্জন ব্যক্তির স্বার্থে নয় বরং সমাজের স্বার্থে।
একথা সত্য যে, বর্তমান বিশ্বে বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র ও বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কোনোটির অস্তিত্ব নেই। এছাড়াও এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের অপচয় কম হয়, কল্যাণ বৃদ্ধি পায় ফলে মানুষের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়।