শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী
শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (১৭০৩-১৭৬৩ খ্রি.) তাঁর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ব্যক্তিগত আচরণ ও সামাজিক সংগঠনের প্রকৃতি সম্পর্কে শরীয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা পেশ করেছেন।
তাঁর মতে, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সার্বিক কল্যাণ তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্যে নিহিত। বিনিময়, চুক্তি, মুনাফা, ভাগ, ভাগচাষ ইত্যাদির মাধ্যমে এই সহযোগিতা বিকশিত হয়।
সুদ ও জুয়ার মতো বিষয়গুলো সমাজে সহযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। তাই এগুলো শরীয়াহ্বিরোধী। জনগণের অজ্ঞতা, লোভ ও আশাকে কাজে লাগিয়ে জুয়া থেকে অর্থ আয় করা হয়। এর সাথে মানবিক সহযোগিতা বা সভ্যতার সম্পর্ক নেই। সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারেও তিনি একই রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তাঁর মতে, সভ্যতার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য মানবিক সহযোগিতার কাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন । এই সহযোগিতার ক্ষেত্র রচনার জন্য সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে আবাদী জমি ভাগ করা উচিত। মসজিদের মতোই সমস্ত জমি ভ্রমণকারীদের আশ্রয়স্থল। ‘আগে আসলে আগে পাবে’ নীতির ভিত্তিতে সবাইকে এসব সম্পদে অংশ দিতে হবে। মালিকানার অর্থ হলো সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার।
সরকারী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মত হলো, প্রতিটি সভ্য সমাজের জন্য একটি সরকার থাকবে। সরকার দেশরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ন্যায়বিচার কায়েম ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করবে। জনগণের স্বার্থে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট ও পুল-ব্রিজ নির্মাণ করবে। এ ধরনের কাজ করার জন্য সরকারকে অবশ্যই সামর্থ্যবানদের ওপর কর আরোপ করতে হবে।
তিনি মনে করেন, বিলাসী জীবন সমাজে ধ্বংস ডেকে আনে। ইমাম শাতিবীর মতো তিনিও মানুষের চাহিদাকে প্রয়োজনীয়, আরামদায়ক ও বিলাসমূলক এই তিনটি ক্রমঅগ্রাধিকারে ভাগ করেন। তিনি বলেন, একশ্রেণীর লোকের বিলাস ও ভোগের চাহিদা মিটাতে পৃথিবীর সম্পদ বিলাসদ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহার করার ফলে সাধারণ মানুষের চাহিদা উপেক্ষিত হয়।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ ভারতবর্ষে দশ জন মুঘল শাসকের শাসনকাল প্রত্যক্ষ করেন। মুঘল শাসনের পতনের জন্য তিনি প্রধান দু’টি বিষয়কে দায়ী করেন। প্রথমত অনুৎপাদনশীল কাজে রায় এবং দ্বিতীয়ত চাষী, ব্যবসায়ী ও কারিগরদের ওপর উঁচুহারে কর আরোপ।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন সমকালীনতার প্রভাবমুক্ত একজন যুগোত্তীর্ণ চিন্তানায়ক। এই মনীষী সমসাময়িক মতবাদসমূহের বিভ্রান্তির উর্ধে থেকে নিজের মুক্ত চিন্তা ও বিচার-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে উম্মার প্রধান প্রধান। দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ সমালোচনার মাধ্যমে উম্মার মৌলিক গলদগুলোকে স্পষ্ট করে তোলেন এবং জাতির চিন্তার পুনর্গঠনে তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করেন।
তিনি উপলব্ধি করেন যে, ইসলামের মূল সত্য থেকে বিচ্যুতিই মুসলমানদের পতনের কারণ। তিনি ইসলামী আদর্শ, ভাবধারা ও জীবনবিধানের ভিত্তিতে মুসলিম সমাজ পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করেন। মুসলিম শাসক, আমীর-ওমরাহ, সৈনিক, আলিম, সূফী, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী তথা সকল স্তর ও পেশার মানুষকে তিনি ইসলামের মূল সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানান ।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ উপলব্ধি করেন যে, তাঁর সময়েই যুগের একটি স্পষ্ট বিভাজন ঘটছে। তিনিই প্রথম উল্লেখ করেন যে, মধ্যযুগের অবসান হয়েছে এবং আধুনিক যুগের শুরু হতে যাচ্ছে। এ যুগে শুধু তলোয়ারের মাধ্যমে নয়, কলমের সাহায্যে মুকাবিলার কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। তাঁর এ দূরদৃষ্টিই তাঁকে আধুনিক যুগের প্রবক্তা ও একজন সাচ্চা কলম সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
তিনি ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তার পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি বিশেষ জোর দেন। ইজতিহাদকে তিনি সকল যুগের জন্য ‘ফরযে কিফায়া’ বলে উল্লেখ করেন। ইজতিহাদের নিয়ম-বিধান ও শর্তাবলী রচনা করে এ ক্ষেত্রে তিনি একটি শৃঙ্খলার পথ-নির্দেশ করেন।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে পবিত্র কুরআনের জীবনব্যবস্থা ও ইসলামী জীবনদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেন। ইসলামের নৈতিক, তামুদ্দুনিক ও আইনগত ব্যবস্থাকে তিনি লিখিত আকারে পেশ করার উদ্যোগ নেন।
‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’, ‘ইযালাতুল খিফা’ প্রভৃতি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা ছাড়াও কুরআন-হাদীসের জ্ঞানের সাথে জনগণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে তুলতে তখনকার সামাজিক ভাষা ফার্সীতে আল-কুরআন তরজমা করেন। পবিত্র তিনি কুরআন মজীদের এ তরজমা ছিল সে সময়ের জন্য একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। তিনি হাদীসের প্রথম সংকলিত গ্রন্থ মুয়াত্তা ইমাম মালিক-এর তরজমা করেন। এবং তাতে টাকা সংযোজন করেন। এভাবে কুরআন-হাদীসের শিক্ষাপদ্ধতিতে তিনি ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ ও তাঁর সুযোগ্য পুত্রগণের চেষ্টায় ভারতবর্ষে কুরআন ও হাদীসচর্চা ব্যাপকভাবে শুরু হয়।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ পারিবারিক জীবন সংগঠন, সামাজিক রীতি-নীতি, রাজনীতি, বিচার-ব্যবস্থা, কর-ব্যবস্থা, দেশ-শাসন, সামরিক সংগঠন প্রভৃতি দিক নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন। সমাজ-সভ্যতার বিপর্যয় ও বিকৃতির কারণসমূহের ওপর তিনি গভীরভাবে আলোকপাত করেন। তিনি ইসলাম ও 1 জাহিলিয়াতের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের একটা ধারণাও পেশ করেন এবং খিলাফত ও রাজতন্ত্রের পার্থক্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। জাহিলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের পার্থক্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত কোন ঈমানদারের পক্ষেই নিশ্চেষ্ট বসে থাকা সম্ভব নয়।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইসলামকে মূল ভিত্তিক বিপ্লবী আদর্শরূপেই পেশ করেন। তাঁর মতে, একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ আদর্শ সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হওয়া উচিত। এভাবেই তিনি প্যান-ইসলামিক ধারণার বীজও বপন করেন ।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ সমাজ-সভ্যতার বিপর্যয়ের কারণগুলো চিহ্নিত করে
‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’য় লিখেছেন : ‘কোন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সভ্যতার বিকাশধারা অব্যাহত থাকলে তাদের শিল্পকলা পূর্ণরূপে বিকশিত হয়। তারপর শাসকগোষ্ঠী ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ও ঐশ্বর্যের মোহে আচ্ছন্ন জীবনকে বেছে নিলে সেই আয়েশী জীবনের বোঝা তারা শ্রমিকশ্রেণীর ওপর চাপায়। ফলে সমাজের অধিকাংশ লোক মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হয়। জনগণকে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে জীবন-যাপনে বাধ্য করলে সমাজ-জীবনের নৈতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়। মানুষ তখন রুজি-রুটির জন্য পশুর মতো কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়। এ চরম নির্যাতন ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে আল্লাহর পক্ষ থেকে পথের নির্দেশ আসে। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা নিজেই বিপ্লবের আয়োজন করেন। জনগণের বুকের ওপর থেকে অবৈধ শাসক-চক্রের বোঝা সরানোর ব্যবস্থাও তিনি করেন। রোম ও পারস্যের শাসকরা সে যুলুমবাজির পথেই এগিয়েছিলো। তাদের ঐশ্বর্য ও বিলাসিতার যোগান দিতে গিয়ে জনসাধারণকে পশুর স্তরে নেমে আসতে হয়েছিলো। এ যুলুমশাহীর প্রতিকারের জন্যই আরবের জনগণের মধ্যে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (8)-কে প্রেরণ করা হয়েছিলো। মিসরে ফিরাউন বা ফারাওদের ধ্বংস এবং রোম ও পারস্য সম্রাটের পতন এ নীতি অনুসারে নবুয়াতের আনুষঙ্গিক কর্তব্যরূপে তামিল হয়েছে।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ উপলব্ধি করেন যে, দিল্লীর সম্রাট ও আমীর ওমরাহ এবং হিন্দুস্তানের অন্যান্য শাসকের নৈতিক দেউলিয়াত্ব পারস্য ও রোমসম্রাটদের। কাছাকাছি পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিলো।
শাহ ওয়ালীউল্লাহর বহুমুখী অবদানের কয়েকটি দিক :
১. শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইসলামের ইতিহাস ও মুসলমানদের ইতিহাসের সূক্ষ্ম। প্রভেদরেখাটি উম্মার সামনে স্পষ্ট করে তোলেন। তিনিই প্রথম এটা দেখান যে, মুসলিম ইতিহাস ও ইসলামের ইতিহাস মূলত এক নয়।
২. খিলাফত ও রাজতন্ত্রের মধ্যকার নীতিগত ও পারিভাষিক পার্থক্যকে তিনি । হাদীসের আলোকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেন। সমকালীন রাজতান্ত্রিক। সরকারকে তিনি অগ্নিউপাসক সরকারের সাথে তুলনা করে বলেন, এই দুই সরকারের মধ্যে পার্থক্য হলো মুসলিম রাজতন্ত্রী সরকারের লোকেরা নামায পড়ে, মুখে কালেমা উচ্চারণ করে।
৩. তিনি জাহিলী রাষ্ট্র ও ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্যও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। জাহিলী রাষ্ট্র খতম করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য দায়িত্ব সম্পর্কেও তিনি উম্মাকে সতর্ক ও সচেতন করার চেষ্টা করেন।
৪. শাহ ওয়ালীউল্লাহ মাযহারী অনৈক্যকে সমকালীন মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৌলিক ত্রুটি ও দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, সিরীয় (উমাইয়া) শাসকদের পতনকাল পর্যন্ত কেউ নিজেকে হানাফী বা শাফিয়ী বলে দাবি করতেন না। তারা সকলেই নিজ নিজ ইমাম ও শিক্ষকদের দেখানো পদ্ধতিতে শরীয়তের প্রমাণ গ্রহণ করতেন। কিন্তু ইরাকী (আব্বাসীয়) শাসকদের সময় থেকে প্রত্যেকেই নিজের জন্য একটি মাযহাবী পরিচয় নির্দিষ্ট করে নেয়। তারা নিজ মাযহাবের বড় বড় নেতাদের অনুমোদন ছাড়া কুরআন ও সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতে কোন। সিদ্ধান্ত নিতেও রাজি হতো না। তুর্কী (ওসমানীয়) শাসনামলে লোকেরা বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা নিজ নিজ ফিকহভিত্তিক মাযহার থেকে যা কিছু স্মরণ করতে পারে, সেটাকেই দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে। আগে যেসব বিষয় কুরআন ও হাদীসের উৎস থেকে উদ্ভূত মাযহাব ছিল, এখন তা-ই স্থায়ী সুন্নতে পরিণত হয়।
৫. শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইজতিহাদকে সকল যুগের জন্য ফরযে কিফায়া’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ইজতিহাদের নিয়ম-নীতি,ও শর্তাবলি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন। ইজতিহাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের যমানার নির্বোধ ব্যক্তিরা ইজতিহাদের নামে ক্ষেপে ওঠেন। এদের নাকে উটের মতো দড়ি বাঁধা আছে। এরা জানেন না যে তারা কোন দিকে যাচ্ছেন।
৬. শাহ ওয়ালীউল্লাহ ইসলামের সমগ্র চিন্তা, নৈতিক ব্যবস্থা, তামুদ্দুনিক ব্যবস্থা ও শরীয়ত লিপিবদ্ধ আকারে পেশ করার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর গ্রন্থসমূহের মাধ্যমে ইসলামী দর্শন লিপিবদ্ধ করার ভিত্তি স্থাপন করেন। নৈতিক দর্শনের ওপর তিনি একটি সমাজ দর্শনের ইমারত নির্মাণ করেন।
৭. ভারতের তদানীন্তন সরকারের পরিবর্তে একটি স্বাধীন ইসলামী পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় দীর্ঘ-মেয়াদী গণ-বিপ্লবের কর্মসূচী পেশ করেন। আল-কুরআনের ফার্সী তরজমা ‘ফতহুর রহমান’-এর টীকাতে তাঁর এই কর্মসূচী অধিকতর স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে ।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে দু’শ বছর পর সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯ খ্রি.) লিখেছেন :
একদিকে তাঁর যমানা ও পরিবেশ এবং অন্যদিকে তাঁর অবদান সামনে রাখলে হতবাক হতে হয় যে, সে যুগে এমন গভীর দৃষ্টি, চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের জন্ম কিভাবে সম্ভব হলো! … সে অন্ধকার যুগে শিক্ষা লাভ করে এমন একজন মুক্ত বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন চিন্তানায়ক ও ভাষ্যকার জনসমক্ষে আবির্ভূত হলেন, যিনি যমানা ও পরিবেশের সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চিন্তা করেন। আচ্ছন্ন ও স্থবির জ্ঞান এবং শতাব্দীর জমাটবাধা বিদ্বেষের বন্ধন ছিন্ন করে প্রতিটি জীবন-সমস্যার ওপর গভীর অনুসন্ধানী ও মুজতাহিদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তিনি এমন সাহিত্য সৃষ্টি করে যান, যার ভাষা, বর্ণনাভঙ্গি, চিন্তা, আদর্শ, গবেষণালব্ধ বিষয় ও সিদ্ধান্তসমূহের ওপর সমকালীন পরিবেশের কোন ছাপ পড়েনি। এমনকি তাঁর রচনা পাঠ করার সময় মনে এতটুকু সন্দেহেরও উদয় হয় না যে, এগুলো এমন একস্থানে বসে লেখা হয়েছে যার চারদিকে বিলাসিতা, ইন্দ্রিয়পূজা, হত্যা, লুটতরাজ, জুলুম, নির্যাতন, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার অবাধ রাজত্ব চলছিলো।
মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের ক্রান্তিকালে শাহ ওয়ালীউল্লাহর উচ্চারণ তাঁর শতবর্ষ পরের চিন্তানায়ক কার্ল মার্কসের চাইতেও অধিক বিপ্লবী মনে হয়। কিন্তু জার্মানির ইহুদি পরিবারের সন্তান কার্ল মার্কস কাজ করেছেন তাঁর সময়ের সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র লন্ডনে। তাঁর চিন্তাকে তিনি সে যুগের সবচে আধুনিক গণমাধ্যমের সাহায্যে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ফলে দেশে দেশে বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদিকে শাহ ওয়ালীউল্লাহ কাজ করেছেন একটি পতনমুখী সভ্যতার রাজধানী দিল্লীতে বসে। কোন গণমাধ্যম দূরে থাক, তাঁর আশপাশে তাঁর ধারণাকে হজম করার মতো লোকেরও যথেষ্ট অভাব ছিল। এমনকি তাঁর মূল্যবান গ্রন্থসমূহ মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর দেড়শ’ বছর পর। মৃত্যুর প্রায়
শাহ ওয়ালীউল্লাহ আঠারো শতকে ইসলামী চিন্তা-চেতনার বিকাশে যে ভূমিকা পালন করেন, অনেক পরে হলেও তা উপমহাদেশের ইসলামী চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করেছে। উপমহাদেশে উনিশ শতকের জিহাদ আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলন, সিপাহী বিপ্লব, মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ইসলামী জাগরণকে তার চিন্তা পথ দেখিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় কুড়ি শতকের মধ্যভাগ থেকে ইসলামী অর্থনৈতিক চিন্তা ও ইসলামী ব্যাংকব্যবস্থার বিকাশে উপমহাদেশের চিন্তাবিদগণ বিশিষ্ট ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আল্লামা হিফযুর রহমান, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, ডক্টর ইউসুফ উদ্দীন, ডক্টর আনোয়ার ইকবাল কোরেশী, শেখ মাহমুদ আহমদ, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ডক্টর নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, প্রফেসর খুরশীদ আহমদ, ডক্টর উমর চাপরা, বিচারপতি তাক্বী উসমানীসহ উপমহাদেশীয় মনীষীগণ ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং-এর দিগন্তকে আলোকিত করেছেন।
মুসলিম সভ্যতার পতন ও সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থার উত্থান
মধ্যযুগে পশ্চিমা দুনিয়া যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্রাচ্য ছিল তখন ইসলামের আলোক-প্রভায় উদ্ভাসিত। সপ্তম শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়ে মাত্র একশ’ বছরের মধ্যে ইসলাম অর্ধ পৃথিবীতে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও বস্তুগত উৎকর্ষের জোয়ার সৃষ্টি করেছিল। চৌদ্দ ও ষোল শতকে ইউরোপে যে রেনেসাঁ সৃষ্টি হয়, তার পেছনে ছিল মুসলিম বিশ্বের স্বর্ণযুগের সাফল্যেরই প্রেরণা।
টমাস কার্লাইল, এইচ জি ওয়েলস, এইচ ল্যামেনস, ফন ক্রেমার, জর্জ বার্নাড শ’, ফিলিপ কে হিট্টি, উইলিয়াম ড্রেপার, এডওয়ার্ড গিবন, এইচ আর গিব, আর্নল্ড টয়েনবিসহ বহুসংখ্যক পশ্চিমা পণ্ডিত এবং প্রাচ্যের এম এন রায়সহ বহু গবেষক বিশ্বসভ্যতায় ইসলামের এই অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁদের অনেকে উল্লেখ করেছেন যে, মুসলমানদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেই ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার নেতৃত্ব গ্রহণে সমর্থ হয় 80
জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতার ক্ষেত্রে মধ্যযুগে যে উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন, আল-কুরআন ও রাসূলুল্লাহ এর আদর্শ ছিল তার ভিত্তি মুসলমানগণ ও প্রেরণা। পরবর্তীতে ইসলামী সংস্কৃতি ও জীবনধারার প্রধান উৎস তথা আল শিক্ষার সাথে মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এর ফলে উদ্ভূত নানা অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে এবং বাহ্যিক আগ্রাসনের কুরআনের শিকার হয়ে মুসলমানগণ সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশে নেতৃত্বদানের যোগ্যতা হারান। আদর্শচ্যুত মুসলমানদের এমনি অসংহত, ক্ষয়িষ্ণু ও বিক্ষিপ্ত অবস্থার মধ্যেই তেরো শতকের মধ্যভাগে বাগদাদ ও মধ্য এশিয়া হালাকু খানের হাতে ধ্বংস হয়। বাগদাদের পর কর্ডোভা, দিল্লী, ইস্তাম্বুল ক্রমশ পতনের সম্মুখীন হয়। একের পর এক মুসলমানদের কেন্দ্রগুলির পতন ইসলামের পতন ছিল না। এ ছিল কুরআন-বিচ্যুত, সম্বিতহারা, দিকভ্রান্ত মুসলমানদের পতন।
চৌদ্দ ও ষোল শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁর পর পশ্চিমা নবোদ্ভূত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করে এবং কুরআনের প্রভাবমুক্ত বিকৃত আদর্শের প্রসার ঘটাতে সমর্থ হয়। মুসলমানগণ ইসলামের উদার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উম্মাহ্-চেতনা ও ভ্রাতৃত্ববোধ হারিয়ে ফেলে।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ ও সাবধানবাণী :
“তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)
“তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও পরস্পর কলহ-বিবাদ কোর না; করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে…”। (সূরা আনফাল : ৪৬)
“তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে।” (সূরা আলে ইমরান : ১০৫)
ঐক্য ও সংহতির নির্দেশ এবং বিচ্ছিন্নতা ও কলহ-বিবাদের পরিণাম সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের এসব সাবধানবাণীর পরও মুসলমানরা অনৈক্য ও আত্মবিধ্বংসী ঘরোয়া হানাহানির শিকার হন। ভৌগোলিক জাতীয়তার ধারণা ও ইসলাম পরিপন্থী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের কাছে তারা আত্মসমর্পণ করেন । ত্যাগ- তিতিক্ষা, সংগ্রাম ও সাহসের ঐতিহ্য ভুলে তারা ভোগবাদী জীবনধারায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। সর্বোপরি দেশে দেশে মুসলিম শাসকগণ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুলে পরিণত হন। মুসলমানগণ ইসলামী আদর্শ অনুসরণের কারণেই একসময় সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু আদর্শিক বিচ্যুতি তাদের পতনের পথ প্রশস্ত করে। খিলাফতের আদর্শ ছেড়ে মুসলিম শাসকগণ রাজতন্ত্রের পথ ধরেন। এ পথে তাদের রাজনৈতিক পতন ত্বরান্বিত হয়। চিন্তার ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্ব নেমে আসে। ইসলামের নৈতিক প্রেরণা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে বস্তুগত উন্নতির সকল চারিও তাদের হাতছাড়া হয়। মুসলমানদের এ পতনযুগে তাদের চারদিকে এর নতুন সভ্যতার উত্থান ঘটে। সে সভ্যতার লক্ষ্য, আদর্শ ও বাণী মুসলমানদের সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনবোধ, জীবনধারা ও আদর্শিক কাঠামোর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ।
