হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনে ইমাম মুসলিম (র)-এর অবদান ‘ও সহীহ মুসলিম সংকলনে তাঁর অনুসৃত পদ্ধতি
উপস্থাপনা : যেসব মহান ব্যক্তিত্ব ইলমে হাদীসের খেদমত করে পৃথিবীর জ্ঞানীগুণী মহলে সমাদৃত হয়েছেন, ইমাম মুসলিম (র) তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। স্বীয় অমর সাধনার মাধ্যমে তিনি হাদীসশাস্ত্রের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর সংকলিত সহীহ মুসলিম নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থ হিসেবে সিহাহ সিত্তায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। নিম্নে ইমাম মুসলিম (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী উল্লেখপূর্বক হাদীসশাস্ত্রে তাঁর অবদান আলোচনা করা হলো ।
ইমাম মুসলিম (র)-এর জীবনচরিত :
১. নাম : তাঁর মূল নাম মুসলিম। কুনিয়াত আবুল হোসাইন। উপাধি আসাকিরুদ্দীন । পূর্ণ নাম আবুল হোসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল কুশাইরী আন নিসাপুরী (র)। ইমাম মুসলিম নামেই তিনি খ্যাত ।
২. জন্ম : ইমাম মুসলিম ২০৪ হিজরী মোতাবেক ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের প্রধান নগর নিসাপুরে করেন। তাঁর জন্মসাল সম্পর্কে কোনো কোনো সীরাত প্রণেতা ২০৩ হিজরী সালের কথাও বলে থাকেন।
৩. শিক্ষাজীবন : শৈশবেই ইমাম মুসলিম (র) তাঁর পিতা বিখ্যাত মুহাদ্দিস হাজ্জাজ আল কুশাইরীর নিকট হাদীসের প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তীতে হাদীস শিক্ষার অদম্য বাসনা তাঁকে ইরাক, সিরিয়া, হিজাজ ও মিসরসহ বিভিন্ন হাদীস প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
৪. ইমাম মুসলিমের সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী : ইমাম মুসলিম (র) যেসব মহান শিক্ষকের নিকট থেকে ইলমে হাদীস শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন
- ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র),
- ইমাম বুখারী (র),
- ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া (র),
- সাঈদ ইবনে মানসুর (র) প্রমুখ।
ইমাম বুখারী (র) তাঁর সমকালীন ছিলেন বলে তাঁর নিকট থেকেই তিনি হাদীসের এক বিশাল অংশ আত্মস্থ করেন।
৫. মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব : ইমাম মুসলিম (র) ছিলেন ব্যক্তিত্বে অটল, চরিত্র মাধুর্যে বিরল, আর চেতনায় সমুজ্জ্বল। তাই সমসাময়িক প্রখ্যাত আলেম আবু হাতিম আর রাজী, মুসা ইবনে হারুন, আহমদ ইবনে সালামা, মুহাম্মদ ইবনে মাখরাদ এবং আরো অনেকেই তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা অবনত মস্তকে স্বীকার করেছেন।
৬. ইমাম বুখারীর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা : ইমাম মুসলিম (র) একদা হাদীসের উস্তাদ ইয়াহইয়া আয যাহলীলের নিকট হাদীস গ্রহণকালে উস্তাদ বলেছিলেন, যারা বিশেষ করে মাসয়ালায় ইমাম বুখারীর অভিমতে বিশ্বাস রাখে ও তাকে মান্য করে তারা আমার মজলিস থেকে চলে যাও। এ কথা শোনার সাথে সাথেই ইমাম মুসলিম (র) মজলিস থেকে চলে এসে উক্ত উস্তাদের যাবতীয় হাদীস তাকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
৭. উল্লেখযোগ্য গ্রন্থবলি : ইমাম মুসলিম (র) বিরচিত অমর গ্রন্থাবলির মধ্যে আস সহীহ লি মুসলিম, আল মুসনাদুল কবীর, আল জামেউল কবীর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
৮. ইন্তেকাল : ২৬১ হিজরীর ২৫ রজব মোতাবেক ৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে রোববার সন্ধ্যায় ৫৭ বছর বয়সে ইমাম মুসলিম (র) নিসাপুরে ইন্তেকাল করেন।
৯. ইন্তেকালের ঘটনা : একবার তিনি একটি হাদীসের সন্ধান মুখে মুখে দিতে না পেরে গৃহে এসে পাণ্ডুলিপি থেকে হাদীস খুঁজছিলেন আর পাত্র ভর্তি খেজুর থেকে ভক্ষণ করছিলেন। হাদীস অনুসন্ধানের ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে অতিমাত্রায় খেজুর ভক্ষণ করে ফেলেন। যখন হাদীসটি পেয়ে যান তখন পাত্রের খেজুর শেষ হয়ে যায়। আর এ অতিমাত্রায় খেজুর ভক্ষণজনিত কারণেই তাঁর ইন্তেকাল হয়।
হাদীস সংকলনে ইমাম মুসলিমের অবদান :
১. ইমাম মুসলিমের রচনাবলি : অধ্যাপনার পাশাপাশি ইমাম মু*সলিম (র) হাদীস, জীবনচরিত এবং হাদীসশাস্ত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গ্রন্থ রচনা করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো
- ক. আল মুসনাদুল কবীর আলা ভারতীবে আসমাউর রিজাল,
- খ. আল জামেউল কবীর আলা ভারতীবিল আবওয়াব,
- গ. কিতাবুল আসমা ওয়াল কুন ।
২. মুসলিম শরীফ সংকলন : সিহাহ সিত্তার ছয়টি হাদীস গ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের পরেই মুসলিম শরীফের স্থান। ইমাম মুসলিম (র) ২৪২ হিজরী থেকে ২৫৭ হিজরী সন পর্যন্ত সুদীর্ঘ ১৫ বছর সময়ে কঠোর পরিশ্রম, অবিশ্রান্ত সাধনা ও উসূলে হাদীসের মানদণ্ডে যাচাইপূর্বক প্রায় ৪ লক্ষ হাদীস থেকে মাত্র ৯২০০টি হাদীস এতে সন্নিবেশিত করেন। তাহের জাযায়েরীর মতে, পুনরাবৃত্তি ছাড়া মুসলিম শরীফে সংকলিত হাদীসের সংখ্যা চার হাজার।
হাফস আল মিয়াজীর মতে, পুনরুল্লেখসহ ৮ হাজার, কিন্তু ইমাম মুসলিমের অন্যতম সহযোগী আহমদ ইবনে সালামার মতে, মুসলিম শরীফে সংকলিত হাদীসের সংখ্যা ১২ হাজার।
৩. মুসলিম শরীফ সংকলনে সতর্কতা : ইমাম মুসলিম (র) রাসূল (স)-এর হাদীসগুলো অত্যন্ত সুন্দর বিন্যাস পদ্ধতিতে সতর্কতার সাথে স্বীয় গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেন। কখনো নিজের খেয়ালিপনায় তিনি কোনো হাদীস সন্নিবেশিত করেননি। তিনি সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিজের সংকলিত গ্রন্থে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এ অমূল্য গ্রন্থটি হাফেযে হাদীস ইমাম আবু যুরয়ার সম্মুখে উপস্থাপন করলে প্রত্যেকটি হাদীসের ওপর তিনি যে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাই তিনি গ্রহণ করেন।
৪. গ্রন্থটির পর্যালোচনা :
- ক. ইমাম মুসলিম (র) বলেন, মুহাদ্দিসগণ দু’শ বছর পর্যন্ত যদি হাদীস লিখতে তবুও তাঁর সংকলিত বিশুদ্ধ গ্রন্থ মুসলিম শরীফের ওপর অবশ্যই নির্ভর করতে হবে। থাকেন,
- খ. ইমাম কুরতুবী (র)-এর মতে, সহীহ বুখারী ও মুসলিম উভয়ই সমমর্যাদার অধিকারী।
- গ. ইমাম নবুবীর মতে, আল কুরআনের পরেই সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের স্থান।
- ঘ. আবু আলী নিসাপুরীর মতে, সিহাহ সিত্তার মধ্যে সহীহ মুসলিমের স্থান সহীহ বুখারীর ঊর্ধ্বে।
৫. মুসলিম শরীফের বর্তমান পাণ্ডুলিপি : বর্তমান বিশ্বে মুসলিম শরীফের যে সংকলন পরিদৃষ্ট হচ্ছে তা প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আবু ইসহাক ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সুফিয়ান নিসাপুরীর সূত্রে বর্ণিত।
৬. ব্যক্তিগত জীবন ইমাম মুসলিম (র) জীবনে কাউকে কটুবাক্য বলেননি, কাউকে প্রহার করেননি। শিক্ষকবৃন্দের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সরল, উদার, মুত্তাকী এবং নবীপ্রেমিক ছিলেন।
৭. মাযহাব : ইমাম মুসলিম (র)-এর অনুসৃত মাযহাব কী ছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। যেমন
হযরত আনওয়ার শাহ কাশ্মীরীর মতে, ইমাম মুসলিম (র)-এর কোনো নির্দিষ্ট মাযহাব ছিল। না। তবে নবাব সিদ্দিক হাসান খানের মতে, তিনি শাফেয়ী মাযহাব আর মাওলানা আবদুর রশীদের মতে, মালেকী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র)-এর মতে, তিনি ছিলেন একজন মুজতাহিদ।
