মিশ্র অর্থব্যবস্থা (Mixed Economy) কী,এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
বর্তমানে বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্র বা বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র পৃথিবীর কোথাও নেই। কোনো কোনো দেশে ধনতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য এবং কোনো কোনো দেশে সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া প্রায় সকল দেশেই মিশ্র অর্থনীতি বিরাজ করছে। মিশ্র অর্থনীতি হলো এমন এক অর্থব্যবস্থা যা ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের বেশির ভাগ ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্ত। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ Paul A. Samuelson-এর মতে, “মিশ্র অর্থব্যবস্থা হলো এমন অর্থব্যবস্থা যে অর্থব্যবস্থায় বাজার অর্থনীতি এবং নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সমন্বয় ঘটে।” অধ্যাপক জে. এফ. র্যাগান এবং এল. বি. থমাস বলেন, “যে অর্থব্যবস্থায় বিশুদ্ধ ধনতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সংমিশ্রণ ঘটে তাকে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বলে। এক্ষেত্রে কিছু সম্পদ ব্যক্তি মালিকানায় এবং অন্যগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকে। অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তসমূহের কিছু বাজারে এবং কেন্দ্ৰীয় কতৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয়।।
সুতরাং এ ধরনের অর্থনীতি দুটি খাতের সহ-অবস্থানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। একটি হলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন খাত, অপরটি হলো ব্যক্তি মালিকানাধীন খাত। এ ধরনের অর্থনীতিতে ব্যক্তি মালিকানা খাত ও রাষ্ট্রীয় মালিকানা খাত পরস্পরবিরোধী নয়— একে অপরের পরিপূরক। মিশ্র অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির অপূর্ণতা পরিহার করে উভয় ব্যবস্থার সুবিধা গ্রহণ করা হয়। আর এ কাজ সম্পাদনের জন্য এ ধরনের অর্থনীতিতে ব্যক্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সহায়ক রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেনসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই মিশ্র অর্থব্যবস্থা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে।
মিশ্র অর্থব্যবস্থা এর বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics of Mixed Economy)
মিশ্র অর্থব্যবস্থা এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ—
১. মিশ্র অর্থব্যবস্থা তে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতা, উন্নত জীবনযাপন প্রভৃতি বজায় থাকে।
২. সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার পাশাপাশি কিছু কিছু শিল্প-কারখানা এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও
উদ্যোগ প্রচলিত থাকে।
৩. ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত উৎপাদন ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে প্রয়োজনবোধে সরকারি বিধি-নিষেধ আরোপ এবং একচেটিয়া ব্যবসার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়।
৪.বাজার অর্থনীতির চাহিদা ও যোগানের সমতার মাধ্যমে দ্রব্য সেবার দাম নির্ধারিত হয়। তবে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্র দাম ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
৫. মিশ্র অর্থব্যবস্থা তে একদিকে ভোক্তার পছন্দ অনুযায়ী যেমন দ্রব্য সেবা উৎপাদিত, ক্রয়-বিক্রয় এবং ভোগ করা হয় তেমনি রাষ্ট্রের প্রয়োজনেও দ্রব্য সেবার উৎপাদন ও দাম নির্ধারিত হয়।
৬. রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা খাত, জনগুরুত্বপূর্ণ খাত, মৌলিক ও ভারী শিল্প-কারখানাসহ আমদানি-রপ্তানি সরকারি মালিকানার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
৭.সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাত বেসরকারি বিনিয়োগে পরিচালিত হয়।
৮. বেসরকারি খাতে উৎপাদকগণ মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ ও উৎপাদন করে থাকে। জনকল্যাণের পাশাপাশি সরকার প্রয়োজনে জনস্বার্থে দ্রব্যমূল্য ও মুনাফা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে
৯. জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন দেশের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুসারে বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রিত ও রাষ্ট্রীয় খাত পরিচালিত হয়।
১০. ব্যক্তি উদ্যোগের ফলে মুনাফার আশায় অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদন হয়। ফলে মুদ্রাস্ফীতিও বিদ্যমান থাকে
১১. ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে। প্রয়োজনে সরকার বেসরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে জাতীয়করণ করে তাকে সরাসরি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসতে পারে কিংবা দেশের স্বার্থে ব্যক্তি উদ্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ভোগ, উৎপাদন ও বণ্টন সংক্রান্ত কাজের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১২. শ্রমিক শ্রেণিকে শোষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য ন্যূনতম মজুরি, কাজের সময়, শ্রম আদালত, শিল্পবিরোধ নিষ্পত্তিসহ তাদেরকে রোগ, দুর্ঘটনা, বেকারত্বের হাত থেকে রক্ষা প্রভৃতি সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সামাজিক বিমা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
১৩. মূল্য ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদন ও বণ্টনের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়। সরকারের রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতি, বাণিজ্যনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে মূল্য ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়।
সুতরাং, মিশ্র অর্থব্যবস্থা তে ব্যক্তিগত ও সরকারি উদ্যোগে অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানের জন্য চেষ্টা করা হয়। মিশ্র অর্থব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ত্রুটিসমূহ হতে মুক্ত একটি উন্নততর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে সমাজের উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন প্রভৃতি ক্ষেত্রে মূল্য প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। সরকার বিভিন্ন নীতি দ্বারা মূল্য প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে অর্থনৈতিক সমস্যাবলির সমাধান সহজতর হয়। তাই ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার কাঠামোতে গড়ে ওঠা ইংল্যান্ড, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও নরওয়েসহ বহু সমাজতান্ত্রিক দেশেও মিশ্র অর্থব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়