মূলধন গঠন :মূলধন গঠনের প্রক্রিয়া ও মূলধন গঠনের সমস্যা
‘মূলধন গঠন’ বলতে অধিক পরিমাণে মূলধনীসামগ্রী উৎপাদন ও মূলধন বৃদ্ধি প্রক্রিয়াকেই বোঝায়। যে প্রক্রিয়ায় অধিক পরিমাণে মূলধনীসামগ্রী বৃদ্ধি পায় তা হলো মূলধন গঠন প্রক্রিয়া। একটি নির্দিষ্ট সময়ে দেশে “যে পরিমাণ মূলধন সামগ্রী বৃদ্ধি করতে পারে তাই মূলধন গঠন।”
অধ্যাপক র্য্গনার নার্কস এর মতে, “কোনো দেশ তার বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতার সম্পূর্ণটা বর্তমান ভোগের জন্য ব্যবহার না করে এ ক্ষমতার একটি অংশ মূলধনীসামগ্রী উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করলে তাকে মূলধন গঠন বলা হয়।”
অধ্যাপক বেনহাম (R. F. Benham) এর মতে, “ নির্দিষ্ট সময়ে সমাজ বা রাষ্ট্রে তার মূলধনের যে পরিমাণ বৃদ্ধি সাধন করে, তাকেই উক্ত সময়ের মূলধন গঠন বলা হয়।”
ধরা যাক, একটি দেশে কোনো এক বছরের প্রথম দিনে মূলধনসামগ্রীর মোট দাম থাকে ৫ কোটি টাকা এবং পরের বছরের প্রথম দিনে ঐ দেশে মূলধনীসামগ্রীর মোট দাম দাঁড়ায় ৭.৫০ কোটি। এ ক্ষেত্রে ঐ এক বছরে অর্থের অংকে মূলধন গঠনের পরিমাণ হবে ৭.৫০ কোটি টাকা – ৫.০০ কোটি টাকা – = ২.৫০ কোটি টাকা। এটি হবে উক্ত সময়ের নিট বিনিয়োগ। এভাবে একটি দেশের একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রকৃত মূলধন গঠনের পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব।
একটি উদাহরণ লক্ষ কর, ধরি ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত একটি দেশে ২০,০০০ কোটি টাকার মূলধন ছিল কিন্তু পরবর্তী বছর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের মোট মূলধন বেড়ে ২৫,০০০ কোটি টাকা হলো।। তাহলে এক বছরে অতিরিক্ত মূলধনের পরিমাণ হলো ৫,০০০ কোটি টাকা। সুতরাং, কোনো দেশে একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রকৃত মূলধন দ্রব্য তথা যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, কারখানা ঘর ও সামগ্রী, পরিবহণ দ্রব্য, সেতু, বাঁধ, বিদ্যুৎ, সেচ ইত্যাদির মজুদ বৃদ্ধি বা বেশি করে তৈরি করাকে মূলধন গঠন বলে। মূলধন উৎপাদনক্ষম অধিক হলে তা অধিক উৎপাদনে সহায়ক হয়। দেশে মানুষের সঞ্চিত অর্থ সংগ্রহ করে মূলধন দ্রব্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করলে মূলধন সৃষ্টি হয়। সুতরাং, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আর্থিক সঞ্চয় সৃষ্টি, সঞ্চিত অর্থ সংগ্রহ এবং মূলধন দ্রব্য উৎপাদনে তা বিনিয়োজিত করা হয় তাকেই অর্থনীতিতে মূলধন গঠন বলে।
মূলধন গঠন এর প্রক্রিয়া (The Process of Capital Formation)
দেশে প্রকৃত মূলধনী দ্রব্যের বৃদ্ধিই হলো মূলধন গঠন। অন্যভাবে, মূলধন গঠন প্রক্রিয়ায় যন্ত্রপাতি, পরিবহণ ও যোগাযোগের দ্রব্য, বিদ্যুৎ, সেচ ইত্যাদি অধিক পরিমাণে উৎপাদিত হয় যা আবার অধিক উৎপাদনে সহায়তা করে। অধিক মূলধনী দ্রব্যাদি উৎপাদনের জন্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগ আবশ্যক। তাই মূলধন গঠন প্রাথমিকভাবে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে। প্রকৃতপক্ষে সঞ্চিত অর্থ সংগ্রহ করে মূলধনী দ্রব্যাদি উৎপাদনে বিনিয়োগ করলে মূলধন সৃষ্টি হয়।
অর্থনীতিতে মূলধন গঠনের প্রক্রিয়া তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হয়। যথা-
১. আর্থিক সঞ্চয়ের সৃষ্টি
২. আর্থিক সঞ্চয় সংগ্রহ ও ঋণদান
৩. আর্থিক সঞ্চয়কে মূলধনী দ্রব্যে রূপান্তর।
নিচে মূলধন গঠনের এ প্রক্রিয়া বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো:
১.আর্থিক সঞ্চয় সৃষ্টি: সঞ্চয় মূলধন গঠনের জন্য অপরিহার্য। এজন্য মূলধন গঠন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক স্তর হচ্ছে সঞ্চয় সৃষ্টি। পুঁজিবাদী ও মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সঞ্চয়, কারবারি প্রতিষ্ঠানের সঞ্চয় ও সরকারি সঞ্চয় থেকে সঞ্চয়ের সৃষ্টি হয়। অবশ্য সঞ্চয় সৃষ্টিতে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তি বিশেষের সঞ্চয় নির্ভর করে তার সঞ্চয়ের সামর্থ্য ও সঞ্চয়ের ইচ্ছার ওপর।
২. সঞ্চয়ের সামর্থ্য: মূলত আয়ের ওপরই মানুষের সঞ্চয়ের সামর্থ্য নির্ভর করে। আয় বেশি হলে সাধারণত সঞ্চয় বেশি হয়। এজন্যই দেখা যায় দরিদ্র উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে সঞ্চয়ের হার অনেক বেশি।
৩.সঞ্চয়ের ইচ্ছা: সঞ্চয়ের সামর্থ্যের সাথে সাথে সঞ্চয়ের ইচ্ছা থাকলেই কেবল সঞ্চয় বাড়ে এবং মূলধন গঠন সম্ভব হয়। কোনো দেশের মানুষের সঞ্চয়ের ইচ্ছা নিম্নোক্ত কতকগুলো বিষয় দ্বারা নির্ধারিত হয়।
ক. দূরদৃষ্টি: ভবিষ্যতে পরিবারের সদস্যদের ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন অর্থাৎ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের মধ্যে সঞ্চয়ের প্রবল আগ্রহ দেখা যায়। তাই লোকজনের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়লে সঞ্চয় বাড়ে।
খ.পারিবারিক স্নেহ-মমতা: পরিবারের স্নেহশীল পিতা-মাতা ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকিয়ে অধিক সঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হয়। তাই সমাজ-সংসারে পারিবারিক স্নেহ-মমতার প্রবণতা বাড়লে সঞ্চয় বাড়ে।
গ. মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা: সঞ্চয় বৈষয়িক সমৃদ্ধির সাথে সাথে সম্মান ও প্রতিপত্তি ঘটায়। তাই মানুষ ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভে বেশি করে সঞ্চয় করে।
ঘ.জান-মালের নিরাপত্তা: দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকলে এবং আইন-কানুন যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে জান-মালের নিরাপত্তা থাকে। তখন মানুষ বর্তমান ভোগ ত্যাগ করে ভবিষ্যতে বেশি ভোগের আশায় সঞ্চয় করে।
ঙ. কর-ব্যবস্থা: সরকারের করনীতিও জনসাধারণের সঞ্চয়-অভ্যাসকে প্রভাবিত করে। সম্পত্তি, সঞ্চয় বা আয়ের ওপর স্বল্প হারে করারোপ করলে মানুষের সঞ্চয়ের আগ্রহ বাড়ে, বিপরীত অবস্থায় তা আবার কমে।
চ.শিক্ষার হার: দেশে শিক্ষার প্রসার ঘটলে জনগণ ব্যক্তিগত ও সামাজিক কল্যাণ সম্পর্কে সচেতন হয়। সঞ্চয় কল্যাণ অর্জনে সাহায্য করে বলে শিক্ষিত লোক বেশি সঞ্চয় করে।
ছ. সুদের হার সুদের হার সঞ্চয়কারীকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। তাই ব্যাংক ও পোস্ট অফিস বিভিন্ন মেয়াদি আমানতের ওপর উচ্চহারে সুদ প্রদান করতে থাকলে জনসাধারণের সঞ্চয়ের আগ্রহ বাড়ে। ব্যক্তিগত সঞ্চয় ছাড়াও দেশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহ ও সরকার সঞ্চয় করতে পারে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অবষ্টিত মুনাফা সঞ্চয় করে রাখতে পারে, যা আবার প্রকৃত মূলধনী দ্রব্যাদি উৎপাদনে লাগে। সরকারও সঞ্চয় করতে পারে। উদ্বৃত্ত কর-রাজস্ব ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্জিত মুনাফা হলো সরকারি সঞ্চয়। এ সঞ্চয় বাড়লে সরকার তা নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি নির্মাণে ব্যয় করতে পারে ।
২. আর্থিক সঞ্চয় সংগ্রহ: মূলধন গঠনের দ্বিতীয় পর্যায়ে সঞ্চিত অর্থ সংগ্রহ করে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তা যোগান দেওয়া দরকার। দেশের সর্বত্র বিক্ষিপ্ত ও অলস সঞ্চয় ব্যাংক, বিমা কোম্পানি এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগ্রহ করে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল হিসাবে প্রস্তুত রাখা যায়। একাজে দেশের মূলধন বাজার যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে।
৩.আর্থিক সঞ্চয়কে মূলধনী দ্রব্যে রূপান্তর: মূলধন গঠনের শেষ পর্যায়ে সঞ্চিত অর্থকে বিনিয়োগের মাধ্যমে মূলধনী দ্রব্যে রূপান্তর করা প্রয়োজন। সঞ্চিত অর্থ কার্যকরভাবে মূলধনী দ্রব্য উৎপাদনে নিয়োগ করতে পারলে তবেই দেশে মূলধন গঠিত হয়। অবশ্য এর জন্য প্রয়োজন হলো দেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বুনিয়াদ সুদৃঢ়ভাবে গড়ে তোলা এবং বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা।
মূলধন গঠন এর সমস্যা (Problems of Capital Formation)
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে মূলধন গঠন প্রয়োজন। কিন্তু এদেশে মূলধন গঠনের হার অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক কম। বিভিন্ন ধরনের উপাদান মূলধন গঠনে বাধার সৃষ্টি করে।
১.স্বল্প মাথাপিছু আয় ও দারিদ্র্য: মূলধন গঠনের প্রধান উপাদান হল সঞ্চয় বৃদ্ধি। সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত আয়। কিন্তু বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় কম। বর্তমানে তা প্রায় ১৩১৪ মার্কিন ডলার। এ রকম স্বল্প আয় ও ব্যাপক দারিদ্র্যের জন্য এদেশের সঞ্চয়ের হার খুব কম। সুতরাং, এদেশে মূলধন গঠনের প্রধান সমস্যা হলো স্বল্প আয় ও স্বল্প সঞ্চয়।
২.সঞ্চয়ের ইচ্ছার অভাব: এদেশের অধিকাংশ লোকের সঞ্চয়ের সামর্থ্য কম, আবার ইচ্ছাও কম। দূরদৃষ্টি ও শিক্ষার অভাব, সুদের স্বল্প হার, কর ব্যবস্থা এবং অদৃষ্টবাদী মনোভাবের কারণে এদেশের জনসাধারণের সঞ্চয় প্রবণতা কম। বরং তারা তাদের স্বল্প উদ্বৃত্ত অর্থ জমি বা অলংকার ক্রয় এবং অন্যান্য অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করে। ফলে প্রকৃত বিনিয়োগ কম হয়।
৩.সঞ্চয় সংগ্রহের অসুবিধা: এদেশে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত সঞ্চয় রয়েছে তা ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগ্রহ করে বিনিয়োগ করা যায় না। কেননা এদেশের গ্রামে-গঞ্জে এখনও পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্যাংকের শাখা নেই। নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাংকের টাকা রাখার অভ্যাসও গড়ে ওঠেনি। সঞ্চয় সংগ্রহের অসুবিধার জন্য এদেশে বিনিয়োগ কম এবং এ জন্য মূলধন গঠন কম।
৪. দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব: সঞ্চিত অর্থ কলকারখানায় বিনিয়োগ করলে মূলধনী দ্রব্য তৈরি হয়। সুষ্ঠুভাবে বিনিয়োগের জন্য দক্ষ উদ্যোক্তা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে দক্ষ উদ্যোক্তার অভাব রয়েছে। ফলে মূলধন গঠন ব্যাহত হয়।
৫. কারিগরি জ্ঞানের অভাব: বাংলাদেশে শ্রমিকদের আধুনিক ও উন্নত কারিগরি জ্ঞানের অভাব রয়েছে। এদেশে উৎপাদনের কলা-কৌশলও পুরাতন। এ কারণে এখানে মূলধন গঠন ব্যাহত হয়।
৬. বিনিয়োগের স্বল্পতা: বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বিনিয়োগ কম হলে কলকারখানায় উৎপাদনও কম হয়। ফলে মূলধন গঠনের হারও কম হয়ে থাকে।
৭. প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশ: মূলধন গঠনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশে অব্যাহত বিনিয়োগ চালু রাখা দরকার। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করে। এ জন্য কলকারখানায়। বিনিয়োগ বিঘ্নিত হয় । ফলে মূলধন গঠনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
উক্ত কারণগুলো ছাড়াও বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক বিনিয়োগের স্বল্পতা, সম্পদের অপচয় এবং অনুন্নত অবকাঠামো কারণে বাংলাদেশের মূলধন গঠন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।