৮. মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব : ইমাম মুসলিম (র) ছিলেন ব্যক্তিত্বে অটল, চরিত্র মাধুর্যে বিরল, আর চেতনায় সমুজ্জ্বল। তাই সমসাময়িক প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা আলেম আবু হাতেম আর রাযী, মুসা ইবনে হারূন, আহমদ ইবনে সালামা, মুহাম্মদ ইবনে মাখলাদ এবং আরো অনেকেই তাঁর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা অবনত মস্তকে স্বীকার করেছেন। مرتبة الإمـام الـمـسـلـم بين المحتلين
হাদীসশাস্ত্রবিদগণের মধ্যে ইমাম মুসলিমে স্থান :
১. স্থায়ী কল্যাণের প্রতিশ্রুতি : প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইসহাক (র) বলেন, যতদিন আল্লাহ তায়ালা ইমাম মুসলিমকে মুসলমানদের জন্য জীবিত রাখবেন এবং তাঁর সংকলন অবশিষ্ট থাকবে, ততদিন তারা কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে না।
২. অন্যতম হাফেযে হাদীস : ইমাম আবু কুরাইশ বলেন, পৃথিবীতে হাফেযে হাদীস চার জন ইমাম মুসলিম তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
৩. বিরল ব্যক্তিত্ব : শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র) বলেন, তিনি জীবনে কারো গীবত করেননি বা কাউকে গালি দেননি, কিংবা আঘাত করেননি। সুতরাং তাঁর তুলনা বিরল।
৪. বিশুদ্ধ হাদীস সংকলক : প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আয়ায (র) বলেন, আমার বিখ্যাত উস্তাদগণ ইমাম বুখারী অপেক্ষা ইমাম মুসলিমকে অগ্রাধিকার দিতেন। আমি ইমাম আবু আল নিসাপুরীকে বলতে শুনেছি, আকাশের নিচে ইমাম মু*সলিম (র) সংকলিত হাদীস গ্রন্থ অপেক্ষা। বিশুদ্ধতম হাদীস গ্রন্থ আর নেই।
৫. সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী: ইমাম আবু হাতেম (র) বলেন, হাদীসশাস্ত্র বিষয়ে ইমাম মুসলিমের স্থান সর্বোচ্চ।
৬. অদ্বিতীয় গ্রন্থ : ফাতহুল বারীর ভূমিকায় হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (র) হাফেয মুসলিম ইবনে কুরতুবী (র)-এর সূত্রে সহীহ মুসলিম সম্পর্কে বলেন, ইসলামে এরূপ আর একটি গ্রন্থ কেউ সংকলন করতে পারেনি।
منهج الإمـام الـمـسـلـم فـي تـالـيـف الصحيح المسلمو
সহীহ মুসলিম প্রণয়নে ইমাম মুস*লিম (র)-এর সংকলন পদ্ধতি : ইমাম মু*সলিম (র) স্বীয় অনবদ্য বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থ সহীহ মুসলিম প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করেন, তাকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা
এক. হাদীস নর্বাচন পদ্ধতি, দুই. গ্রন্থ বিন্যাস পদ্ধতি, শাহ হাদীস চিহ্নিত,
৯. মাওকুফ হাদীস স্পষ্টকৃত,
১০. মুদরাজ হাদীস প্রসঙ্গে মন্তব্য,
১১. মুসনাদ বিত:
১২. মাতরুকুল আমলের বিবরণ প্রদান,
১৩. হাদীস গ্রহণ ও বর্জন সম্পর্কে আলেমগণের ইখতেলাফ,
১৪. হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ধারায় মুসলিম পণ্ডিতগণের বিভিন্ন মতামত।
ইমাম তিরমিবীর অভিমত : এ গ্রন্থ সংকলনের পর ইমাম তিরমিযী স্বয়ং এর সম্পর্কে অভিমত পেশ করে বলেন, এ গ্রন্থটি যার ঘরে থাকবে মনে হবে যেন নবী করীম (স) নিজেই তার গৃহে কথা বলছেন।
উপসংহার: ইমাম তিরমিযী নিঃসন্দেহে একজন প্রথিতযশা, অসামান্য প্রতিভাধর ও ক্ষণজন্মা মহামনীষী ছিলেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের ফসল জামে তিরমিযী। এ গ্রন্থের বৈশিষ্ট্যাবলি হাদীসশাস্ত্রে তাঁর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার মযবুত হাতিয়ার, যে বৈশিষ্ট্যাবলি অন্যান্য গ্রন্থে অনেকাংশেই অনুপস্থিত।
আরো জানুন: