?> ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী ও মুসনাদ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী ও মুসনাদ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী ও মুসনাদ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-এর জীবনী ও তাঁর মুসনাদ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ পর্যালোচনা

উপস্থাপনা : হাদীসশাস্ত্রের ইতিহাসে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মুহাদ্দিস হিসেবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) সমধিক খ্যাত। তিনি ছিলেন হাদীসশাস্ত্রের বিজ্ঞ মহামনীষী। হাদীসের ওপর তার ছিল অসামান্য পাণ্ডিত্য। ইলমে হাদীসের এক ব্যতিক্রমধর্মী সংকলক হিসেবে তিনি অমর হয়ে আছেন। তাঁর সংকলিত মুসনাদ গ্রন্থটি হাদীসশাস্ত্রের একটি অনবদ্য সংকলন। নিম্নে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-এর জীবনী ও তাঁর মুসনাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপিত হলো।

 ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এর জীবনী :

১. পরিচিতি : তাঁর পূর্ণনাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল। এই মহান হাদীসশাস্ত্র ও শরীয়াহ বিশেষজ্ঞ ১৬৪ হিজরীর রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে বাগদাদে আরবদের শায়বান গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ এবং হাম্বলী মার্শহাবের প্রতিষ্ঠাতা।

২. হাদীস শিক্ষা অর্জন: ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) হিজরী ১৮৩ সন পর্যন্ত জন্মভূমি বাগদাদে শিক্ষা অর্জন করেন। শৈশবকালেই তিনি ইমাম আবু ইউসুফ (র)-এর মজলিসে শরীক হন। বাগদাদ নগরীতে তাঁর হাদীসের উস্তাদগণের মধ্যে হুশাইম ইবনে বশীর ইবনে আবু হাযম (মৃত্যু ১৮৩ হিজরী)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর খেদমতে তিনি একাধারে ৪ বছর অবস্থান করেন। এ সময় তিনি বাগদাদের অপর মুহাদ্দিস ওমায়ের ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে খালেদ (র) হতে বিপুলসংখ্যক হাদীস শ্রবণ করেন। তাঁর অন্য উস্তাদগণের মধ্যে আবদুর রহমান ইবনে মাহদী ও আবু বকর ইবনে আইয়াম (র)-এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে ।

৩. হাদীস সংকলনে বিশেষ সফর : হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি মুসলিম জাহানের সবকটি শহর ও অঞ্চল সফর করেন। ১৮৬ হিজরীতে বিদেশ সফরের শুরুতে তিনি বসরা গমন করেন। তারপর তিনি হেজাযে উপস্থিত হন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ইয়েমেন কৃষ্ণা শহরেও গমন করেন। বসরা ও হেজাযে পাঁচ বার সফর করেন। এসব সফরের মাধ্যমে তিনি বহুসংখ্যক হাদীস সংগ্রহে সমর্থ হন। দীর্ঘ সফর শেষে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি ইমাম শাফেয়ী (র)-এর নিকট থেকে ফিকহ ও উসুলে ফিকহ শিক্ষা লাভ করেন ।

৪. হাদীস সংগ্রহের মূলনীতি : হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের ব্যাপারে তিনি একটি মূলনীতি অনুসরণ করতেন। তা হলো, হাদীস লিখে নেয়া। তিনি তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তির ওপর একান্তভাবে নির্ভর না করে হাদীসসমূহ কাগজে লিখে নিতেন। হাদীস বর্ণনার সময়ও মুখস্থ না বলে কাগজের পাতা উল্টিয়ে সেখান থেকে পাঠ করে বর্ণনা করতেন।

৫.  হাদীস শিক্ষাদান : তিনি ছিলেন সমকালীন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস। এ যুগের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁর নিকট হতে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাঁর হাদীসের ছাত্রদের মধ্যে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম শাফেয়ী, আবদুর রাজ্জাক, ওয়াকী (র) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম শাফেয়ী (র) হাদীসের সত্যতা নির্ণয়ে ইমাম আহমদের ওপর পূর্ণ মাত্রায় আস্থাশীল ছিলেন।

ইন্তেকাল : ইলমে হাদীসের এ মহান সেবক ২৪১ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই বাগদাদে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদের হারবিয়া এলাকার মার্কাবিরুশ শুহাদায় তাঁকে দাফন করা হয়।

 

মুসনাদে আহমদ সংকলনের ইতিহাস : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) কর্তৃক সংকলিত মুসনাদকে বলা হয় ইলমে হাদীসের বিশ্বকোষ। নিম্নে মুসনাদে আহমদের সংকলন ইতিহাস সংক্ষেপে উদ্ধৃত হলো

১.প্রাথমিক সংকলন : ইমাম আহমদ (র) মাত্র ১৬ বছর বয়সে হাদীস সংকলন শুরু করেন। তিনি হাদীস অধ্যয়নকাল হতেই হাদীস মুখস্থ করার সাথে সাথে লিখে নিতেন। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল হাদীসের বিশাল এক ভাণ্ডার গড়ে তোলার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে এক অনন্য হাদীস গ্রন্থ উপহার দেয়া। আর এ লক্ষ্যে পরিচালিত তাঁর সংকলন অভিযান শেষ পর্যন্ত এক বিরাট পাণ্ডুলিপিতে পরিণত হয়।

২.পুনঃসংযোজন: ইমাম আহমদ (র)-এর বাসনা ও সাধনা সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই তাঁর আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়ে তিনি তাঁর সন্তান ও পরিবারের লোকদেরকে সমবেত করে তাঁর বিরাট সংকলনটি পড়ে শোনান। অতঃপর তা স্বতন্ত্র ও পরিচ্ছন্নভাবে লিখে দেন। তিনি তা ছাঁটাই বাছাই করে গ্রন্থবদ্ধ করে যেতে সক্ষম হননি ।তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ এবং আবু বকর আল কাতিয়ী এ গ্রন্থে অনেক হাদীস সংযোজন করেন। এভাবে মুসনাদ গ্রন্থটি সংকলন সম্পন্ন হয় ।

৩.মুসনাদে আহমদে হাদীস সংখ্যা : الحلة في ذكر الصحاح الستة গ্রন্থকারের বর্ণনা মোতাবেক মুসনাদে আহমদে মূলত ত্রিশ হাজার হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছিল।অতঃপর তাঁর পুত্রের সংযোজনের ফলে শেষ পর্যন্ত হাদীস সংখ্যা দাঁড়ায় চল্লিশ হাজার। কারো কারো মতে, এ গ্রন্থের মোট হাদীস সংখ্যা চল্লিশ হাজার, কিন্তু পুনরাবৃত্তি বাদ দিলে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ত্রিশ হাজার।

 

জামিই এর পরিচয় :

আভিধানিক অর্থ : আরবি জামিই শব্দটি আল জামু মাসদার হতে ইসমে ফায়েল এর একবচন, এর আভিধানিক অর্থ- সংগ্রহকারী, সন্নিবেশকারী, একত্রকারী, সংগঠক।

পারিভাষিক সংজ্ঞা : যেসব হাদীস গ্রন্থে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের আলোকে হাদীসের অধ্যায়, পরিচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়, তাকে জামিই বলা হয় । যেমন

১.  নবীচরিত।

২.  কুরআনের তাফসীর।

৩.  আকাইদ (বিশ্বাস)।

৪. তথা ফেতনা-বিপর্যয়।

৫. পানাহারের আচার।

৬. । আহকাম (আদেশ নিষেধ ও ব্যবহারশাস্ত্র)।

৭. কেয়ামতের আলামতসমূহ ।

৮.   সাহাবাচরিত।

 

আভিধানিক অর্থ :মুসনাদ শব্দটির ইসমে মাফউল  মূলশব্দ সনদে জিনসে ছহিই অর্থ— সনদযুক্ত, সম্পর্কযুক্ত।

পারিভাষিক সংজ্ঞা : যেসব গ্রন্থে সাহাবীগণ হতে বর্ণিত হদীসসমূহ তাঁদের নামের আক্ষরিক ক্রমিকতার ভিত্তিতে পর পর সংকলিত হয়, ফিকহের প্রণয়ন পদ্ধতিতে অধ্যায় বিন্যাস করা হয় না, তাকে আল মুসনাদ বা আল মাসানীদ বলা হয়।

আল মুসনাদে সাহাবীগণের ক্রমতালিকায় দু’ভাবে হাদীস বর্ণনা করা হয়। যথা- সাহাবীগণের নামের প্রথম অক্ষরের পর্যায়ক্রমে অথবা তাঁদের মর্যাদাগত অবস্থার পর্যায়ক্রমে হাদীস সংকলন করা হয়। যেমন

১. প্রথম নিয়মে প্রথমে আবু বকর (রা), অতঃপর উসামা (রা) এভাবে আক্ষরিক পর্যায়ক্রমে।

২. আবার দ্বিতীয় নিয়মে প্রথমে খোলাফায়ে রাশেদুন বর্ণিত হাদীস, অতঃপর অন্য সাহাবায়ে কেরাম বর্ণিত হাদীস।

 

মুসনাদ গ্রন্থসমূহের মধ্যে মুসনাদে আহমদ, মুসনাদুল হুমাইদী, আল মুসনাদুল কাবীর ইত্যাদির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

উপসংহার : হাদীস সংকলক মুহাদ্দিসীনে কেরামের তালিকায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কসম একটি নাম। ইলমে হাদীস ও ফিকহশাস্ত্রের ইতিহাসে তাঁর অবদান। চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন ইসলামের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের অন্যতম । ইমাম আহমদ (র) তাঁর সুনান গ্রন্থ প্রসঙ্গে বলেন

علمت هذا الكتاب إماما إذا اختلف الناس في سنة عن رسول الله (ص ) رجع إليه .

 

আরো জানুন: ইমাম আবু দাউদ (র)-এর জীবনী ও তাঁর সুনান গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *