?> ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম - Best Information
ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম

ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম

ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম

সুদভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রম শত শত বছরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। ফলে এর সেবার ক্ষেত্র ও পরিসর ক্রমশঃ বিস্তৃত, সম্প্রসারিত ব্যাপকতর হয়েছে। বহুমাত্রিক কার্যক্রমের কারণে এই ব্যাংকব্যবস্থা ব্যাংকিং সুপার মার্কেট’ বা ‘৩৬০ ডিগ্রি ব্যাংক’-রূপে খ্যাতি অর্জন করেছে।

 

অন্যদিকে ভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও কর্মকৌশল নিয়ে গত কয়েক বেড়ে ওঠা ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম সুদভিত্তিক ব্যাংকের চাইতেও ব্যাপকতর। সর্বোপরি ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম স্বভাবসম্মত, প্রত্যক্ষ ও বাস্তব। ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহ্ অনুমোদিত পদ্ধতিতে জমা গ্রহণ ও বিনিয়োগ করে। সেইসাথে ইসলামী ব্যাংক সকল প্রকার ব্যক্তিগত, সেবামূলক, অর্থনৈতিক ও আর্থিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।

 

সুদভিত্তিক ব্যাংকের কার্যক্রমের মুকাবিলায় ইসলামী ব্যাংক সুস্পষ্টভাবে ব্যতিক্রর্মী কল্যাণমুখী বিকল্পধারা নির্মাণ করেছে। ইসলামী ব্যাংক তার গ্রাহকদের চাহিদা সামনে রেখে ইসলামী শরীয়ার সীমার মধ্যে নতুন নতুন প্রোডাক্ট উন্নয়ন করছে। ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থা বিকাশের সাথে সাথে এক্ষেত্রে ইজতিহাদ তথা গবেষণার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন প্রোডাক্ট উন্নয়ন হচ্ছে।

 

 ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার কার্যক্রম

জমা গ্রহণ

গ্রাহকের কাছ থেকে জমা গ্রহণের মাধ্যমে ব্যাংকের তহবিল গড়ে ওঠে। ব্যাংক সে তহবিল বিনিয়োগ করে। জমা গ্রহণ ও বিনিয়োগ এই উভয় ক্ষেত্রেই সুদভিত্তিক ও ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য মৌলিক। সুদী ব্যাংক চলতি হিসেবে জমা গ্রহণ করে সে টাকা সুদে খাটায়। এছাড়া পূর্ব নির্ধারিত হারে সুদ দেয়ার আগাম অঙ্গীকারের ভিত্তিতে সঞ্চয়ী, স্বল্পমেয়াদী, স্থায়ী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জমা গ্রহণ করে।

 

ইসলামী ব্যাংক শরীয়াহ অনুমোদিত আল-ওয়াদিয়া পদ্ধতিতে চলতি বিে জমা নেয়। এছাড়া শরীয়াহভিত্তিক মুদারাবা পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের লোকসান অংশীদারী জমা গ্রহণ করে। এ দুই রেন সম্পর্ক নেই।

ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের জমা আকৃষ্ট করার জন্য নীতি ও পদ্ধতির ভিত্তিতে জমার ধরন ও প্রকৃতিতে বৈচিত্র্য আনে। বৈচি প্রোডাক্ট উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করে। ইসলামী ব্যাংকের অনুমোদিত পদ্ধতিতে শরীয়াহ্ অনুমোদিত বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা হয়। বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রাপ্ত লাভ মুদারাবা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বষ্টিত হয়।

 

ঋণ বনাম বিনিয়োগ

সনাতন পদ্ধতির ব্যাংক সুদের ভিত্তিতে (তাদের পরিভাষায়) ঋণ ও আगान ( Loans & Advances) প্রদান করে। এসব লগ্নী কারবারের মধ্যে সবচে ভালু পদ্ধতিগুলো হলো নগদ ঋণসুবিধা (Cash Credit বা CC), ওভার ব্রা ( Over Draft বা OD), বন্ধকী ঋণ (Pledge), হাইপোথিকেশন (Hyphothecation) ইত্যাদি লগ্নীর ধরন অনুযায়ী এসব ঋণ ও আগাম বিভিন্ন রকম হয়। যেমন ভোক্তা ঋণ (Consumer Credit), ব্যবসায়িক (Commercial Credit ), শিল্প ঋণ (Industrial Loan) ইত্যাদি। ঋণের ধরন, মেয়াদ ও প্রকৃতিতে পার্থক্য সত্ত্বেও সুদ আহরণই সুদী ব্যাংকের কার্যক্রমের প্রধান লক্ষ্য।

 

ঋণের বিপরীতে সুদ নেয়ার সুযোগ ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থায় নেই। ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদেরকে ইসলামী শরীয়াহ্ অনুমোদিত বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিনিয়োগ সুবিধা দেয়। ইসলামী ব্যাংকের তহবিল বিনিয়োগের জন্য শরীয়াহ্ অনুমোদিত অনেক পদ্ধতি রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ক. মুদারাবা ও মুশারাকাভিত্তিক অংশীদারি পদ্ধতি, খ. মুরাবাহা, বাই মুয়াজ্জাল ইত্যাদি বেচা-কেনা পদ্ধতি এবং গ. ইজারা ও লীজিংসহ শরীয়াহ্ অনুমোদিত বিনিয়োগ পদ্ধতি।

 

ইসলামী ব্যাংক টাকাকে পণ্যের মতো বেচা-কেনা করে না। ক. প্রকৃত দ্রব্যের বেচা-কেনা করে। খ. গ্রাহকের সাথে অংশীদারি পদ্ধতিতে ব্যবসা করে। গ গ্রাহকদের কাছে কল-কারখানা, যানবাহন, বাড়ি ইত্যাদি ভাড়া দিয়ে তা থেকে ভাড়া বাবদ আয় করে।

 

এ ধরনের বিনিয়োগ কার্যক্রমের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক তার সামর্থ অনুযায়ী কোন গ্রাহককে সীমিত পর্যায়ে বিনা সুদে ঋণ প্রদান করতে পারে। সুদমুক্ত । ঋণ ‘কর্জে হাসানা’ নামে পরিচিত।

 

ঋণপত্র (Letter of Credit বা L.C.) খালা

আন্তর্জাতিক লেনদেনের উদ্দেশ্যে ঋণপত্র খোলা ব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অলপত্রের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের বিপরীতে অর্থ-পত্নী করে সুদী ব্যাংক সুদ নেয়। ব্যাক-টু-ব্যাক ক্ষণপরের ক্ষেত্রে বিলম্বে বিল পরিশোধের জনাও সুদী ব্যাংক নির্ধারিত হারে সুদ আদায় করে থাকে।

 

ইসলামী ব্যাংক ইসলামী শরীয়ার নীতি মেনে ঋণপত্র খুলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে অংশ নেয়। ঋণপত্রের বিপরীতে আমদানি করা পণ্য ব্যাংক শরীয়াহ্ অনুমোদিত বিভিন্ন বিনিয়োগ পদ্ধতির অধীনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে অথবা ভাড়া দেয় কিংবা গ্রাহকের সাথে অংশীদারি কারবারে নিয়োজিত হয়।

 

ফিলছে বিল প্রদান কিংবা রফতানি বিল ডিসকাউন্টিং-এর মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে এবং তাতে সুদ যুক্ত হলে ইসলামী ব্যাংক সে সুদ তার আয়ের মধ্যে সামিল করে না। যেকোন ধরনের অবৈধ বা সন্দেহজনক আয় শরীয়াহ্ কাউন্সিলের পরামর্শ অনুযায়ী অন্যকোন কাজে ব্যয় করা হয়।

 

বৈদেশিক মুদ্রা বেচা-কেনা

বৈদেশিক মুদ্রা কেনা-বেচা সুদভিত্তিক ব্যাংকের একটি স্বাভাবিক কাজ। নগদ আগাম ফরমায়েশের (Forward Booking) মাধ্যমে এ জাতীয় লেনদেন হয়। ঝুঁকি এড়াতে ও আয়ের পরিধি বাড়াতে সুদভিত্তিক ব্যাংক বৈদেশিক বাণিজ্যের নতুন নতুন প্রোডাক্ট উন্নয়ন করছে। এই ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সামর্থ ব্যাংকের ব্যবসায়িক সফলতার নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হয়।

 

ইসলামী ব্যাংক দৈনন্দিন আন্তর্জাতিক দেনা-পাওনা মেটানোর জন্য শরীয়াহ্সম্মত নগদ ভিত্তিতে (Spot basis) এক মুদ্রার সাথে অন্য প্রকার মুদ্রার বিনিময় বা কেনা-বেচা করে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ফরওয়ার্ড বুকিং কিংবা ডিরাইভেটিভ প্রডাক্টে ইসলামী ব্যাংক অংশ নেয় না। ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, মুদ্রার বেচা-কেনার মাধ্যমে ফটকা লাভ অর্জনের প্রবণতা মুদ্রা বাজারে অস্থিতিশীলতা ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।

 

মুদ্রাবাজার দলিল

অর্থনৈতিক তৎপরতায় অগ্রসর দেশগুলোতে মুদ্রাবাজারের বিভিন্ন দলিল (Money Market Instrument) কেনাবেচা হয়। মুদ্রাবাজার দলিল’ লেনদেনের ক্ষেত্রে সুদের হার প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে। মুদ্রা- বাজার দলিলের মধ্যে ট্রেজারি বিল (T-Bill), হস্তান্তরযোগ্য সার্টিফিকেট (Negotiable Certificate), বাণিজ্যিক পত্র (Commercial Paper), ব্যাংকারের গ্রহণযোগ্যতা-পত্র (Bankers Acceptance) ইত্যাদি বেশি প্রচলিত।

 

এসব ইসলামী আর্থিক দলিল প্রকৃত সম্পদ (Real Assen)-এর বিপরীতে করা হয়। এই লেনদেনে প্রকৃত সম্পদ তার যথাযথ ভূমিকা পালন করে। কারণে আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা অর্জন ও স্বাভাবিকতা রক্ষা করা সহ হয়। ইসলামী ব্যাংক এসব প্রোডাক্টের সফল প্রচলনের মাধ্যমে মুদ্রাবাজারে তার পদ্ধতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়।

 

মার্চেন্ট ব্যাংকিং

মার্চেন্ট ব্যাংকিং সেবা ব্যাংকিং জগতে তুলনামূলকভাবে নতুন ধারণা। তবে ইতোমধ্যেই এর কার্যপরিধির ব্যাপ্তি ঘটেছে। বর্তমানে মার্চেন্ট ব্যাংকিং-এর উল্লেখযোগ্য কাজ হলো ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা, মূলধন বাজারে পুঁজি বিনিয়োগ, অবলেখন ( Under Writing) ইত্যাদি। ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যপরিধির বাইরে মার্চেন্ট ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে ব্যাংকের মুনাফার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ ও তারল্য বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়।

 

ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থায় ডেবিট কার্ডের সহজ ও ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডের উন্নয়ন ও প্রয়োগ করছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে শরীয়াহ্ পরিপালন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে Accounting & Auditing Organization for Islamic Financial Institutions (AAOIFI) শরীয়াহ্ স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করেছে।

 

পুঁজিবাজারে মূলধন বিনিয়োগের ব্যাপারেও শরীয়ার আপত্তি নেই। তবে বাজারে স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখার স্বার্থে এক্ষেত্রে ইসলামের নৈতিক মান সংরক্ষণে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।

 

লকার ভাড়া

মূল্যবান সামগ্রীর নিরাপদ হেফাযতের জন্য লকার ভাড়া দেয়া ব্যাংকিং সেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ সুবিধার বিনিময়ে ব্যাংক মাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে নির্ধারিত ফি আদায় করে থাকে।

 

ইসলামী ব্যাংক ইসলামী শরীয়ার আল-আমানাহ নীতির ভিত্তিতে গ্রাহকের দ্রব্যসামগ্রী নিরাপদে হেফাযত করার দায়িত্ব পালন করে। অন্যদিকে সুদভিত্তিক ব্যাংক লকার ভাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে শরীয়ার বিধিবিধান অনুসরণের কথা চিন্তা করে না।

 

রেমিট্যান্স কার্যক্রম (ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম এর মধ্যে অন্যতম)

‘রেমিট্যাপ’ হলো এক স্থান থেকে অন্যত্র অর্থ বা তহবিলের স্থানান্তর। এজন্য থাকে গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন বা ফি আদায় করে। সেবার বিনিময়ে বা আদায় করা শরীয়াহসম্মত। তবে ইনস্ট্রুমেন্ট বা ড্রাফট হাটাকরণ বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সুদের উদ্ভব হতে পারে। তাই ইসলামী ব্যাংক হাট্টাকরণের কাজে জড়িত হয় না, কমিশন বা ফি-এর বিনিময়ে শুধুমাত্র অর্থ স্থানান্তরে অংশ নেয়।

 

ব্যাংক গ্যারান্টি (ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম এর মধ্যে অন্যতম)

‘ব্যাংক গ্যারান্টি’ হলো কোন দায়-দেনা বা প্রতিশ্রুতি পূরণে গ্রাহকের অপারগতার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যাংক কর্তৃক তৃতীয় পক্ষের সম্ভাব্য ক্ষতি পূরণের অঙ্গীকার বা নিশ্চয়তা প্রদান। গ্যারান্টির শর্ত পূরণে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক ব্যর্থ হলে তার পক্ষে ব্যাংক তৃতীয় পক্ষকে গ্যারান্টির অর্থ পরিশোধ করে। ব্যাংক এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে নির্ধারিত কমিশন আদায় করে। ইসলামী ব্যাংক গ্যারান্টি সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ শরীয়াহসম্মত ।

 

বিল বাট্টাকরণ

রফতানি বিল বাট্টাকরণ (Discounting) সুদভিত্তিক ব্যাংক-ব্যবস্থায় একটি বহুল প্রচলিত অর্থায়ন কার্যক্রম। গ্রাহককে আগাম তারল্য ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা দানের জন্য ব্যাংক গ্রাহকের রফতানি বিল বাট্টাকরণ করে অর্থাৎ কম দামে কিনে নেয়। সুদভিত্তিক ব্যাংকিং লেনদেনে এ ধরনের বিল বাট্টাকরণ ব্যাপকভাবে প্রচলিত। বিল বাট্টাকরণের মাধ্যমে বিলম্বিত সময়ের জন্য সুদী ব্যাংক সুদ আদায় করে।

 

ইসলামী ব্যাংক সুদভিত্তিক এই বাট্টাকরণের কাজে অংশ নেয় না। এর বিকল্প হিসেবে ইসলামী ব্যাংক রফতানিকারকদের বাই সালাম বা মুশারাকা পদ্ধতিতে প্রাক-জাহাজীকরণ (Pre-shipment) বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের আরও নতুন নতুন প্রোডাক্ট উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।

 

কলমানি মার্কেটে অংশগ্রহণ

সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থায় আন্তঃব্যাংক লেনদেনে কলমানি মার্কেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন ব্যাংকের তারল্য ঘাটতি দেখা দিলে সে ব্যাংক অধিক তারল্যের অধিকারী ব্যাংকের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিয়ে তার ঘাটতি মুকাবিলা করে এ ক্ষেত্রে তারল্য সংকটে পতিত ব্যাংকের বিপদের সুযোগ নিয়ে অধিক তারল্যের অধিকারী ব্যাংক ইচ্ছামতো চড়া হারে সুদ আদায় করে। বিপদাপন্ন ব্যাংকের সংকট যত গভীর হবে, সুদের হার তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে। কখনো কখনো কলমানি মার্কেটে সুদের হার স্বাভাবিক বাজারের সুদের হারের চার-পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে শক্তিমান প্রতিবেশী তার ঘরের পাশের দুর্বল পড়শিকে বাগে পেয়ে ঘাড় মটকাতে একটুও লজ্জাবোধ করে না।

 

ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থায় সুদের ভিত্তিতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনের সুযোগ নেই। এর ইসলামী বিকল্প হলো ‘ হাসান’ অথবা শরীয়াহ অনুমোদিত দলিলের মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক লেনদেন। বর্তমানে অধিক ভাবলোর অধিকার ব্যাংক তারল্য সংকটে পতিত ইসলামী ব্যাংকের তারল্য ঘাটতি পুরণে সহযোগিতা করতে তাদের মুদারাবা অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাগে ইসলামী ব্যাংক জমা গ্রহণকারী ইসলামী ব্যাংকের মুদারাবা কারবারে স্বাভাবিক নিয়মে সাহিব আল মাল হিসেবে অংশ নেয়। এ ধরনের জমার মাধ্যমে অধিক তারল্যের অধিকারী ব্যাংক তারল্য সংকটে পতিত ব্যাংকের সাময়িক তারল্য- চাপ মুকাবিলায় সহায়তা করে। এ সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সে তার বাড়তি মূলধন বিনিয়োগের সুযোগ পায়। একের বিপদে অন্যের সহায়তা ও সহমর্মিতাও প্রকাশ পায়। বিপদের সুযোগ নিয়ে ইচ্ছামতো অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নেয়ার মুনাফাখোরি প্রবণতা এরূপ আন্তঃব্যাংক লেনদেনে সৃষ্টি হয় না।

 

সরকারী ট্রেজারি বিল ক্রয়

সুদের বিনিময়ে সরকারী ট্রেজারি বিল (T-Bill) কেনা-বেচা সুদভিত্তিক ব্যাংকের একটি স্বাভাবিক ব্যবসা। ইসলামী ব্যাংক সুদযুক্ত সরকারী টি-বিল কেনা-বেচা করে না। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ইসলামী শরীয়াহ্ অনুমোদিত ‘মুদারাবা বন্ড চালু করেছে। ইসলামী ব্যাংকগুলো এখন এই বন্ডে বিনিয়োগ করার সুযোগ পাচ্ছে।

 

এসএলআর (SLR) ও সিআরআর (CRR) সংরক্ষণ

আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে তফসিলভুক্ত সকল ব্যাংক নির্ধারিত হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ তারল্য সঞ্চিতি (Statutory Liquidity Reserve বা SLR) সংরক্ষণ করে। সঞ্চিতির কিছু অংশ নগদ আকারে (Cash Reserve Requirement বা CRR) এবং অবশিষ্ট অংশ অনুমোদিত দলিল আকারে সংরক্ষণ করতে হয়। সময়ে সময়ে এই তারল্য সঞ্চিতির হারের পরিবর্তন করা হয়। এ ধরনের সঞ্চিতির ওপর সুদভিত্তিক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘ব্যাংক হার’ (Bank Rate) অনুযায়ী সুদ পায় ।

 

ঝুঁকি মুকাবিলার অন্তর্নিহিত ব্যবস্থা এবং পদ্ধতিগত পার্থক্যের কারণে ইসলামী ব্যাংকের জন্য এসএলআর সংরক্ষণ যুক্তিসম্মত নয় বলে কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তবে আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে ইসলামী ব্যাংকও এই বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি তহবিল সংরক্ষণ করে। বাংলাদেশ সরকারের মুদারাবা বন্ড প্রবর্তনের আগে ইসলামী ব্যাংককে তার পুরো সঞ্চিতি তহবিল নগদ আকারে রাখতে হতো। এখন তার শতকরা পাঁচভাগ সঞ্চিতি শরীয়া অনুমোদিত এই বন্ডে রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সঞ্চিতি খাতের নগদ জমা থেকে কোন সুদ অর্জিত হলে তা ইসলামী ব্যাংকের স্বাভাবিক আয়ের অংশ হয় না।

 

সুদ এর বিলোপ (ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম এর মধ্যে মূল)

সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে। ইসলামের দৃষ্টিতে সব ধরনের সুদ হারাম। ইসলামী ব্যাংক অর্থনীতিতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, শিল্প-কলকারখানা স্থাপন, বৈদেশিক লেনদেনসহ সকল অর্থনৈতিক কাজ কারবারে এই ব্যাংকের নীতি ও কৌশল হচ্ছে সুদ বর্জন করা। ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞাতেই এ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।

 

ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ

ইসলামী ব্যাংক নীতিগতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সরাসরি অংশ নিতে পারে। এতে ব্যবসায়ের যাবতীয় ঝুঁকি ব্যাংক ও গ্রাহকের মাঝে ভাগ হয়ে যায়। ইসলামী ব্যাংক তা দু’ভাবে নিশ্চিত করে থাকে ঃ (ক) প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং (খ) লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বের চুক্তিতে অংশগ্রহণ।

ক. প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ: ইসলামী ব্যাংক তার নিজ তহবিল এবং জমাকারীদের অনুমতিক্রমে তাদের তহবিল হতে মূলধন নিয়ে নিজ উদ্যোগ ও মালিকানাধীনে শরীয়াহ্ অনুমোদিত ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতে পারে। ব্যাংক শুধুমাত্র জমাকারীর তহবিল ব্যবহার করেও বিনিয়োগ কার্যক্রম চালাতে পারে। দেশের প্রচলিত আইনে এ ব্যাপারে বাধা থাকলে তা আলাদা কথা। সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় ব্যাংক হলো মধ্যস্বত্বভোগী বা Financial Intermediary. সরাসরি ব্যবসায়ে অংশগ্রহণের সুযোগ তার নেই ।

খ. অংশীদারিত্বের চুক্তিতে অংশগ্রহণ: ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প, কল-কারখানা প্রভৃতি স্থাপনে পুঁজি বিনিয়োগ করে তাতে অংশীদার হতে পারে। ব্যাংক এক্ষেত্রে উদ্যোক্তার সাথে অংশীদারী চুক্তি অনুযায়ী আংশিক বা সম্পূর্ণ পুঁজি সরবরাহ করতে পারে। ব্যবসায়ে লাভ হলে তা চুক্তির শর্তে উল্লেখিত হারে বণ্টন হয় এবং লোকসান হলে তা মূলধন অনুপাতে ব্যাংক ও গ্রাহক বহন করে। অর্থাৎ লাভ হলে ব্যাংক পূর্বনির্ধারিত হার অনুযায়ী অংশ পায়। লোকসান হলে তা পুঁজির আনুপাতিক হারে ব্যাংক বহন করে ।

সুদভিত্তিক ব্যাংক-ব্যবস্থায় অংশীদারী বিনিয়োগের সুযোগ নেই। তাই এসব কারবারের লাভ-লোকসান বা সাফল্য-ব্যর্থতার ব্যাপারে সুদী ব্যাংকের কোন দায়-দায়িত্বও নেই। ব্যবসায় যথা দেখা দিলে বা লোকসানের আশংকা সৃষ্টি হলে সুদী ব্যাংক তার গ্রাহককে দ্রুত ঋণ পরিশোধের প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা আরও দী এমনকি ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। সুদভিত্তিক স বন্ধু আর ঝড়-বৃষ্টির দুর্দিনে ছাতা গুটিয়ে নেয়া তার নীতি।

 

ব্যবসা-বাণিজ্যে নীতি-নৈতিকতা ও হালাল-হারামের দৃষ্টিভঙ্গি

ইসলামী ব্যাংক তার বিনিয়োগের খাত ইসলামী শরীয়াহ অনুমোদিত কি-না ত বিশেষভাবে বিচার করে। সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগের আর্থ-সামাজিক প্রভাব বা সামাজিক লাভ-ক্ষতিও সে বিবেচনা করে। সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মা মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও বিপণন, চরিত্রবিধ্বংসী উপকরণ, তামাক ও সিগারেটের মতো জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর সামগ্রী উৎপাদন ও বিপণনে ইসলামী ব্যাংক সহায়তা করে না। মজুতদারী ও মুনাফাখোরীর সুযোগ সৃষ্টিকারী কাজেও ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগ করে না। সর্বসাধারণের ক্ষতি করে ব্যক্তিবিশেষের সৌভাগ্য গড়ার কাজে বিনিয়োগ ইসলামী ব্যাংক সমর্থন করে। না, পৃষ্ঠপোষকতার ঊর্ধ্বে থাকে।

 

ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ শুধুমাত্র শরীয়াহ্ অনুমোদিত খাতে ও শরীয়াহ্সম্মত পদ্ধতিতে হতে হবে। সেইসাথে ইসলামী ব্যাংক তার বিনিয়োগনীতিতে ইসলামী অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রাধিকার খাত নিরূপণ করে। ইসলামী ব্যাংক বিলাস সামগ্রীর তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীতে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়। সম্পদ শুধু স্বল্পসংখ্যক মানুষের মাঝে যাতে আবর্তিত না হয় তা নিশ্চিত করা ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রমের অন্যতম নীতি সুদভিত্তিক ব্যাংকের ঋণ ও আগাম প্রদানসহ সার্বিক কার্যক্রমে ‘বেশি সুদ বেশি লাভ’ এবং ‘সমষ্টির সম্পদ মুষ্টিমেয়র পকেটস্থ করা’র কৌশল মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

 

শরীয়াহ কাউন্সিল (ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম এর মধ্যে প্রধান)

ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, মূলধন বা তহবিল বিনিয়োগ ইত্যাদি বহুমাত্রিক পরিচালনাগত কাজে শরীয়াহ্ পরিপালন নিশ্চিত করা এবং সকল ক্ষেত্রে তার লঙ্ঘন রোধের উদ্দেশ্যে ‘শরীয়াহ কাউন্সিল’ একটি স্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা রূপে ভূমিকা পালন করে। শরীয়াহ্ অনুমোদিত পদ্ধতি উদ্ভাবন, প্রয়োগ, নির্দেশনা, নিরীক্ষণ, পরামর্শ প্রদান প্রভৃতি ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ্ কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফিকহুল মু’আমালাত (Islamic Commercial Jurisprudence) বিষয়ে পারদর্শী বিজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ আলিম, ইসলামী অর্থনীতিবিদ, অভিজ্ঞ আইনবিদ ও অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের সমন্বয়ে শরীয়াহ্ কাউন্সিল গঠিত হয় । ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ কাউশি’র বিষয়ে স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রদান করে। বাংলাদেশে যেসব সুদভিত্তিক ব্যাংক পৃথকভাবে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা পরিচালনা করছে তাদেরও প্রত্যেকের নিজস্ব শরীয়াহ কাউন্সিল রয়েছে। বাংলাদেশের সকল ইসলামী ব্যাংকের শরীয়াহ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সংস্থারূপে ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট থেকে কাজ করছে সেন্ট্রাল শরীয়া বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংকস অব বাংলাদেশ।

 

বিশ্বের ইসলামী ব্যাংকসমূহের আন্তর্জাতিক ও স্বাধীন সংস্থারূপে ১৯৯১ সালের ২৭ মার্চ থেকে কাজ করছে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের অঙ্গসংস্থা বাহরাইনভিত্তিক দি অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিটিং অর্গানাইজেশন ফর ইসলামিক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস (AADIFI) বা ‘আওইফি’। আওইফি আন্তর্জাতিক ইসলামিক ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স শিল্পের অ্যাকাউন্টিং, অডিটিং, ইথিকস এবং গভর্নেস সংক্রান্ত স্ট্যান্ডার্ড প্রণয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে ‘শরীয়াহ স্ট্যান্ডার্ড’ প্রণয়ন ও প্রবর্তনের দায়িত্বেও নিয়োজিত ।

 

যাকাতব্যবস্থার বাস্তবায়ন (ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম এর মধ্যে অন্যতম)

‘যাকাত’ ইসলামের পাচটি রুকন বা মূলস্তম্ভের অন্যতম। গুরুত্বের দিক দিয়ে নামাযের পরেই যাকাতের স্থান। ইসলামী ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিলের অবণ্টনযোগ্য অংশের ওপর যাকাত দেয়। কোন কোন ইসলামী ব্যাংক তার গ্রাহকদের নিকট থেকেও স্বেচ্ছাপ্রদত্ত যাকাত সংগ্রহ করে। তারা যাকাত তহবিলের টাকা নির্ধারিত খাতে পরিকল্পিতভাবে ব্যয় করছে। যাকাত তহবিলের অর্থে উদ্যোক্তা-প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থানমুখী উপকরণ সরবরাহ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কার্যক্রমে সহায়তাসহ বিভিন্ন ধরনের আয়-উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য হ্রাসে এটি একটি কার্যকর ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

 

বাংলাদেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংকরূপে ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ যাকাত তহবিলের পরিকল্পিত ব্যবহারের ক্ষেত্রে গত দুই দশকে এদেশে একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড তার ব্যাংকের শেয়ার প্রিমিয়াম, বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি, বিনিময় ক্ষতিপূরণ সঞ্চিতি, বিনিময় সমতাকরণ হিসাব, এবং লভ্যাংশ সমতাকরণ হিসাব-এর সমাপনী স্থিতির উপর বার্ষিক ২.৫৮% হারে যাকাত প্রদান করে।

 

২০০৫ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ৭,৪০,৫০,৬৭৫.০০ টাকা যাকাত আদায় করেছে। এক্সিম ব্যাংক ২০০৫ পর্যন্ত তার যাকাত তহবিলে ২.৩৩ কোটি টাকা জমা করে এবং এ খাত থেকে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ ১.৪৬ কোটি টাকা। কোন কোন ইসলামী ব্যাংকের সংরক্ষিত সম্পদ যাকাতযোগ্য না। হওয়ায় এবং কোনটির সঞ্চিতি ও উদ্বৃত্তের তুলনায় শ্রেণীকৃত বিনিয়োগের প্রভিশন ঘাটতি থাকায় যাকাত হিসাব শুরু করেনি।

 

কর্জে হাসানা

কর্জে হাসানা’ মানে উত্তম ঋণ। এই ঋণ প্রদান করা হয় ব্যক্তির সাময়িক প্রয়োজন পূরণের জন্য। কখনো কখনো সচ্ছল উপার্জনক্ষম সৎ ব্যক্তিরও এরূপ ঋণের প্রয়োজন হতে পারে। কর্জে হাসানা একটি ইসলামী কনসেপ্ট। এটি ইসলামী সমাজের একটি অনন্য কল্যাণাদর্শ। সমাজে কর্জে হাসানার প্রচলন থাকলে বিপদের সময় কাউকে সহায়-সম্বল বিক্রি করতে হয় না বা সুদের ভিত্তিতে ঋণ নিতে হয় না । পৃথিবীর বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক ‘কর্জে হাসানা’ হিসাব পরিচালনা করে থাকে। সুদভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের দর্শনে কর্জে হাসানার ধারণা অনুপস্থিত ও অকল্পনীয়।

 

আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন

অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সামাজিক উন্নয়ন সমন্বিত করা ইসলামী ব্যাংকের অন্যতম লক্ষ্য। এ দু’য়ের মধ্যে সমন্বয় ছাড়া সুষম উন্নয়ন (balanced development) সম্ভব নয়। ইসলামী ব্যাংক প্রকল্প বাস্তবায়নে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়। ইসলামী ব্যাংক কোন প্রকল্প নির্বাচনে এর সম্ভাব্য আর্থ-সামাজিক অবদান বিশেষভাবে মূল্যায়ন করে। ব্যক্তির অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে সমষ্টির অর্থাৎ সর্বসাধারণের উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যকেও ইসলামী ব্যাংক নিশ্চিত করতে চায়।

ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য হলো ব্যক্তির কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তার ও তার পরিবারের ভরণ-পোষণের সুযোগ সৃষ্টি করা। ফলে সমাজে সুস্থ ও কল্যাণধর্মী পরিবেশ সৃষ্টি সহজ হয়। সমাজকল্যাণ ও সামাজিক শৃংখলা অর্জনের উদ্দেশ্যে এর সুস্থ ও সুষ্ঠু উন্নয়নের জন্য ইসলামী ব্যাংকিং একটি উন্নত ও সুব্যবস্থিত প্রতিষ্ঠান। প্রচলিত ব্যাংকগুলো শুধুই আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ইসলামী ব্যাংক একই সাথে আর্থিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানরূপে সমাজের ব্যাপক ও বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে কাজ করে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ উমর চাপরার মতে, ইসলামী ব্যাংক একটি Multipurpose ব্যাংক।

শুধুমাত্র সুদের উচ্ছেদ ও বিলোপ সাধন ইসলামী ব্যাংকের কাজ নয়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষের নৈতিক, চারিত্রিক ও মানসিক বিকাশ সাধন এবং হালাল-হারাম মান্য করে বৈধ সীমার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ ইসলামী ব্যাংকের মূলনীতি ও কর্মকৌশল। ইসলামী ব্যাংক তার এ সকল কর্মসূচী ও কর্মকৌশলের মাধ্যমে ইসলামী অর্থনীতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের একটি মুখ্য প্রতিষ্ঠানরূপে কাজ করে।

 

অন্যান্য ব্যাংকিং কার্যক্রম

জমা গ্রহণ ও বিনিয়োগ কার্যক্রম ছাড়াও ইসলামী ব্যাংকগুলো আমদানী- রফতানী বাণিজ্য, রেমিটেন্স, লকার সার্ভিস প্রভৃতি সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম নিজস্ব নীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী পরিচালনা করে।

 

জনকল্যাণমূলক প্রকল্প

ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের বিনিয়োগ কার্যক্রমে জনকল্যাণের নীতি অনুসরণ করার কারণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ এ ব্যাংকের লক্ষ্য। এ জন্য স্বল্পবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলো বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর গৃহায়ণ বিনিয়োগ প্রকল্প, পরিবহন বিনিয়োগ প্রকল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা বিনিয়োগ প্রকল্প, গৃহসামগ্রী বিনিয়োগ প্রকল্প, কৃষি-সরঞ্জাম বিনিয়োগ প্রকল্প, ডাক্তার বিনিয়োগ প্রকল্প প্রভৃতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব প্রকল্পের লক্ষ্য সমাজের অপেক্ষাকৃত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অবস্থার উন্নয়ন। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড-এর পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব পূরণের জন্য নলকূপের ব্যবস্থা, শিক্ষা, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা। ২০২০ সালের মধ্যে দেশের ৬৪ হাজার গ্রামকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যে ইসলামী ব্যাংক ১৯৯৫ সাল থেকে এ প্রকল্পের অধীনে সফলতার সাথে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ফরমাল, নন-ফরমাল ও ভলান্টারি এই তিন সেক্টরে কাজ করে থাকে। নন-ফরমাল সেক্টরের মাধ্যমে পারিবারিক ক্ষমতায়নে মাইক্রো ক্রেডিট এবং মাইক্রো- এন্টারপ্রাইজ উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করে আসছে। শুধুমাত্র সামাজিক অধীকার পালনই সহ, সহ কর্মসূচীসমূহ সরকারের for free (P জাতিসংঘের Millenium Development Goal (MGD) ভূমিকা পালন করছে।

 

 

জনকল্যাণমূলক বিশেষ কার্যক্রম (ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম এর মধ্যে অন্যতম)

ইসলামী ব্যাংকগুলো সব ধরনের স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রমের পাশাপাদি গরীব, দুঃস্থ, অসহায় ও নিঃসম্বল মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এ বিশেষ লক্ষ্যে প্রথমে “সাদাকা ফান্ড’ ও পরে ব্যাপক ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকসহ আরো কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকও অনুরূপ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে।

ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন পরিচালিত জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রকল্প, দুগ্ধবতী গাভী পালন প্রকল্প, রিকশা প্রকল্প, আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প, পোল্ট্রি প্রকল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রকল্প, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী প্রকল্প, ক্ষুদ্রশিল্প প্রকল্পসহ বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচী। মডেল ফোরকানিয়া মক্তব, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি ও অনুদান ও দুঃস্থদের জন্য স্কুল পরিচালনা ও সাহায্য দানসহ শিক্ষা কর্মসূচী, মেডিক্যাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা, দাতব্য চিকিৎসালয়ের জন্য অনুদান, নলকূপ স্থাপন, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণসহ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা কর্মসূচী, এতিমখানা প্রতিষ্ঠা, কন্যা পাত্রস্থ করার জন্য কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে অনুদান, ঋণগ্রস্ত ও ভ্রমণপথে বিপদগ্রস্ত লোকদের অনুদানসহ মানবিক সাহায্য কর্মসূচী এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচী ইত্যাদি।

আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসা ও একটি পাবলিক লাইব্রেরি পরিচালিত হচ্ছে। লাইব্রেরিটি ঢাকার তোপখানা রোডে অবস্থিত এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

এক্সিম ব্যাংক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘এক্সিম ব্যাংক ফাউন্ডেশন’ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং রাজধানীতে কয়েকটি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করেছে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানও তাদের কার্যক্রমের একটি অংশ। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকেরও অনুরূপ কর্মসূচী রয়েছে।

সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক তার ‘ক্যাশ ওয়াক্ফ স্কিম’-এর মুনাফা থেকে মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্‌রাসা, স্কুল, সামাজিক ও স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহে আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। এছাড়াও তারা গুরুতর অসুস্থ, ক্যান্সার, কিডনি ও হার্টের রোগীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে।

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) সহায়তায় নন- ফরমাল সেক্টরের আওতায় ১৯৯৬-১৯৯৮ সালে গার্মেন্টস থেকে ছাঁটাইকৃত প্রায় পাঁচ হাজার শিশুর মাঝে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার শিক্ষা বৃত্তি কর্মসূচী (Stipened Disbursement Program) সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছে। ব্যাংকের ভলান্টারি সেক্টরে ক্যাশ ওয়াক্ফ স্কিমের মুনাফা থেকে মসজিদ, এতিমখানা, মাদরাসা, স্কুল, সামাজিক ও স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহে সহায়তা প্রদান করা হয়।

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ২০০৫ পর্যন্ত তার ক্যাশ ওয়াক্ফ খাত হতে ৩টি মাদরাসা, ৩টি এতিমখানা, ৪টি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র, ১টি সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ও ৩৬ জন গরীব ও অসহায় ব্যক্তিকে সরাসরি মোট ২,০৮,৩২,৩২৩.৫০ টাকা আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছে। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে (Corporate Social Responsibility) সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও বসুন্ধরা গ্রুপ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যৌথভাবে ঠোঁট ও তালু কাটা অপারেশন, চক্ষু চিকিৎসা ও অপারেশন এবং এসিডদগ্ধদের চিকিৎসা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে।

ইসলামী ব্যাংকগুলো বেসরকারী পর্যায়ে তার সীমিত নেটওয়ার্ক নিয়ে জনকল্যাণমূলক খাতে গত কয়েক বছরে যে অবদান রেখেছে তার আলোকে বলা যায়, সার্বিক ব্যাংকব্যবস্থা ইসলামের আলোকে পুনর্গঠিত হলে প্রায় ছয় হাজার শাখা নিয়ে গঠিত এদেশের বিরাট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং অভাবী মানুষের হতাশা মুছে ফেলতে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *