অগ্নিবিমা ও পুনর্বিমা
ভুমিকা
আগুন বা অগ্নি যে মানুষের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আদিম মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার জানতো না তখন ফল-মূল আর কাঁচা শাক-সতি, মাছ-মাংস খেতো। জীবনের নিরাপত্তার জন্য হিংস্র জন্তু- অ্যানোয়ারের বিরুদ্ধে লড়াই করত পাথর আর গাছের ডাল দিয়ে। পাথরে পাথরে ঘষে আগুন জ্বালানোর পন্থা যখন আবিষ্কার করলো মানুষ তখনই তার মাঝে নতুন সৃষ্টীয় এক অপার আনন্দ ঢেউ খেলে গেলো। রান্না করে খাদ্য-খানা খেতে শিখলো, ভাষাবাদের জন্য লোহাকে গলিয়ে কান্তে- কোদাল বানালো, ফলা, তীর, বর্ষা বানালো, মাটিকে পুড়িয়ে কলসি, বাসন-পড়া বানালো, আর এভাবেই মানুষের মাঝে চেপে বসল নতুন সৃষ্টির উন্মাদনা। আদিম মানুষ সভা হলো । সেই সভ্যতার বিবর্তনের ধারাতেই আজ আমরা সভ্যতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ করার দাবি করছি।
একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা আজ অনেক কিছুই আবিষ্কারের দাবিদার। কিন্তু প্রতিটা আবিষ্কারে, প্রতিটা উৎপাদনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপন বা তাপশক্তির প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন ধাতুর কার্যকর ব্যবহার ও সংমিশ্রণের ফলেই আজ হাজারো পণ্য উৎপাদন হয়েছে। আর এগুলো সম্ভব হয়েছে আগুনেরই কার্যকর ব্যবহারের ফলে। নেহা থেকে ইস্পাত, ইস্পাত থেকে জাহা, গাড়ি, যন্ত্রপাতি সব কিছু আগুনে গলিয়েই তৈরি করা হচ্ছে। লিখতে গিয়ে আমরা যে কাম ব্যবহার করি তাও বাঁশ, বেত, কাঠ ইত্যাদিকে জ্বালিয়ে মত তৈরি করে যা থেকেই বানানো হচ্ছে। প্লাস্টিক, রানার ইত্যাদিকে জ্বালিয়েই তৈরি করা হচ্ছে হাজারো ব্যবহার্য দ্রব্য। আর এভাবেই আগুন সন্ধ্যতার শুরু থেকেই মানুষের পরম বন্ধুতে পরিণত হয়েছে।
কাজের সমুদ্র আগুন মানুষের পরম বন্ধু বিবেচিত হলেও তা কখনও কখনও ভয়াল মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে। সুযোগ পেলেই মুহূর্তে পুড়িয়ে ছাই করেছে মানুষের পরম যত্নে গড়া আবাসস্থল, কল-কারখানা। মুহুর্তে ভস্মীভূত করতেছে তার সকল সহায়-সম্পদ, আগুনের বলি হয়েছে তার আপনজন, আদম সন্তান। সে জন্যই (Lord’ Brooke) আগুনের এক বৈশিষ্ট্যের প্রতি আলোকপাত রে বলেছেন:
“Fire and People doe in this agree They both good servants, both ill master be”
আইনের এ ধরনের রূপের প্রতি আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন, “Fire is a good servant but a hard master ” অর্থাৎ আগুন হলো মানুষের বিশ্বস্ত ভূতা এবং নিষ্ঠুর শাসকও। আগুন সৃষ্টির ও ব্যবহারের কৌশল আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ এর ভাবের রূপেরও পরিচয় পেয়েছে। তাই মানুষ সব সময় সতর্ক থেকেছে । কিন্তু ক্ষণিকের অসতর্কতাই তাকে করেছে ক্ষতিগ্রস্ত। তবু অসতর্ক ব্যক্তিই নয়, আগুনের লেলিহান শিখা ক্ষেত্রবিশেষে। গ্রাস করেছে সমগ্র জনপদ। আগুনের এ বিপন বা ঝুঁকির বিরুদ্ধে কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে মানুষ ভাবলেও এর বিরুদ্ধে সপ্তদশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া সবে হয়নি ।
পঞ্চাদশ শতক থেকে নৌ-বিমার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এ পথ ধরেই অগ্নি থেকে উদ্ভূত ঝুঁকির বিপক্ষে কি করা যায় তা নিয়ে চিন্তার সূত্রপাত হয়েছে। কিন্তু এ চিন্তাকে কার্যকর রূপ দেয়ার বিষয়টা বিশেষভাবে সামনে আসে লণ্ডনে এক বিরাট অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর। ১৬৬৬ সালে লন্ডনে এক ভয়াবহ অগ্নিকা নটে। এই অগ্নিকার একনাগাড়ে চার দিন চার রাত স্থায়ী হয়। এতে লণ্ডনের ৪৩৬ একর এলাকা পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল এবং ১৩ হাজারেরও বেশি দালান-কোঠা ধ্বংস হয়েছিল। ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে জনগণ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অগ্নির বিপন ও এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ব্যাপকতর হয়। ফলে নৌ-বিমা ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আধুরিমার প্রচলন ঘটায়। সর্বপ্রথম সংঘবদ্ধভাবে অগ্নিবিমার ঝুঁকি গ্রহণের জন্য লন্ডনের ‘বৃহৎ অগ্নি’ নামে একটি সংঘ এগিয়ে মাসে।
লন্ডনের নিকোলাস বারবনকে আধুনিক অগ্নিবিমার জনক নামে অভিহিত করা হয়। ১৬৮০ সালে তিনি আগুনের দ্বারা ক্ষতিপ্রাপ্ত দালানের মেরামত বা ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু করেন। তিনি কয়েকজন অংশীদার নিয়ে অগ্নি অফিী (Fire office) নামে একটি রিমা প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। পরে এ কোম্পানি ফিনিক্স (Phoenis) নাম গ্রহণ করে এবং লন্ডনে সাফল্যজনকভাবে অগ্নিবিমা ব্যবসায় পরিচালনা করে। ১৬৮৪ সালে ‘Friendly Society’ নামে এবং ১৬৯৬ সালে Amicable Contributors for Insuring Houses from loss by Fire’ নামে আরেকটি অগ্নিবিমা প্রতিষ্ঠানের জন্ম নেয়া শুরু থেকে দালান-কোঠার জন্য অগ্নিবিমা করা হলেও ১৭০৮ সালে Charles Varry নামক একজন অগ্নিবিমা ব্যবসায়ী পণ্যদ্রব্যের বিপক্ষে এগুণ বিমা ব্যবসায়ের প্রচলন ঘটান। এভাবেই অগ্নিবিমা ব্যবসায় ব্যাপকতা লাভ করে এবং তা জার্মানি, ফ্রান্সসহ ইউরোপের দেশগুলোতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে।
শিল্প বিপ্লবের পর বিমা ব্যবসায় আরও ব্যাপকতা লাভ করে। বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার কারণে আগুন লাগার সম্ভাবনা ও ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দাহ্য পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় আগুনের উদ্ভব ও তা সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য উৎপাদনের ফলে আগুন লাগার শঙ্কা আরও বেড়ে যায়। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধে বোমা বিস্ফোরণে আগুন লেগে যে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয় তার ফলেও অগ্নিবিমা অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এভাবেই বর্তমানকাল অবধি আগুনের ক্ষতির ভয়াবহতা থেকে আর্থিকভাবে রক্ষায় অগ্নিবিমায় হলো মোক্ষম উপায়। আমাদের দেশে যেকোনো কল-কারখানা এমনকি শহরাঞ্চলে দোকান প্রতিষ্ঠা পরিচালনা করতেও অগ্নিবিমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অগ্নিবিমা এর সংজ্ঞা
অগ্নিবিমা হলো অগ্নিজনিত বিপদের ঝুঁকি মোকাবিলার একটি আর্থিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে বিমাকারী নির্দিষ্ট সম্পর্কিতে নির্দিষ্ট প্রিমিয়ারের বিনিময়ে, নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে সংঘটিত চুক্তিপত্রে উল্লেখিত অগ্নিজনিত বিপদের কারণে উদ্ভূত ক্ষতির বিপক্ষে একটি সর্বোচ্চ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণের জন্য বিমাগ্রহীতাকে প্রতিশ্রুতি দেয় । অগ্নিবিমার বিষয়বস্তু হলো স্থাবর ও অস্থাবর উভয় ধরনের সম্পত্তি এবং সেই সাথে বস্তুগত সম্পত্তির সাথে সম্পর্কিত আনুষঙ্গিক ক্ষতিসমূহ নিয়ে অগ্নিবিমার অভিপয় গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো
১.এম. এন. মিশ্র বলেন, “Fire insurance is a device to compensate for the loss consequent upon destruction by fire.” অর্থাৎ অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসের ফলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাই হলো অগ্নিবিমা ।
২. ঘোষ ও আগরওয়ালা-র মতে, “Fire insurance may be defined as a contract whereby one party undertakes in exchange for a premion to indemnify the other against a loss or damage caused to specified property by fire during a particular peril the extent of a. definite sum.” অর্থাৎ অগ্নিবিনা হলো এমন একটি চুক্তি যার মাধ্যমে প্রিমিয়ামের বিনিময়ে একপক্ষ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অগ্নি থেকে উদ্ভূত ক্ষতির ফলে অপরপক্ষকে তার নির্দিষ্ট সম্পত্তির ক্ষতি বা ধ্বংসের জন্য একটি নির্ধারিত সীমা পরিমাণ ক্ষতিপূরণ করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
৩.অধ্যাপক আর. এস., “A fire insurance contrerce mury be defined as an agreement whereby one party in return for a consideration, undertakes to indemnify the other party against financial loss which the latter may sustain by reason of certain defined subject matter being damaged or destroyed by fire or other defined perils upto an agreed amount.” অর্থাৎ অগ্নিবিমা হলো এমন একটি চুক্তি যার আওতায় নির্দিষ্ট কোনো বিষয়- সম্পত্তি অগ্নিজনিত অথবা অন্য কোনো বিপদজনিত কারণে ক্ষতিরও বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে একপক্ষ যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, চুক্তির ফলশ্রুতিতে অপরপক্ষ সেই সম্পত্তি বা চুক্তির দ্বারা নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে ।
৪. বাংলাদেশে বহাল ১৯৩৮ সালের বিমা আইনের ২(৬খ) ধারায় বলা হয়েছে যে, “Fire insurance business means the business of effecting, otherwise than incidentally to some other class of insurance business, contracts of insurance against loss by or incidental to fire or other occurrence customarily included among the risks insured against in fire insurance policies” অর্থাৎ অগ্নিবিমা বলতে এমন এক ধরনের ব্যবসায়কে বুঝায় যা অন্য কোনো ধরনের বিমা ব্যবসায়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত কারণ ছাড়া অগ্নিকারের ফলে ক্ষতির জন্য বা অগ্নিকাণ্ডের আপেক্ষিক কারণে সৃষ্ট ক্ষতির জন্য অথবা অগ্নিবিমাপত্রের যারা সাধারণভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এমন ঝুঁকির বিপক্ষে সম্পাদিত বিমা চুক্তি বিশেষ ।
উপরোক্ত সংজ্ঞা ও আলোচনা থেকে অগ্নিবিমার নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি লক্ষ্য করা যায়
১. অগ্নিবিমা হলো দু’টি পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি
২. এরপ চুক্তির উদ্দেশ্য হলো অগ্নিজনিত ঝুঁকির হাত থেকে বিষাগ্রহীতাকে রক্ষা করা;
আরো জানুন: