ইসলামী বীমার শর’ঈ ভিত্তি
ইসলামী শরী’আহ আইনের উৎসসমূহ প্রথমত দুই ধরনের।
ক. মুত্তাফাকুন আলাইহি : তথা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস
খ. মুখতালাক কিহ তথা : আমালুস সাহাবা, মাসালেহু মুরসালা, ইজতিহাদ, ইসতেহসান, উরুফ।
ইসলামী বীমা বলতে এমন বীমাকে বুঝায় যা শরী’আহ সমর্থিত। সুতরাং উপরিউক্ত শরঈ আইনের উৎসসমূহের আলোকে ইসলামী বীমার বৈধতা ও যৌক্তিকতা মূল্যায়ন করা হলো :
১. কুরআনী মূলনীতিসমূহ : কুরআনুল কারীমের প্রায় ৫০০ আয়াতে শরী’আহসংক্রান্ত বিধি-বিধান আলোচনা করা হয়েছে। শরী’আহসংক্রান্ত এ আয়াতগুলোতে মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধান দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো বিষয়ের সমাধান সুস্পষ্টরূপে বর্ণিত হয়েছে। আবার কোনো কোনো বিষয়ের সমাধান দেয়া হয়েছে ইংগিতমূলকভাবে। তেমনি একটি বিষয় ইসলামী বীমা। ইসলামী বীমার মাধ্যমে ভবিষ্যতের বিপদ মোকাবিলার জন্যে সঞ্চয়, বিপদে পতিত হলে যথা- গ্রাহকের মৃত্যুতে ইয়াতিম সন্তানাদি ও বিধবা মা-বোনদের এককালীন সহযোগিতা প্রদান, বীমার মেয়াদান্তে লাভসহ মূলধন ফেরত দেয়া হয়। কুরআনুল কারীমের অনেক আয়াতে ইসলামী বীমার এ বিষয়গুলোর বৈধতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
২. কর্মস্থলে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ : আল্লাহ তা’আলা দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরয করে দিয়েছেন। এ সালাত আদায়ের পর উপার্জনের জন্যে জমিনে ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থাৎ, “তারপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।”
খ. ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্যে সঞ্চয় করা : দুনিয়ার জীবন পরিচালনার জন্যে সম্পদের প্রয়োজন। আবার আকস্মিক বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখে কেউ পতিত হলে তা হতে উদ্ধারের জন্যে গচ্ছিত সম্পদের প্রয়োজন। তাই ভবিষ্যৎ দুর্যোগ মোকাবিলার জন্যে বর্তমান সঞ্চয় হতে একটি অংশ খরচ না করে জমা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মিশরের রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে সবাই অপারগ হলে রাজা ইউসূফ (আ)-এর কাছে এর ব্যাখ্যা চান। ইউসুফ (আ) স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও করণীয় জানিয়ে দেন। এ বিষয়ে মহান রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা,
يُوسُفُ أَيُّهَا الصِّدِيقُ اَفْتِنَا فِي سَبْعِ بَقَرَاتٍ سِمَانٍ يَأْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌ وَسَبْعِ سُنبُلَاتٍ خُضْرٍ وَأُخَرَ يَابِسَاتٍ لَعَلّي اَرْجِعُ إِلَى النَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَعْلَمُونَ . قَالَ تَزْرَعُونَ سَبْعَ سِنِينَ دَابًا فَمَا حَصَدْتُمْ فَذَرُوهُ فِي سُنْبُلِهِ إِلَّا قَلِيلًا مِمَّا تَأْكُلُونَ . ثُمَّ يَأْتِي مِنْ بَعْدِ ذَلِكَ سَبْعٌ شِدَادٌ يَأْكُلْنَ مَا قَدَّمْتُمْ لَهُنَّ إِلَّا قَلِيلًا مِمَّا
تُحْصِنُونَ
অর্থাৎ, “হে ইউসূফ! হে সত্যবাদী! সাতটি মোটাতাজা গাভীকে সাতটি শীর্ণ গাভী খাচ্ছে এবং সাতটি সবুজ শীষ ও অন্যগুলো শুষ্ক, আপনি আমাদের এ স্বপ্ন সম্পর্কে পথনির্দেশ করুন; যাতে আমি তাদের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের অবগত করতে পারি। ইউসূফ (আ) বললেন, তোমরা সাত বছর উত্তমরূপে চাষাবাদ করবে। অতঃপর যা কাটবে, তার মধ্যে যে সামান্য পরিমাণ তোমরা খাবে তা ছাড়া অবশিষ্ট শস্য শীর্ষ সমেত রেখে দিবে। অতঃপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর, তোমরা এ দিনের জন্য যা রেখেছিলে, তা খেয়ে যাবে; কিন্তু অল্প পরিমাণ ব্যতীত, যা তোমরা তুলে রাখবে। “
গ. যেকোনো ধরনের কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা করা : কল্যাণকর ও তাকওয়াপূর্ণ কাজে সহযোগিতা করা এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজে সহযোগিতা না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআনুল কারীমের এ নির্দেশটি আম (ব্যাপক)। তাই পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যেকোনো ক্ষেত্রে এ নির্দেশ প্রযোজ্য। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
অর্থাৎ, “সৎকর্ম ও তাকওয়াপূর্ণ কাজে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা।”
ঘ. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে: নিহতের পরিবারকে দিয়াত প্রদান অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হলে নিহতের পরিবারকে দিয়াত বা রক্তমূল্য প্রদান করার মাধ্যমে আর্থিকভাব সহযোগিতা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিহত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনা যেহেতু কোনোভাবেই সম্ভব নয়; সেহেতু অন্তত রক্তমূল্য পরিশোধ করলে এ বিপদের মাঝে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি নিজ পায়ে দাঁড়ানোর একটি অবলম্বন খুঁজে পাবে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَنْ يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَأَ وَمَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَأً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ إِلَّا أَنْ يَصَّدَّقُوا فَإِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ عَدُةٍ لَكُمْ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَإِنْ كَانَ مِنْ قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ فَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ وَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ فَمَنْ لَمْ يَجِدُ فَصِيَامُ شَهْرَيْنِ مُتَتَابِعَيْنِ
অর্থাৎ, “কোনো মুসলমানের উচিত নয় অপর মুসলমানকে হত্যা করা; কিন্তু ভুলক্রমে হলে তা ভিন্ন কথা। যে মুসলমান ব্যক্তি অপর মুসলমানকে ভুলক্রমে হত্যা করে সে একজন মুসলমান ক্রীতদাস আজাদ করবে এবং তার স্বজনদের রক্তমূল্য প্রদান করবে; কিন্তু যদি তারা ক্ষমা করে দেয় তা ভিন্ন কথা। অতঃপর যদি নিহত ব্যক্তি তোমাদের শত্রু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়, তবে মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করবে এবং যদি সে তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোনো সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়, তবে রক্ত বিনিময় সমর্পণ করবে তার স্বজনদেরকে এবং একজন মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করবে, যদি সে দাস না পায়, তবে অনবরত দু’মাস রোযা রাখবে।
ঙ. উত্তরাধিকারীদের নিঃস্ব অবস্থায় রেখে না যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দান : অসহায়, দুর্বল ও নিঃস্ব অবস্থায় উত্তরাধিকারীদের না রেখে সচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়া উত্তম। কারণ দারিদ্র্য মানুষকে কুফুরীর দিকে টেনে নিয়ে যায়। পেটে প্রচুর ক্ষুধা নিয়ে নামাযে দাঁড়ালে নামাযের প্রতি মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। আবার ক্ষুধার নিদারুণ কষ্ট হতে বাঁচার জন্যে মানুষ অনেক সময় অসৎ পন্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلْيَخْشَ الَّذِينَ لَوْ تَرَكُوا مِنْ خَلْفِهِمْ ذُرِّيَّةٌ ضِعَافًا خَافُوا عَلَيْهِمْ فَلْيَتَّقُوا اللَّهَ
وَلْيَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا
অর্থাৎ, “তাদের ভয় করা উচিত যারা নিজেদের পশ্চাতে দুর্বল-অক্ষম সন্তান- সম্প্রতি ছেড়ে গেলে তাদের জন্যে তারাও আশঙ্কা করে; সুতরাং তারা যেন আল্লাহকে ভয় করে এবং সংগত কথা বলে।
চ. অভাবগ্রস্ত ও নিঃস্বদের সাহায্য প্রদান : ঈমান আনার পর নামায কায়েম ও যাকাত আদায় করা যেমন ইসলামী শরী’আতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক ইবাদত, তেমনি মৌলিক ইবাদাত হলো, আত্মীয়স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন ও সাহায্যপ্রার্থীদের সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা করা। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
لَيْسَ البران تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَأَتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ
অর্থাৎ, “সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমে মুখ করে ইবাদত করবে, বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফিরিশতাদের ওপর এবং সমস্ত নবী-রাসূলের ওপর আর সম্পদ ব্যয় করবে তারই মহব্বতে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে । ৮২
জ. যে দলবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে বলা হয়েছে : পারস্পরিক সহযোগিতা ও দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انْفِرُوا جَمِيعًا
অর্থাৎ, “হে ঈমানদারগণ! সতর্কতা অবলম্বন কর; অতঃপর দলে দলে বিভক্ত হয়ে। অগ্রসর হও অথবা একসাথে অগ্রসর হও।”
ঝ. নিজের উন্নতির লক্ষ্যে চেষ্টা–প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা : মানুষকে মহান আল্লাহ বিবেক দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আর তার সিদ্ধান্ত নিতে কুরআন ও সুন্নাহ দিয়েছেন। সুতরাং মানুষ তার উন্নতির লক্ষ্যে শরী’আহসম্মত উপায়ে চেষ্টা-প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ اللهَ لَا يُغَيْرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيْرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ
অর্থাৎ, “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে। “
আলোচ্য কুরআনী মূলনীতিগুলো দ্বারা বীমাব্যবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এগুলো হতে সংশয়, ঝুঁকি, শান্তি স্থাপন, পারস্পরিক সাহায্য ইত্যাদি দিক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, যা ইসলামী বীমার মূলভিত্তিস্বরূপ ।
২. হাদীসে রাসূল (সা.) : কুরআনুল কারীমে উল্লিখিত আয়াতের পাশাপাশি রাসূলে আকরাম (সা.) অসংখ্য হাদীসে ভবিষ্যতের জন্যে সঞ্চয়, বিপন্ন মানতার কল্যাণে এগিয়ে আসা, ইয়াতীম ও বিধবাদের পুনর্বাসন প্রভৃতি বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। রাসূলে আকরাম (সা.)-এর হাদীসও ইসলামী বীমার শর’ঈ উৎস হিসেবে ইসলামী চিন্তাবিদদের গবেষণার দ্বার উন্মোচন করেছে।
নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলো :
ক. আকীলার বিধান : রাসুলুল্লাহ (সা.) মৃত ব্যক্তির রক্তপণ তাঁর বংশীয় উত্তরাধিকারীদেরকে পরিশোধের বিধান দিয়েছেন। আর এর মাধ্যমে আকীলার বিধান শরী’আহসম্মত হয়। হাদীসের বাণী-
أَنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: اقْتَتَلَتِ امْرَأَتَانِ مِنْ هُذَيْلٍ، فَرَمَتْ إحْدَاهُمَا الأُخْرَى بِحَجَرٍ فَقَتَلَتُهَا وَمَا فِي بَطْنِهَا، فَاخْتَصَمُوا إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَضَى أَنَّ دِيَةَ جَنِينِهَا غُرَةٌ، عَبْدٌ أَوْ وَلِيدَةٌ، وَقَضَى أَنَّ دِيَةَ المَرْأَةِ
عَلَى عَاقِلَتِها .
অর্থাৎ, “হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হুযাইল গোত্রের দুই মহিলা পরস্পরের সাথে ঝগড়া করার সময় তাদের একজন আরেকজনকে লক্ষ করে একটি পাথর নিক্ষেপ করে। এতে আক্রান্ত মহিলা এবং তার গর্ভস্থ শিশু নিহত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এ ঘটনার বিচার চাওয়া হলে তিনি বলেন, গর্ভস্থ শিশুর দিয়াত হবে শক্তি-সামর্থ্য ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসী এবং ঘাতকের পক্ষ থেকে তার পৈত্রিক আত্মীয়- স্বজনরা এ মূল্য পরিশোধ করবে এবং নিহতের পুত্র ও তার অন্যান্য উত্তরাধিকারীরা এটা পাবে ।
খ. উত্তরাধিকারীদের নিঃস্ব করে রেখে যাওয়া অনুচিত : কোনো পিতা-মাতার জন্যই উচিত নয় তার সন্তানদের নিঃস্ব করে রেখে যাওয়া। কারণ সন্তানদের নিঃস্ব করে রেখে গেলে তারা অন্যের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হবে। তাই প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত সৎভাবে উপার্জন করে উত্তরাধিকারীদের জন্য কিছু সম্পদ রেখে যাওয়ার চেষ্টা করা। রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন,
إِنَّكَ أَن تَدَعَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَدَعَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ فِي أَيْدِيهِمْ، وَإِنَّكَ مَهمَا انْفَقْتَ مِنْ نَفَقَةٍ، فَإِنَّهَا صَدَقَةٌ، حَتَّى اللُّقْمَةُ الَّتِي
تَرْفَعُهَا إِلَى فِي امْرَأَتِكَ
অর্থাৎ, “তোমাদের উত্তরাধিকারীদের নিঃস্ব, পরমুখাপেক্ষী ও অপরের ওপর নির্ভরশীল করার চেয়ে স্বচ্ছল, ধনী করে রেখে যাওয়া উত্তম এবং তুমি যা কিছু খরচ করবে, তা সাদাকা হিসেবে পরিগণিত হবে। এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে তুমি যে লোকমা তুলে দাও তাও সাদাকার অন্তর্ভুক্ত।”
গ. মুমিনদের বিপদাপদে সাহায্য করার নির্দেশ : কোনো মুসলমান বিপদে পতিত হলে তাকে সাহায্য করা এবং তার বিপদ লাঘবে চেষ্টা করার জন্যে অপর মুসলমান ভাইদের উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। যে ব্যক্তি অপর মুসলমান ভাইয়ের বিপদ লাঘবে চেষ্টা করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন কঠিন বিপদের সময় সে ব্যক্তিকে সাহায্য করবেন। রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন,
المُسْلِمُ أخو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلا يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةٍ أَخِيهِ كَانَ اللَّهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةٌ، فَتَجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ القِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ القِيَامَةِ
অর্থাৎ, “মুমিনরা পরস্পর ভাই। সে তার অন্য কোনো মুমিন ভাইয়ের ওপর যুলুম করে না এবং অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেয় না। আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার অভাব পূরণ করবেন। আর যে ব্যক্তি তার কোনো মুমিন ভাইয়ের বিপদ দূর করে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার বিপদ দূর করবেন।
সাহাবায়ে কিরাম যুদ্ধের ময়দানে চরম অর্থনৈতিক সংকটে থেকেও অপর মুসলমান ভাইয়ের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّ الأَشْعَرِنِينَ إِذَا أَرْمَلُوا فِي الغَزْهِ، أَوْ قَلَّ طَعَامُ عِيَالِهِمْ بِالْمَدِينَةِ جَمَعُوا مَا كَانَ عِندَهُمْ فِي ثَوْبِ وَاحِدٍ ثُمَّ اقْتَسَمُوهُ بَيْنَهُمْ فِي إِنَاءٍ وَاحِدٍ بِالسَّوِيَّةِ، فَهُمْ
مِنِّي وَأَنَا مِنْهُمْ
অর্থাৎ, “আশ’আরী সম্প্রদায়ের লোকদের যুদ্ধাভিযানে যখন তাদের খাবার। নিঃশেষ হয়ে যায় অথবা মদীনায় তাদের পরিবারের খাদ্যের পরিমাণ কমে যায় তখন তাদের নিকট যার যা আছে তা একটি কাপড়ে একত্রিত করেন। অতঃপর একটি পাত্রে করে পরস্পর সমানভাবে বণ্টন করে নেন। অতএব তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত এবং আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত।
উক্ত হাদীসে পরস্পর সাহায্য-সহযোগিতার বাস্তব উদাহরণ পেশা করা হয়েছে। যে, তারা বিপদের মুহূর্তে তাদের প্রত্যেকের নিকট কম-বেশি যা ছিল তা তারা একত্রিত করেছিলেন। অথচ তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তি ছিল যার কিছুই ছিল না। পুনর্বণ্টনে তারা সকলে সমান অংশ লাভ করেন।
ঘ.ইয়াতিমের পুনর্বাসনে উৎসাহ প্রদান : ইয়াতিমের পুনর্বাসনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্যে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। যারা ইয়াতীমের পুনর্বাসনে চেষ্টা করবে, ইয়াতিমের ভরণ-পোষণের জন্য চেষ্টা করবে, তাদের সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহ তায়ালা বাড়িয়ে দিবেন। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন,
أنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ كَهَاتَيْنِ فِي الْجَنَّةِ
অর্থাৎ, “আমি এবং ইয়াতিমের লালন-পালনকারী জান্নাতে এরূপ অবস্থায় থাকব- একথা বলে তিনি শাহাদাত ও মধ্যমা আঙুল একত্রিত করে ইঙ্গিত প্রদান করেন।
ইসলামী বীমার মাধ্যমে মৃত্যুবরণকারী গ্রাহকের ইয়াতিম সন্তানদের যে মৃত্যুদাবী পরিশোধ করা হয়, তা তাদের পুনর্বাসনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে।
ঙ. বিধবা মহিলাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ : আমাদের সমাজে বিধবা মা-বোনেরা চরমভাবে নিগৃহীত হন। তাদের পুনর্বাসনে ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। বিধবা মা- বোনদের পুনর্বাসনে যারা চেষ্টা করে তারা মুজাহিদের ন্যায় মর্যাদাবান বলে হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন,
السَّاعِي عَلَى الأَرْمَلَةِ وَالمِسْكِينِ كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوِ القَائِمِ اللَّيْلَ
الصَّائِمِ النَّهَارَ
“বিধবা ও মিসকীনদের পুনর্বাসনের জন্যে যারা চেষ্টা করে, তারা দ্বীন কায়েমের জন্যে জিহাদের ময়দানে চেষ্টা সাধনা করার ন্যায় কিংবা সারারাত ইবাদতকারী এবং সারাদিন রোযা পালনকারীর ন্যায় মর্যাদাবান।
বীমা ব্যবসায় পরোক্ষভাবে বিধবা মহিলাদের পুনর্বাসনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। কারণ কোনো ব্যক্তি বীমা করার পর মারা গেলে যে মৃত্যুদাবি পরিশোধ করা হয়, তা সে ব্যক্তির বিধবা স্ত্রীকে স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ।
চ. সম্পদের একটি অংশ উত্তরাধিকারীদের জন্যে রাখার নির্দেশ : কোনো ব্যক্তি ধন-সম্পদ ইসলামের পথে উৎসর্গ করতে চাইলে সমুদয় সম্পদ দান না করে একটি অংশ তার নিজের এবং পরিবার-পরিজনের জন্য রেখে দেয়া কর্তব্য। এ বিষয়ে হাদীসে বলা হয়েছে, “কা’ব হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি নিবেদন করলাম,
يَا نَبِيَّ اللهِ إِنَّ مِنْ تَوْبَتِي أَنْ لَا أُحَذِتَ إِلَّا صِدْقًا، وَأَنْ أَنْخَلِقَ مِنْ مَالِي كُلِهِ صَدَقَةً إِلَى اللهِ وَإِلَى رَسُولِهِ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَمْسِكَ عَلَيْكَ بَعْضَ مَالِكَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ
অর্থাৎ, “হে আল্লাহর রাসূল! আমি আমার তওবার পূর্ণতা এভাবে সাধন করতে চাই যে, সর্বদা সত্য কথা বলব এবং আমার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদ আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে সাদাকা করে দিব। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তরে বলেন, কিছু সম্পদ অবশ্যই তোমার মালিকানায় থাকা দরকার। এর মাঝেই তোমার কল্যাণ এবং ফায়দা নিহিত রয়েছে।’
মূলত এ হাদীসগুলোর মাধ্যমেই ইসলামী রীমার পদ্ধতি স্বীকৃত। এগুলো দ্বারা তাবারুহ ফান্ড, ঝুঁকি মোকাবিলায় সঞ্চয় ও আকীলার বিধান দ্বারা বীমার কিয়াস ইত্যাদি সাব্যস্ত হয়।
৩. কিয়াসের মূলনীতি : বর্তমানে সারা বিশ্বে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের পাশাপাশি সলিম রাষ্ট্রগুলোতে যে বীমাব্যবস্থা চালু রয়েছে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর আমলে সে রকম কোনো বীমাব্যবস্থা ছিল না। তবে বিপদে পতিত ব্যক্তিকে কিংবা তার পরিবারবর্গকে সাহায্য করার প্রচলন রাসূলুল্লাহ (সা.) চালু করেন যা আধুনিক বীমাব্যবস্থার অনুরূপ। আর এরূপ ব্যবস্থা এর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ২ শরী’আহর মূলনীতির সাথে প্রচলিত প্রথাসমূহ সাংঘর্ষিক না হলে তা ইসলামে গ্রহণযোগ্য৷ তাই প্রচলিত বীমাব্যবস্থার অনুরূপ প্রাচীন প্রথাসমূহ রাসূলুল্লাহ (সা.) অনুমোদন দিয়েছেন।
ক. আকীলার সাথে কিয়াস : গোত্রীয় প্রথা হিসেবে ‘আকিলা প্রথা থেকে বীমাব্যবস্থার সূত্রপাত হয়েছে যা প্রাচীন আরবের সামাজিক ও গোত্রীয় ঐতিহ্য হিসেবে প্রচলিত ছিল। আরব গোত্রগুলোর মধ্যে প্রথা ছিল যে, কোনো গোত্রের কোনো সদস্য ভিন্ন গোত্রের সদস্যের হাতে নিহত হলে হত্যাকারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিহতের উত্তরাধিকারীকে রক্তমূল্য পরিশোধ করতে হতো। যারা হত্যাকারীর
পক্ষ হতে রক্তমূল্য পরিশোধ করত বলা হতো আকীলা ।
আকীলা পদ্ধতির আধুনিক রূপ হচ্ছে তাকাফুল বা ইসলামী বীমা। ভুলক্রমে হত্যার কারণে যে ত বা রক্তমূল্য হত্যাকারীর পক্ষ হতে নিহতের পরিবারের সদস্যদের দেয়া হয় তার সমর্থন কুরআনুল কারীমেও পাওয়া যায়। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَنْ يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَاً وَمَنْ قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَأً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ وَدِيَةٌ مُسَلَّمَةٌ إِلَى أَهْلِهِ
অর্থাৎ, “যদি কেউ কোনো মু’মিন ব্যক্তিকে ভুলক্রমে হত্যা করে তাহলে দণ্ডস্বরূপ তাকে একজন মু’মিন ক্রীতদাস মুক্ত করতে হবে এবং নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের নিকট দিয়াত পৌঁছাতে হবে।৯৪ বলতে রক্তমূল্য বোঝানো হয়েছে। এই হে আদায়ের দায়িত্ব আরব সমাজের প্রাচীন প্রথানুসারে আকিলা তথা হত্যাকারীর নিজ গোত্রের পুরুষ ও আত্মীয়-স্বজনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ইসলাম এ প্রথাকে অনুমোদন দেয়ায় ২১ আদায়ের দায়িত্ব আকিলার ওপর অর্পিত হয়।
দেয়ার দায়িত্ব আকীলার ওপর ন্যস্ত করায় স্বাভাবিকভাবে মনে হয় একজনের অপরাধের দায়িত্ব অন্যের ওপর চাপানো হচ্ছে। অথচ কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে,
وَلَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ إِلَّا عَلَيْهَا وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى অর্থাৎ, “প্রত্যেক মানুষ যা-ই উপার্জন করবে, তা তারই ওপর বর্তাবে এবং কোনো বোঝা বহনকারীই অন্য কারো বোঝা বহন করবে না।”
প্রকৃতপক্ষে আকীলার ওপর ২১ দেয়ার দায়িত্ব পারস্পরিক সহানুভূতি এবং একের দুঃখ ও বিপদ সকলে ভাগ করে নেয়ার মূলনীতির ভিত্তিতে অর্পিত হয়েছে। একজনের কৃত অপরাধে অন্যদের দায়ী করার জন্য নয়। কারণ দিয়াত দেয়ার মূল দায়িত্ব হত্যাকারীর ওপরই বর্তাবে। তবে আত্মীয়তার যে হক পরস্পরের প্রতি রয়েছে دية আদায়ের মাধ্যমে তা আরো সুদৃঢ় হয় ।
দেয়ার দায়িত্ব যে আকীলার তার কারণ হিসেবে বলা যায়, এ জরিমানা যদি হত্যাকারী নিজ থেকেই আদায় করতে বাধ্য হয় এবং এর ফলে সে দারিদ্র্যতার মাঝে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, তা হলে সে পরিবারে চরম বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হবে। কেননা এক ব্যক্তির দারিদ্র্য আশঙ্কা গোষ্ঠীবদ্ধ সমস্ত লোকেরা দারিদ্র্য আশঙ্কার তুলনায় অনেক বেশি।
রাসূলে আক্রাম (সা.)-এর আমলে বীমাব্যবস্থার উন্নয়নে দু’টি নজির পাওয়া যায়। প্রথমত, প্রাচীন আরবের আকীলা প্রথাকে রাসূলে আকরাম (সা.) গ্রহণ করে নিহতের পরিবারকে ২১ প্রদানের দায়িত্ব হত্যাকারীর গোত্রের পুরুষ সদস্যদের ওপর ন্যস্ত করেন।” রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বেশকিছু হাদীস থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার হুযারল গোত্রের দুই মহিলার ঝগড়ার সময় একজনের পাথরের আঘাতে অপর মহিলা ও তার গর্ভের শিশুটি নিহত হয়। নিহতের উত্তরাধিকারীরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে বিচার প্রার্থী হন। রাসূলুল্লাহ (সা.) রায় দিলেন, “গর্ভস্থ শিশুর জন্যে একটি ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসী এবং নিহত মহিলার রক্তমূল্য হত্যাকারীর আকীলাকে প্রদান করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ৬২২ সালে রাসূলে আকরাম (সা.) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। সে সময় মদীনায় মুহাজির, আনসার, ইহুদি ও খ্রিস্টান ও চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। রাসূলে আকরাম (সা.) সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার ।
প্রদান করে একটি লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করেন। এ সংবিধানের ৩টি ধারায় এক ধরনের সামাজিক বীমা প্রবর্তন করা হয়েছিল, ১০০ যা নিম্নরূপ :
খ. দিয়াতের অনুশীলনের মাধ্যমে বা রক্তমূল্য পরিশোধ করার দায়িত্ব: হত্যাকারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের ওপর না রেখে চুক্তিবদ্ধ সকল গোত্র আকিলা প্রথা অনুসারে যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে রক্তমূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করেন।
গ. মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে : বন্দীদের মুক্ত করার জন্য সংবিধানে একটি ধারা প্রণয়ন করা হয়। এতে বলা হয়, যুদ্ধের সময় শত্রুর হাতে কেউ বন্দি হলে, বন্দির আকীলা তাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করার জন্যে মুক্তিপণের অর্থ প্রদান করবে। ১০২ এ ধরনের চাঁদাকে এক ধরনের সামাজিক বীমা হিসেবে অভিহিত করা যায়। চুক্তিতে বলা হয়, “কুরাইশ মুহাজিররা দায়ী থাকবে মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যমে বন্দিদের মুক্ত করার জন্যে, যাতে কল্যাণকর ও ন্যায়বিচারের নীতি অনুসারে ঈমানদারদের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এছাড়া বিধানটি সে সময় মদীনায় বসবাসরত বনূ আউফ, বনু হারিস, বন্ নাজ্জার, বনূ জুসাম এবং অন্যান্য গোত্রের মধ্যেও প্রযোজ্য হয়। এ সংবিধানে উল্লেখ করা হয়, অভাবী, অসুস্থ ও দরিদ্রদের প্রয়োজনীয় সাহায্যের জন্যে সমাজ পারস্পরিক সমঝোতামূলক একটি যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
ঘ. মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত : কুরআনুল কারীমের উল্লিখিত আয়াত এবং রাসূলে আকরাম (সা.)-এর বাণীসমূহের আলোকে বিংশ শতাব্দীতে চিন্তাবিদদের মাঝে ইসলামী বীমা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে এ সময় বেশকিছু কনফারেন্সও অনুষ্ঠিত হয়। আধুনিক ইসলামী বক্তৃতা-বিবৃতির পাশাপাশি ইসলামী বীমার ওপর প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেন। বীমার বৈধতার বিষয়ে ১৯৮৫ সালে ২২-২৮ ডিসেম্বর ও.আই.সি.-এর মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী শীর্ষক সেমিনার জেদ্দায় অনুষ্ঠিত হয়।
সে সেমিনারে ইসলামী বীমা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনার পর নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
১. বাণিজ্যিক বীমা, যেগুলোতে কোম্পানী একই পরিমাণের প্রিমিয়াম বহাল রাখার মাধ্যমে লেনদেন করে, তাতে চুক্তি অবৈধ হবার বড় কারণ বা ধোঁকা যেগুলো শরী’আহর দৃষ্টিতে হারাম।
২. বিকল্প চুক্তি, যাতে ইসলামী লেনদেনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। তাহলো অনুদান ও সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সহযোগিতামূলক বীমা চুক্তি। আর এরূপ চুক্তি বৈধ।
৩. ইসলামী রাষ্ট্রসমূহকে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক বীমা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার জন্যে আহ্বান করতে হবে। তেমনিভাবে সহযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহকে বীমা পদ্ধতি সংস্কার ও নবায়ন করার জন্যে দাওয়াত দিতে হবে, যাতেকরে ইসলামী অর্থনীতি স্বাধীনভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে এবং পুঁজিবাদ হতে মুক্ত হতে পারে।
৪. বীমার বৈধতার বিষয়ে মক্কায় ১৩৯৮ হিজরির ১০ শাবান এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে বিশ্ববরেণ্য আলিম শায়খ আব্দুল আযীয ইবন বায, শায়খ মুহাম্মদ মাহমুদ, শায়খ আব্দুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনে তাঁরা যৌথভাবে যে রায় প্রদান করেন সে সম্পর্কে শায়খ জারকা বলেন, ‘আল-মাজমা’উল ফিকহিল ইসলামী’ সর্বসম্মতিক্রমে বিশেষজ্ঞ আলিমগণ সংস্থার সিদ্ধান্তের সাথে ঐকমত্য হয়েছে যে, ব্যবসায়িক তামীনের পরিবর্তে পারস্পরিক সাহায্যের তামীন বৈধ।
৫. আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা : ১২৮৫ হিজরি মুহররাম মাসে মিশর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত কনফারেন্স আল-মাজমাউল বুহূছিল ইসলামিয়্যাতে সহযোগিতাভিত্তিক বীমার বৈধতা ঘোষণা করে বলা হয়েছে, “যে বীমা কোনো সংগঠন তার সদস্যদের প্রয়োজনীয় সাহায্য সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় তা শরী’আহসম্মত। আর এ ধরনের পদক্ষেপ কল্যাণের পথে সহযোগিতা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে ।
৪. মুসলিম ইজমা : ইসলামী পক্ষে উলামায়ে কিরামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে আধুনিক ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইসলামী বীমার পক্ষে তাদের জোরালো মতামত তুলে ধরেন।
ক. মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ) বলেন, “ইসলামী বীমার কার্যক্রম হলো, কতিপয় এককের মাঝে পরস্পর সহযোগিতার কার্যক্রম। এতে পলিসি ক্রেতা স্বেচ্ছায় বীমা কোম্পানীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে। কোম্পানীর ব্যবসায় বাণিজ্যে উপার্জিত লভ্যাংশের অধিক বা এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ ওয়াকফ করবে, যা দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্যে শরী’আতের মূলনীতির ভিত্তি অনুযায়ী ব্যয় করা হবে।”
খ. ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, “ইসলামী বীমা কোম্পানীতে ইসলাম অনুকূল নিয়ম-নীতি অবলম্বন গ্রহণযোগ্য হবে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী জীবনবিধান মুসলিম জনগণ ও ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন বসবাসকারী লোকদের জন্যে সামষ্টিক ভরণ-পোষণ ব্যবস্থা বা সরকারি অর্থভাণ্ডার তথা বায়তুল মালের সাহায্যে বীমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর করেছে। ইসলামের বায়তুল মাল প্রকৃতপক্ষে জনগণের জন্যে বীমা কোম্পানীই বটে। যারাই তার অধীনে বসবাস করবে তাদের সকলের জন্যেই তা কাজে আসবে । দুর্ঘটনা ও বিপদ-আপদকালে ব্যক্তিদের সাহায্য-সহযোগিতা করার দায়িত্ব ইসলাম গ্রহণ করেছে। কেউ যদি বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে সে সরকারি দায়িত্বশীলের কাছে নিজের সমস্যা পেশ করতে পারে। সরকার সে অনুযায়ী তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মৃত্যুর পর অসহায় উত্তরাধিকারীদের জন্যেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
গ. বিচারপতি মাওলানা মুহাম্মদ তাকী উসমানী বলেন, “প্রচলিত বীমার বিকল্প হিসেবে পারস্পরিক সহযোগিতা ভিত্তিক ইসলামী বীমাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে অংশীদারগণ স্বস্ব ইচ্ছানুযায়ী ফান্ডে টাকা জমা করেন। সারাবছরে যাদের দুর্ঘটনা ঘটে এ ফান্ড থেকে তাদের সাহায্য করা হয়। বছর শেষে টাকা বেঁচে গেলে অংশীদারগণ যোগানের ভিত্তিতে টাকা ফেরত নেবে অথবা আগামী সালের ফান্ডের জন্যে চাঁদা হিসেবে রেখে দেবে। বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের ইসলামী বীমা (তাকাফুল) কোম্পানী চালু হয়েছে যা বৈধ
ঘ. প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মরহুম মাওলানা আবদুর রহীম (রহ) বলেন, ইসলামের সূচনায় ইসলামী সমাজের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে রাসূলে আকরাম (সা.) আকীলার বিধান কার্যকরভাবে চালু করে আধুনিক বীমাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন। অন্য কথায় বলা যায়, রাসুলে আকরাম (সা.)-এর রোপিত বীজের সেই অঙ্কুরই আজকের দিনের বীমা এক বিরাট মহীরূপে পরিণত হয়েছে বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হলো মনে করা যায় না।
ঙ. আল্লামা মুহাম্মদ বিলতাগী বলেন, “বীমাব্যবস্থা যাকাত, সাদাকাত এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালের ওপর অর্পিত আর্থিক দায়-দায়িত্বভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিকল্প কিছু নয়; বরং এটি ইসলামের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থারই একটি অংশ যা সময়ের পরিবর্তনে আজ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার এটি অনিবার্য দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ নীতি শরী’আতে স্বীকৃত হয়েছে। জনকল্যাণের বিষয়টি পরিবর্তনশীল এবং এর কোনো চূড়ান্ত সীমারেখা নির্ধারণ করা যায় না। সুতরাং বলা যায়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘ইসলামী বীমা’ জনকল্যাণের এক নবআবিষ্কৃত পদ্ধতি ।
৫. আ‘মালুস সাহাবা’১১°র মূলনীতি : এ ব্যাপারে মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বলেন, বীমা মূলত আকী’লার বিধান হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। যা দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) এর সময়ে বিস্তৃতি লাভ করে। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) বিভিন্ন জেলায় মুসলিম সৈনিকদের তালিকা (দিওয়ান) প্রস্তুত করার আদেশ দিয়েছেন। ঐ সকল তালিকায় (দিওয়ানে) যাদের নাম থাকত, তারা পরস্পরকে সাহায্য করত এবং তাদের দলের কেউ নরহত্যা করলে তারা সকলেই রক্তের মূল্যের অংশ দানে বাধ্য ছিল। আর এভাবেই হযরত ওমর (রা.) আকীলার বিধান বাস্তবায়ন করেন।
৬. ইজতিহাদ”গত মূলনীতি : মুজতাহিদগণের নয়নমণি ইমাম আবু হানিফা বলেন, আকী’লা শুধু রক্তের সম্পর্কীয় গোষ্ঠীভুক্তদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়; বরং যারা পারস্পরিক কল্যাণ প্রতিষ্ঠা ও আর্থিক দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে তালিকাভুক্ত হয় তাদের ওপরও বার্তায়। এটা অনেকটা ইসলাম গ্রহণের পর এক মুসলমানের ওপর আরেক মুসলমানের হক ও দায়িত্বের মতো। মূলত এ মূলনীতি দ্বারা বীমাব্যবস্থায় ইসলামী বীমা বৈধতা লাভ করে।
৭. উরুফ”“গত মূলনীতি : ইসলামী বীমার আদি ধারণার উৎপত্তি হয় আরব গোত্রীয় প্রথা হতে, যা আকীলা নামে পরিচিত। আর এটি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি বিরোধ মীমাংসা দ্বারা ইসলামে স্বীকৃত। একদিন হুযায়ল গোত্রের দু’জন রমণীর মধ্যে ঝগড়া বাঁধলে তাদের একজন অপরজনকে প্রস্তর দ্বারা তলপেটে আঘাত করায় গর্ভাবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। অচিরেই অন্য রমণীটিরও মৃত্যু ঘটলে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সিদ্ধান্ত দেন যে, রীতি অনুযায়ী তার আত্মীয় বা জ্ঞাতিগণকে নিহত রমণীর আত্মীয়দেরকে রক্তমূল্য প্রদান করতে হবে। এখানে এটি প্রমাণিত যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রাচীন আরবিয় রীতি অনুসারেই উক্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। মূলত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক আকি’লা বিধানের অনুমোদনই হলো ইসলামী বীমা বৈধতার সর্বোত্তম সত্যায়ন।
৮. মাসালিহর মুরসালা গত মূলনীতি : জনচাহিদার আলোকে ইসলামী বীমা প্রয়োজন, কারণ এর দ্বারা অপ্রত্যাশিত ক্ষতি থেকে মানুষ মুক্তি পায়। আর শরী’আত প্রণেতা মানুষের ক্ষতি নিবারণের জন্যেই শরী’আত প্রণয়ন করেছেন। সুতরাং মসালিহ মুরসালার আলোকে ইসলামী বীমা শরী’আহসম্মত।