পশ্চিমা এ নতুন জড়বাদী ও ভোগবাদী সভ্যতার সবচে’ শক্তিশালী হাতিয়ার ও শোষণযন্ত্ররূপে হাজির হলো সুদভিত্তিক ব্যাংকব্যবস্থা। ইহুদিরাই প্রথমে ব্যাংক ব্যবসায়ে সুদের প্রবর্তন করে। খ্রিস্টানরা গোড়াতে এর বিরোধিতা করে। কিন্তু পরে তারাও শোষণমূলক এই সুদী কারবারে জড়িয়ে পড়ে।
সুদের ক্লাসিক্যাল তত্ত্বের প্রবক্তা অ্যাডাম স্মীথ ও রিকার্ডো। তাদের মতে, সুদ হলো বিনিয়োগকৃত মূলধনের উপর নির্ধারিত হারে আয়। এই তত্ত্বে সুদের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো, জমির উপর খাজনা ধার্য করা গেলে মূলধনের উপরও সুদ থাকা উচিত।
তার বিপরীতে ইসলামী অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য হলো মূলধন বিনিয়োগ না করে শুধু টাকার উপর সুদ ধার্য করা ইনসাফের পরিপন্থী। তাদের মতে, অর্থ বিনিয়োগ না করা পর্যন্ত এর কোন ব্যবহারিক উপযোগিতা থাকে না। অর্থ বিনিয়োগ করা হলেই এর সাথে অন্তর্নিহিত ঝুঁকির প্রশ্ন চলে আসে। তাই ঝুঁকিতে অংশগ্রহণ না করে শুধু অর্থের বাহ্যিক মূল্যের উপর অতিরিক্ত দাবি করা যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না।
ক্ল্যাসিক্যাল থিওরিতে ধরেই নেওয়া হয় যে, ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকায় লাভবান হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এ ধারণা অবাস্তব হতে পারে। প্রত্যেক ঋণগ্রহীতাই ঋণের টাকায় মুনাফা লাভ করে না। মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে ঋণের মাধ্যমে লাভের দিকটি অবান্তর। ব্যবসায়েও সব সময় লাভ হয় না। লাভ হলেও সব সময় তার পরিমাণ সমান নয়। কিন্তু লাভ হোক বা না হোক, সুদের হার নির্দিষ্ট। লোকসান হোক কিংবা লাভ হোক, সব ক্ষেত্রে সুদ প্রায়শই অপরিবর্তিত থাকে। এজন্য এটি স্বভাব ও প্রকৃতির বিরোধী। সে কারণে তা বেইনসাফী ও যুলুমের নামান্তর। সুদের হার সঞ্চয়ের পরিমাণ নির্ধারক হওয়ার ধারণাটিও ভুল। কেননা, সুদের হার নয়, আয়ের পরিমাণের উপরই সঞ্চয় নির্ভরশীল। এ ছাড়া, সকল সঞ্চয় বিনিয়োগ না-ও হতে পারে। ক্লাসিক্যাল সুদতত্ত্বে মূলধনকে বাজারের অন্যান্য উপকরণের মতো বিবেচনা করা হয় এবং সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়- যা সুদের হার বলে বিবেচনা করা হয়। এই মতবাদে সুদের হারই সঞ্চয়কে উৎসাহিত করে এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে। জন ম্যানাড কীস এই ধারণার বিরোধিতা করে বলেন, সুদের হার নয়, বরং জায়ের পরিমাণই সঞ্চয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে।
সুদের এবস্টিন্যান্স থিওরির প্রবক্তা উইলিয়াম সিনিয়র। তাঁর মতে, ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাকে টাকা দিয়ে নিজে ভোগে বিরত থাকে বা ত্যাগ স্বীকার করে। এ কারণে ঋণদাতাকে ঋণগ্রহীতার সুদ দেয়া উচিত। মার্শাল বলেছেন, ঋণ দিয়ে অপেক্ষায় থাকার জন্য এ সুদ ।
সুদের উৎপাদনশীলতা তত্ত্বের ( Productivity Theory) প্রবক্তা বহাম বেওয়ার্ক-এর মতে, মূলধনের উৎপাদন-ক্ষমতার জন্য সুদ দেয়া উচিত। বহাম বেওয়ার্ক-এর চিন্তাধারাপ্রসূত অস্ট্রিয়ান বা ওগিয় থিওরি অনুসারে সমকালীন উৎপাদন, যা পরবর্তী উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয় তা-ই মূলধন। সুদ হচ্ছে এই মূলধনের অন্তর্বর্তী সময়ক্ষেপণের মূল্য। ভবিষ্যতের চেয়ে বর্তমানই মানুষের অধিক পছন্দ ও ভাবনার বিষয় বলে তিনি সুদকে একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, বর্তমান পণ্য সব সময়ই ভবিষ্যত পণ্য থেকে অগ্রাধিকার প্রাপ্য। কাজেই ভবিষ্যত পণ্যকে বর্তমানে রূপান্তরের জন্য অবশ্যই একটি ধনাত্মক সুদের হার থাকা উচিত।
উৎপাদনশীলতা তত্ত্বের বিপরীতে বলা হয়েছে, শ্রম ও ক্ষেত্র ছাড়া মূলধনের কোন একক উৎপাদন-ক্ষমতা নেই। সে কারণে মূলধনের জন্য নির্দিষ্ট হারে সুদ নির্ধারণ অযৌক্তিক। সুদের প্রান্তিক তত্ত্বও সুদের হার নির্ধারণ করতে অসমর্থ । বরং মূলধনের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা সুদের হার দ্বারাই নির্ণীত হয়।
এ থিওরিগুলোতে সুদের হার নির্ধারণের চাইতে সুদের কারণ সন্ধানে অধিক মনোযোগ দেয়া হয়েছে। তাই এগুলোকে অমুদ্রা তত্ত্ব (Non Monetary Theory) বলা হয় ।
অন্যদিকে রয়েছে সুদের কয়েকটি মুদ্রা তত্ত্ব (Monetary Theory)। এসব তত্ত্বে সুদকে একটি প্রয়োজনীয় আর্থিক বিষয় মনে করা হয়। এগুলোর প্রতিপাদ্য সুদের অস্তিত্বের কারণ বা যৌক্তিকতা নির্ধারণ নয়; বরং সুদের হার নির্ধারণ।
লর্ড কীনসের চিন্তাধারাপুষ্ট ঋণযোগ্য তহবিল ও তারল্য অগ্রাধিকার তত্ত্ব ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। কানস কখনও সুদকে ব্যবহারিক বিষয় বলেছেন। আবার কখনও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বলেছেন। এ দোলাচলের মধ্যে একান্ত অল্প হারের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি সুদহীন অর্থ সম্ভাব্যতার স্বীকার করেছেন। অর্থনীতিতে বিনিয়োগ সর্বাধিক করার উপায় হিসেবে তিনি সুদের শূন্য হারকে চিহ্নিত করেছেন। সুদের
ভিন্ন ভিন্ন আয়সম্পন্ন বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভোগে বিরত থাকা, অপেক্ষা করা বা ক্যাগের পরিমাণ নির্ধারণ সম্ভব হয়নি বলে প্রাগ্রসর অর্থনীতিবিদদের নিকট এবস্টিন্যান্স থিওরি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
অস্ট্রিয়ান বা ওগিয় থিওরির বিপরীতে প্রাগ্রসর অর্থনীতির প্রবক্তাদের মত হচ্ছে অধিকাংশ লোকই শিক্ষা, বার্ধক্য বা বিয়ের জন্য ভবিষ্যতের প্রয়োজনে সঞ্চয়ে উৎসাহী। সুতরাং এ মতও ভ্রান্তির ওপর ভিত্তিশীল। এ মতের প্রবক্তাগণ সুদের হার নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন; কিন্তু সুদকে ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক বলে প্রমাণ করতে পারেননি।
অমুদ্রা তত্ত্ববাদে মুদ্রাতত্ত্বে সুদকে প্রয়োজনীয় আর্থিক বিষয় মনে করা হলেও এটি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। কারণ সুদের যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারলে তার হার নির্ধারণের প্রশ্নও আসে না। কেননা, সুদের বিষয়টিই অর্থনীতিবিদদের কাছে মীমাংসিত নয়।
যাহোক, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী চিন্তার উন্মেষযুগে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ১১৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভেনিসে প্রথম আধুনিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৪০১ সালে বার্সেলোনায় দীর্ঘ প্রায় আড়াইশ’ বছর পর প্রতিষ্ঠিত ‘ব্যাংক অব ডিপোজিট’ আধুনিক ব্যাংকের তালিকায় একটি উল্লেখযোগ্য নাম। স্বীকৃত প্রথম আধুনিক ব্যাংকরূপে ১৫৮৭ সালে ভেনিসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্যাংক ডেল্লা পিজা দ্য রিয়ালটো’। ১০
এরপর ১৬০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ডাচ আমস্টার্ডাম ব্যাংক’। এটি ইউরোপে আধুনিক ব্যাংকিং-এর মডেল হিসেবে কাজ করেছে