?> মালিকানায় অংশীদারিত্ব বা হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ক
মালিকানায় অংশীদারিত্ব

মালিকানায় অংশীদারিত্ব বা হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ক

মালিকানায় অংশীদারিত্ব বা হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ক(Higher Perches under Shirkatul Milk)

মালিকানায় অংশীদারিত্ব বা হায়ার পারচেজ অন্ডার শিরকাতুল মিল্ক হলো এক বিশেষ সমন্বিত চুক্তি। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এ পদ্ধতির উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে এটি

১. মালিকানায় শরিকানা,

২. ইজারা ও

 ৩. বিক্রি- এ তিন চুক্তির সমন্বয় ।

 

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর শরী’আহ কাউন্সিলের মতে, “মালিকানার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হায়ার পারচেজ (হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক বা ইজারা বিল বাই’ তাহতা শিরকাতুল মিলক) শরী’আহসম্মত একটি বিনিয়োগ পদ্ধতি ।এ পদ্ধতির তিনটি মৌলিক বিষয় হলো-

 

. শিরকাতুল মিলক : শিরকাত শব্দের অর্থ অংশীদারিত্ব। কোনরূপ চুক্তি (লাভ- লোকসানের ভিত্তিতে ব্যবসায় করার চুক্তি) ব্যতীত দুই বা ততোধিক ব্যক্তির কোনো বস্তুতে অংশীদার বা মালিক হওয়াকে ‘শিরকাতুল মিলক’ বলা হয়। অন্যকথায়, চুক্তিবদ্ধ না হয়ে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কোনো সম্পত্তির মালিক হলে তাকে শিরকাতুল মিল্‌ক বলে।

 

. ইজারা : আরবি ‘আজর’ এবং ‘উজরাত’ শব্দ হতে ‘ইজারা’ পরিভাষাটি উদ্ভূত। ইজারা শব্দের শাব্দিক অর্থ- প্রতিদান, আয়, মজুরি, ভাড়া ইত্যাদি। ইজারা এমন এক ধরনের চুক্তি সেখানে ভাড়াদাতা ও ভাড়গ্রহীতা দুটি পক্ষ থাকে। এ পদ্ধতিতে ভাড়াগ্রহীতা সুনির্দিষ্ট প্রতিদান বা ভাড়া প্রদানপূর্বক ভাড়াদাতার মালিকানাধীন সম্পদ থেকে সুবিধা ভোগ করে।

 

. বিক্রয় : বিক্রয় হলো ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে চুক্তি। এ চুক্তির মাধ্যমে বিক্রেতার মালিকানাধীন কোনো নির্দিষ্ট পণ্য বা সম্পদ নির্ধারিত মূল্য নগদ/অগ্রিম বা ভবিষ্যতে পরিশোধের শর্তে ক্রেতার মালিকানায় ন্যস্ত হয়।

 

তিন চুক্তির সমাহার

“হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক’ পদ্ধতিকে ব্যাংক ও গ্রাহক উভয় পক্ষ-

প্রথমত, সম বা অসম পুঁজি বিনিয়োগ করে কোনো সম্পদ (ভূমি, দালান, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ইত্যাদি) কিনে যৌথভাবে সে সম্পদের ওপর মালিকানা লাভ করেন। তারা উক্ত সম্পদের আয় পূর্বনির্ধারিত হারে ভাগ করে নেন। আর্থিক ক্ষতি হলে উভয় পক্ষ পুঁজির অনুপাতে তা বহন করেন।

 

দ্বিতীয়ত, এরূপ সম্পদে ব্যাংক তার অংশ গ্রাহকের কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট হারে ভাড়া দেয়।

 

তৃতীয়ত, ব্যাংক তার অংশ কিস্তিতে বা এককালীন নির্ধারিত মূল্যে ভাড়াকালীন সময়ব্যাপী বা ভাড়া চুক্তির শেষে গ্রাহকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করে।

 

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর ম্যানুয়েলে ‘হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্‌ক’ সম্পর্কে বলা হয়েছে-

এ পদ্ধতিতে ব্যাংক ও গ্রাহক চুক্তির ভিত্তিতে যৌথভাবে যানবাহন, মেশিন ও যন্ত্রপাতি, ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি ক্রয় করে। গ্রাহক ভাড়ার ভিত্তিতে তা ব্যবহার করেন এবং ব্যাংকের অংশের মূল্য কিস্তিতে পরিশোধ করে পর্যায়ক্রমে তার মালিকানা অর্জন করেন। পণ্য বা মালামাল ক্রয়ের আগে এর প্রকৃত মূল্য, মাসিক ভাড়া, ব্যাংকের অংশের মূল্য, পরিশোধের সময়সীমা ও কিস্তির পরিমাণ এবং জামানতের প্রকৃতি প্রভৃতি নির্ধারণ করে চুক্তি সম্পাদিত হয়।

 

বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো ব্যাংক এই বিনিয়োগ পদ্ধতিকে ‘হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক’ বা ‘HPSM’ হিসেবে অভিহিত করে। তবে এক্সিম ব্যাংকে এ পদ্ধতির নাম ইজারা বিল বাই’ বা ‘IBB’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি ‘আল ইজারা আল মুনতাহিয়াতু বিত তামলীক’ বা Ijarah Muntahi হিসেবে পরিচিত ।

 

মালিকানায় অংশীদারিত্ব ইসলামী শরীআহর দলিল (Evidence of Islamic Shariyah)

 

হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক হলো শিরকাতুল মিলক, ইজারা ও বিক্রয় এ তিন চুক্তির সমাহার। নিচে এ তিন চুক্তি সম্পর্কে শরী’আহর দলিল উপস্থাপন করা হলো-

 

. শিরকাতুল মিলক সম্পর্কে দলিল

 

আল্লাহ তাআলা আল-কুরআনে ইরশাদ করেছেন,

فَهُمْ شُرَكَاهُ فِي القُلت

অর্থাৎ “তারা তিন ভাগের এক ভাগের মধ্যে সম-অংশীদার হবে।  মহানবী মুহাম্মদ (সা.) নির্দেশিত বহু হাদীস থেকে মুশারাকা কারবারের বৈধতা প্রমাণিত হয়। মুশারাকা কারবার সম্পর্কে হাদীসে কুদসী রয়েছে ।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَفَعَهُ قَالَ: إِنَّ اللهَ يَقُولُ: اَنَا ثَالِثُ الشَّرِيكَيْنِ مَا لَمْ يَخْنُ أَحَدُهُمَا صَاحِبَهُ، فَإِذَا خَانَهُ خَرَجْتُ مِنْ بَيْنِهِمَا

অর্থাৎ, “হযরত আবু হুরাইরা (রা.) মহানবী (সা.)-এর নাম করে বললেন, তিনি বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা বলেন, দু’জন অংশীদারের (অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কোনো ব্যবসায় করলে তাদের) সাথে আমি (আল্লাহ) তৃতীয় জন হয়ে থাকি যতক্ষণ না তাদের একজন তার অপর সাথি (অংশীদার) এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা খিয়ানত করে। আর যখনই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন আমি সেখান থেকে বের হয়ে আসি ।

 

. ইজারা সম্পর্কে দলিল

 

কুরআনের বাণী,

وَإِنْ أَرَدْتُمْ أَنْ تَسْتَرْضِعُوا أَوْلَادَكُمْ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِذَا سَلَّمْتُمْ مَا أَتَيْتُمُ بِالْمَعْرُونِ

অর্থাৎ, “আর যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদের অন্য কারো থেকে দুধ পান করাতে চাও, তাহলেও তোমাদের কোনো পাপ হবে না, যদি তোমরা বিধি মোতাবেক তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দাও

 

হাদীসের বাণী,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: قَالَ اللهُ: ثَلاثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ القِيَامَةِ: رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ، وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَاكَل ثَمَنَهُ، وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ

“আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম সা. থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে ফরিয়াদী হব। এক লোক, যে আমার নামে শপথ করে ওয়াদা করেছে অতঃপর সে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। আর এক লোক, যে কোনো স্বাধীন লোককে বিক্রয় করে তার মূল্য খেয়েছে। আর এক লোক, যে কোনো লোককে মজুর নিয়োগ করেছে অতঃপর তার কাছ থেকে যথাযথভাবে কাজ আদায় করে নিয়েছে কিন্তু তার পারিশ্রমিক আদায় করেনি।  আল্লামা ইবন রূশদ তার বিদায়াতুল মুজতাহিদ নামক গ্রন্থে বলেন, ইজারা এ দেশের ও প্রথম যুগের সমস্ত ফকিহর মতে বৈধ।

 

গ. বিক্রয় সম্পর্কে দলিল ইসলাম সুদের স্থলে ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ করেছে, এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য দলিল রয়েছে-

 

মহান আল্লাহ বাণী,

وَاحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الربا

অর্থাৎ, “আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় বা বেচা-কেনাকে বৈধ করেছেন এবং সুদকে অবৈধ করেছেন।

عَنْ صَالِحِ بْنِ صُهَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ثَلَاثُ فِيهِنَّ الْبَرَكَةُ، الْبَيْعُ إِلَى أَجَلٍ، وَالْمُقَارَضَةُ، وَأَخْلَاطُ الْبُرِ بِالشَّعِيرِ. لِلْبَيْتِ لَا لِلْبَيْعِ

অর্থাৎ, “হযরত সালেহ বিন গুহাইব (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তিনটি জিনিসে বরকত রয়েছে; বাকি বেচাকেনা, মুদারাবা এবং বিক্রয়ের উদ্দেশ্য ব্যতীত খাওয়ার জন্য গমের সাথে যব মেশানো।”

উপরোক্ত দলিলসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক এর তিনটি চুক্তি শিরকাতুল মিলক, ইজারা ও বিক্রয় ইসলামী শরী’আতে বৈধ। তাই হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক ইসলাম সম্মত

 

মালিকানায় অংশীদারিত্ব হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্এর বৈশিষ্ট্য (Characteristic of Higher perches under Sharkatul Milk)

১. গ্রাহক তার চাহিদা অনুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট সম্পদ ক্রয়ের ইচ্ছা জানিয়ে ব্যাংকের কাছে আবেদন করেন। ব্যাংকের মঞ্জুরি লাভের পর গ্রাহক তার অংশের পুঁজি বা ইক্যুইটি ব্যাংকে জমা করেন। গ্রাহকের এই টাকার সাথে ব্যাংক তার অংশের টাকা যোগ করে সম্পদের পুরো দাম পরিশোধ করে।

২. এরূপ সম্পদ ক্রয়ের আগে মোট দাম, মাসিক ভাড়া, ব্যাংকের অংশ, পরিশোধের সময়সীমা ও কিস্তির পরিমাণ, জামানতের ধরন প্রভৃতি নির্ধারণ করে পক্ষগণের মধ্যে চুক্তি হয়।

৩. ব্যাংক যৌথ মালিকানাধীন এ সম্পদে তার নিজের অংশটি গ্রাহকের কাছে চুক্তির শর্ত অনুসারে ভাড়া দেয়।

 ৪. গ্রাহক নির্ধারিত ভাড়া ও ব্যাংকের অংশের মূল টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করেন।

৫. গ্রাহকের কিস্তি পরিশোধের ফলে সম্পদে ব্যাংকের মালিকানার অংশ কমতে থাকে । গ্রাহকের মালিকানা সে অনুপাতে বাড়তে থাকে ।

৬. গ্রাহকের মালিকানা বাড়ার সাথে সাথে ব্যাংকের প্রাপ্য ভাড়ার পরিমাণ আনুপাতিক হারে কমে আসে।

৭. সম্পদে ব্যাংকের অংশের মূল্য পুরো শোধ হলে গ্রাহক তাতে পূর্ণ মালিকানা লাভ করেন।

৮. মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ব্যাংকের অংশের পুরো দাম শোধ করে গ্রাহক সম্পদের পূর্ণ মালিকানা পেতে পারেন ।

৯. গ্রাহক কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে ব্যাংকের মালিকানার অনুপাত অনুযায়ী ভাড়া অব্যাহত থাকে।

১০. চুক্তির শর্ত পালনে গ্রাহক ব্যর্থ হলে ব্যাংক সম্পদ নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে ।

১১. ভাড়া হিসেবে পাওয়া অর্থ ব্যাংকের আয় । ভাড়ার টাকা মালিকানার অংশের সাথে যুক্ত নয় ।

 

মালিকানায় অংশীদারিত্ব হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিল্ এর প্রধান শর্তাবলি এর শর্তাবলি নিম্নরূপ :

 

১. মূলধন অনুপাতে অংশীদারগণের মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া, যাতে পরবর্তীতে তাদের বা তাদের ওয়ারিশগণের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।

২. ক্রেতাকে তার পরিশোধিত মূল্যের আনুপাতিক মালিকানা ব্যাংক কর্তৃক হস্তাস্ত র করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *