হিন্দু ধর্ম কী? হিন্দু ধর্ম এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ।
হিন্দু ধর্ম কোন মহাপুরুষের মাধ্যমে কখন, কোথায় সূচিত হয়েছিল সে বিষয়ে ঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। এটি প্রাচীন ধর্মসমূহের অন্যতম। ১৩ হাজার হাজার বছরের প্রাচীন বলে এর অন্য নাম সনাতন ধর্ম। প্রাচীন কালে এটি আর্যধর্ম নামে পরিচিত ছিল। বেদ এই ধর্মের মূল বলে একে বৈদিক ধর্মও বলা হয়।
মধ্য দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চল থেকে আর্য জাতি গোষ্ঠীর আগন্তকরা প্রথমে ‘ইন্ডাস’ (সংস্কৃত ভাষায় সিন্ধু) নদের উপকূলে এসে বসবাস শুরু করে। তারা ‘স’ কে ‘হ’ উচ্চারণ করায় ‘সিন্ধু’ হিন্দু উচ্চারিত হয়। এই নদীর উভয় পাশে বা সপ্তসিন্ধু (হপ্তহিন্দু) প্রদেশে বসতি 8 স্থাপনকারী আর্যদের নাম হয় হিন্দু। তারা বেদমন্ত্রের অনুসারী ছিল।
ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্ম এর সূচনা হয় খ্রিষ্টপূর্ব পনের শতকের দিকে। আর্যরা হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে ক্রমান্বয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে বিদ্যমান ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্মাচার, প্রাচীন পারসিকদের ধর্মরীতিসমূহ এবং সামাজিক উপাদানসমূহের বৈদিক সংমিশ্রণে হিন্দু ধর্ম এর বিকাশ শুরু হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ বছর আগে আর্য জাতি ভারতবর্ষে প্রবেশেরও পূর্বে সিন্ধু অববাহিকায় প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে আর্যদের নিয়ে আসা ধর্ম বিশ্বাসের বিযুক্তিতে হিন্দুত্বের উদ্ভব। সেই দৃষ্টিকোন বিচারে হিন্দুইজম পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ সনাতন ধর্মাচার ।
ঐতিহাসিকদের মতে ইন্দো-ইরানিয়ান সম্পর্ক ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনেরও আগের প্রাচীনতম সম্পর্ক। ইসলামের দৃষ্টিতে হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর পিতা আযর একজন মূর্তি নির্মাতা প্রকৃতি পূজারী ইরাকের অধিবাসী ছিলেন। তারও আগে হযরত নূহ (আঃ) এর সময় মূর্তিপূজার সূচনা লক্ষ্য করা যায়। নূহ (আ:) এর ধর্মের বিরুদ্ধাচারণের কারণে মহাপ্লাবন সংঘটিত হয়। প্লাবন উত্তরকালে তিনি তাঁর তিন পুত্র হাম কে নীলনদের পশ্চিম দক্ষিণাঞ্চলে, সামকে পূর্বাঞ্চল এবং সম্ভবত: ইয়াফাগকে উত্তর পশ্চিমাঞ্চল বণ্টন করে দিয়েছিলেন।
হামের বংশধরদের মধ্যে প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা, সামের বংশধরদের মধ্যে মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং ইয়াফাসের বংশধরদের মধ্যে প্রাচীন রোমান ও গ্রীক সভ্যতার পত্তন হয়। এই সব সভ্যতায় প্রকৃতি পূজার যে নির্দেশাবলীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তা হরপ্পা মহেঞ্জাদারোর সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং অনুমান করা যায় যে আর্য ধর্ম সংস্কৃতি উল্লেখিত সভ্যতাসমূহের সংস্করণ এবং হিন্দু ধর্ম এর উৎস। সেই বিচার হিন্দুইজম সনাতন ধর্ম।
হিন্দু ধর্ম এর গ্রন্থসমূহ
বেদ: প্রত্যেক ধর্মানুসারী নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থকে ঈশ্বরবাণী রূপে শ্রদ্ধা ও ধর্মের মূল ভিত্তিরূপে গণ্য করে। ধর্মগ্রন্থগুলো ঈশ্বর বা ঈশ্বরের দূত কর্তৃক প্রেরিত হলেও বেদের আবির্ভাব ‘ভিন্নরকম। ঈশ্বরের জ্ঞানরূপে বেদ স্বপ্রকাশিত, আদি ও অন্তহীন। বেদ অর্থজানা (বিদ অর্থ যিনি জানে যেমন-ভাষাবিদ)। যুগ যুগ ধরে মুনি ঋষিগণ যে জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন বা আবিষ্কার করেছেন তাই বেদ। প্রাচীন কালে এগুলো স্মৃতিতে সংরক্ষিত ছিল এবং মনীষী পরম্পরায় তা শ্রুত হয়ে আসছিল। তাই এর আর এক নাম শ্রুতি। সন্ধান পাওয়া বেদের সকল ঋষির নাম জানা যায়নি। কেবল
- মনু,
- যাজ্ঞবল্ক্য,
- বিশ্বামিত্র,
- ভরদ্বাজ,
- বিশ্ববারা ও
- লোপা মুদ্রার মত চার জন পুরুষ ও দুই জন মহিলার নাম প্রসিদ্ধ।
বেদের চারটি খণ্ড রয়েছে যথা
১. ঋকবেদঃ জাগতিক ও মহাজগতিক বিষয়াবলীর জ্ঞান।
২. যজুর্বেদ: বৈদিক যাগযজ্ঞ ও পূজা পার্বণের বিধান।
৩. সামবেদঃ ইহ জাগতিক মোহমুক্তি তথা ‘মোক্ষ’ লাভের জন্য প্রার্থনা, উপাসনা ধ্যান ও মন্ত্র জ্ঞান। এটি মূলত: প্রার্থনা সঙ্গীত।
৪. অথর্ববেদ : ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জ্ঞানই হল অথর্ববেদের উপজীব্য বিষয়
উপনিষদ
বেদের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ অপর ধর্মগ্রন্থ হল উপনিষদ। যে জ্ঞানের মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্ধান পাওয়া যায় তাই উপনিষদ। এটি বেদের সারাংশ বলা যায়।
স্মৃতি
ঋষি, মনু, যাজ্ঞবল্ক্যগণ কর্তৃক জীবন নির্বাহ প্রণালীই হল স্মৃতি শাস্ত্র। উপদেশ, আইন, নৈতিকতা, চিকিৎসা, সমরবিদ্যা, শিল্পবিজ্ঞান, সঙ্গীত শাস্ত্র প্রভৃতি এর অন্তর্ভুক্ত।
পুরাণ
বেদের ভাষাকে সহজবোধ্য করার লক্ষ্যে ধর্মকে সাধারণের কাছে পরিচিতকরণের কাহিনী রূপককেই পুরাণ বলা হয়। পুরাণ গ্রন্থসমূহের ১৮টি মূল সংখ্যা রয়েছে। যেগুলোর রচনা কাল খ্রিষ্টীয় পঞ্চম থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
কৃষ্ণকে বিষ্ণুর অবতার মনে করে ভগবানরূপে সম্বোধন করা হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মুখনিঃসৃত বাণীই গীতা। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটিকে সর্বোত্তম পবিত্রতম ধর্মগ্রন্থ গণ্য করা হয়।
রামায়ণ
এটি মানবজাতির ইতিহাস গ্রন্থ। প্রাচীন ভারতীয় সূর্যবংশীয় রাজাদের কাহিনী অবলম্বনে খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহাকবি বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য। অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্রের জীবন কাহিনী নিয়ে সাত খণ্ডে বিভক্ত বিশাল গ্রন্থ।
মহাভারত
চন্দ্র বংশীয় কুরু-পাণ্ডবদের ভ্রাতৃবিদ্বেষ ও যুদ্ধকে উপজীব্য করে ঋষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য। এখানে সত্যের জয় এবং মিথ্যার পরাজয় দেখানো হয়েছে।
হিন্দু দেব-দেবী
হিন্দু ধর্ম আবলম্বীগণ অসংখ্য দেব-দেবীর পূজা অর্চনা করে থাকেন। মানবাকৃতি পণ্ড আকৃতি এবং অর্ধ মানুষ ও অর্ধপশু আকৃতির দেব-দেবী রয়েছে। যাদের পূজা করা হয় নিজ গৃহে অথবা মন্দিরে। এক এক দেব-দেবী এক এক শক্তি বা ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি। দেবতাকে কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তব আকারে নিয়ে আরাধনা করলে একনিষ্ঠতা ও উপলব্ধি প্রগাঢ় হয়। উল্লেখযোগ্য দেব-দেবী হল:
ক. ব্ৰহ্মা
হিন্দু ধর্ম এ মহাত্রিদেবতার মধ্যে প্রভু ব্রহ্মা হলেন প্রধানতম। তিনি অসীম অবিমিশ্র, চিরন্তন, সর্বত্রবিরাজমান এক নৈর্ব্যক্তিক শক্তি। তিনিই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। চতুর্মুক, চতুর্ভূজ ও হংস বাহনরূপে কল্পিত।
খ. বিষ্ণু
ভগবান বিষ্ণু সমগ্র সৃষ্টির রক্ষা ও পালনকর্তা। চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা (গুগুর) ও পদ্ম নিয়ে গরুর পাখি বাহনে উপবিষ্ট কল্পনা করা হয়। পৃথিবীতে সৃষ্টি রক্ষাকল্পে বিষ্ণু দশবার দশরূপে আবির্ভূত হন। তাই তাকে বলা হয় দশাবতার।
গ. শিব
অন্যতম প্রধান দেবতা হল শিব যার কাজ ধ্বংস সাধন করা। ১১ পৌরাণিক শিব ও বৈদিক রূদ্র এক অভিন্ন। শিব অল্পতেই তুষ্ট আবার অল্পতেই রূষ্ট হন। তাই তাকে ভোলানাথও বলা হয়। শিব মূর্তির পরিবর্তে শিবলিঙ্গ পূজা হয়ে থাকে। এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণ, দূর্গা, গণেশ, কার্তিক, বিশ্বকর্মা, স্বরস্বতী, কালী, লক্ষ্মী প্রমুখ বিশিষ্টদেব-দেবীর অন্তর্ভুক্ত।
বৈষ্ণব ধর্ম মতবাদ
মানবজাতির প্রতি রাধার সঙ্গে ঈশ্বরের অবতার কৃষ্ণের প্রেমতত্ত্বের মধ্য দিয়ে বৈষ্ণব মতবাদ একটি নতুন পথের সন্ধান দেয়। শ্রী চৈতন্যদেবসহ ষড়গোষ্ঠী ঈশ্বর প্রেমে মানুষকে জাগরিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
ব্রাহ্মসমাজ
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে রাজা রাম মোহন রায় মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে খ্রিষ্ট ও ইসলাম ধর্মের একেশ্বরবাদের সুসমন্বয়ে অসাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২৮ সালে তিনি ব্রাহ্মসভা পরে ব্রাহ্মসমাজ নামে ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক কবি ব্যক্তিত্ব এই সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন।
জৈন ধৰ্ম
হিন্দু ধর্ম এর বৈদিক ও পুরাণের কঠোর আচার-নিষ্ঠা, পূজা-পার্বণ ও জীবহত্যার বিরোধিতায় হিন্দু সমাজের মধ্য থেকেই জৈন মতবাদের উদ্ভব হয়। জৈন শব্দ (সংস্কৃত ‘জিয়ে’)-এর অর্থ জয় করা। হিংসা, ক্রোধ, লোভ-লালসা ও জাগতিক আকর্ষণকে জয় করে কঠোর কৃচ্ছ্রব্রত পালনের জন্য যে জৈন বিশ্বাস শৃঙ্খলায় কাতারবদ্ধ হতে পারবে সেই জৈন বা বিজয়ী
‘ভদ্রমনা’ যিনি ‘মহাবীর’ (Great Hero খ্রি:পূ: ৫৯৯-৫২৭) নামে খ্যাত চব্বিশজন তীর্থঙ্করের সর্ব কনিষ্ঠজন জৈনধর্মের প্রবর্তক সিদ্ধপুরুষ। প্রথম তীর্থাঙ্কর রসবাদের কর্তৃক সূচিত হয়ে পরেশনাথ (বেনারসে ৮১৭ খ্রিঃ পূর্বাব্দে জন্ম) কর্তৃক ‘পার্শ্বনাথা’ নামক একটি মতবাদ (৭৭৬ খ্রিঃপূর্ব) পত্তন হয়েছিল মহাবীরের জন্মের পূর্বে। তিনি সন্ন্যাসব্রত পালনকারী এক নাগাড়ে ৮৪ দিন ধ্যানমগ্ন থেকে পরম জ্ঞানের সন্ধ্যান লাভ করেন। তারই পথ ধরে সন্ন্যাসব্রতচারী মহাবীর জৈন ধর্ম প্রবর্তন করেন। মৌর্য রাজবংশের (খ্রিঃপূঃ ৩২১-১৮৫) প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্র গুপ্ত ও সম্রাট অশোকের উদার ধর্মনীতির প্রভাবে জৈন ও সমসাময়িক বৌদ্ধধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। মৃত্যুর পর (খ্রিঃ পূঃ ৫২৭) জৈন ধর্ম ‘স্বেতাম্বর’ ও ‘দিগাম্বর’ দু’ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়।
জৈন ধর্মের মূল কথা হলো, চৈতন্যময় জীবে ও অচৈতন্যময় জড়ে আত্মার অস্তিত্ব আছে। আত্মা দেহাতিরিক্ত চৈতন্যময় এক সত্তা। মানুষ কঠোর কৃচ্ছসাধনের মাধ্যমে আত্মার দেহাবরণ অতিক্রম করে অবিনশ্বরতায় পৌছার প্রচেষ্টায় জয়ী হতে পারে। ব্যক্তিই স্বয়ং সুখ ও দুঃখের সৃষ্টিকারক ও বিনাশক। ঈশ্বর হচ্ছে ব্যক্তির মাঝে সুপ্ত ভাবে অবস্থানরত সামাজিক শক্তির প্রকাশ যা ব্যক্তিকে চূড়ান্ত নির্বাণ লাভে নির্মোহ জীবন যাপনে উৎসাহিত করে।
জাগতিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন ‘সম্যক দর্শন’ ও ‘সম্যক কৃত্য’ পবিত্রতা, পাপমুক্তি ও আত্মার নির্বাণ লাভ জৈন ধর্মের মূল লক্ষ্য। এখানে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে মিল পরিলক্ষিত হয়। জৈন ও বৌদ্ধ উভয় ধর্ম ঈশ্বর সম্পর্কে নীরব।
শিখ ধর্ম
‘শিখ’ শব্দটি সংস্কৃত ‘শিষ্য’ অথবা পাঞ্জাবী ভাষা শিখুনা’ বাংলা ‘শিক্ষাগ্রহণ’ থেকে উৎসারিত হয়েছে। নানকের শিষ্য বা অনুসারীদেরকেই প্রথম দিকের শিখ বলা হয়ে থাকে। পঞ্চদশ শতাব্দির শেষের দিকে এক দল হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে এই ধর্মাবলম্বীদের উৎপত্তি। তারা মনে করেন হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মের মিলন সম্ভব। হিন্দু ধর্ম এর বহু ঈশ্বরবাদ ও বর্ণবাদ পরিহার করে ইসলামের অনেক বিধান পালনীয় বলে তারা গ্রহণ করেন। এই ধর্মের সূচনা লগ্নে শিখ বলতে শুধু অনুসারী ব্যতীত অন্যকিছু না বুঝালেও পরবর্তীতে নিজস্ব পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সুনির্দিষ্ট আচার পদ্ধতি নিয়ে ‘শিখ’ একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় রূপ পরিগ্রহ করে
ধর্ম প্রবর্তক
শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের লাহোর নগরীর তালওয়ান্দি (বর্তমান নাম নানকা সাহিব) ক্ষত্রিয় হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শ শৈশব থেকেই সাধু সন্ন্যাসীদের সাহচার্যে দীর্ঘ সময় ব্যয় করায় তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। বৈবাহিক ও সাংসারিক জীবনের নানা ব্যস্ততার মধ্যেও তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা তাঁকে বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দান করে। নানক তাঁর চাকুরীদাতা স্থানীয় শাসক দৌলতখানের সুলতানপুর গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত রাভী নদীতে পূণ্য স্নানে গিয়ে তিন দিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যান। দৌলতখান নানকের সন্ধ্যানে নদীর দু’কূলে তল্লাশী চালিয়েও যখন ব্যর্থ মনোরথ ঠিক তখনই তিন দিন পর তিনি নিজ পরিবারে প্রত্যাবর্তন করে একদিন নিঃশ্চুপ থেকে ঘোষণা করলেন “ঈশ্বর হিন্দুও নয়, মুসলিমও নয়। ঈশ্বরের পথই আমার পথ।” ত্রিশ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় দীক্ষা প্রদান শুরু করেন। তিনি জন্মগত ভাবে হিন্দু হয়েও বর্ণবাদ, বহুঈশ্বরবাদ অনুষ্ঠান সর্বস্বতা পরিহার করে ইসলামের অনেক বিধান পালনীয় রূপে গ্রহণ করেন।
কুড়ি বছর দেশ বিদেশ পরিভ্রমণ করে তিনি নারী পুরুষকে যে ঈশ্বরের পথে আহবান করেছিলেন তা একটি স্থায়ী কাঠামোর উপর দাঁড় করানোর জন্য ‘স্যাংগাত” নামক সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাভী নদীর তীরে কর্তারপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি এখানে একটি ‘ধর্মশালা নির্মাণ করেন যা ‘গুরু দুয়ারা’র পূর্ব নাম। তিনি ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন।
শিখ ধর্মে সর্বমোট দশজন গুরু রয়েছেন। যথাঃ
১. গুরু নানকচান্দ (কবির নানক)( ১৪৬৯-১৫৩৯ খ্রিঃ)
২. গুরু অঙ্গত (জন্ম ১৫০৪, গুরুকাল ১৫৩৯-১৫৫২ খ্রিঃ)
৩.গুরু অমর দাস (জন্ম ১৪৭৯, গুরুকাল ১৫৫২-১৫৭৪ খ্রি:)
৪.গুরু রাম দাস (জন্ম ১৫৩৪, গুরুকাল ১৫৭৪-১৫৮১ খ্রিঃ)
৫.গুরু অর্জন দেব (জন্ম ১৫৬৩, গুরুকাল ১৫৮১-১৬০৬ খ্রিঃ)
৬. গুরু হরগবিন্দ (জন্ম ১৫৯৫, গুরুকাল ১৬০৬-১৬৪৪ খ্রি:) ৬.
৭. গুরু হরি রায় (জন্ম ১৬৩০, গুরুকাল ১৬৪৪-১৬৬১ খ্রি:)
৮. গুরু হরি কৃষাণ (জন্ম ১৬৫৬, গুরুকাল ১৬৬১-১৬৬৪ খ্রি:)
৯.গুরু ত্যাগ বাহাদুর (জন্ম ১৬২১, গুরুকাল ১৬৬৪-১৬৭৫ খ্রি:)
১০. গুরু গোবিন্দ সিং (জন্ম ১৬৬৬, গুরুকাল ১৬৭৫-১৭০৮ খ্রি:) ৯৮
গুরু গোবিন্দ সিং পাঁচ শিষ্যকে দীক্ষা দিয়ে তাদের সিংহ নামকরণ করেন। শিখেরা এখন সিং নামেই খ্যাত। গোবিন্দ সিং এর শিষ্যদের নিয়ে একটি ‘খালসা’ (পবিত্র) গোষ্ঠীর প্রবর্তন করেন। তিনি আর কোন গুরু নির্বাচিত না হওয়ার এবং গ্রন্থ সাহেবকেই চিরকালের বলে স্বীকার করার জন্য নির্দেশ দেন।
ধর্ম গ্রন্থ
শিখ ধর্মগ্রন্থের নাম ‘গুরুগ্রন্থ সাহিব’।” গুরু নানকের রচিত প্রার্থনা এ গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। শিখ ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো দু’ভাগে বিভক্ত প্রথম ‘ভাষাগ্রন্থ সাহিব’ এবং দ্বিতীয় ভাগ ‘আদিগ্রন্থ’। পঞ্চমগুরু অর্জন ‘গুরুগ্রন্থ সাহিব’ প্রথম সংকলন করেন। তাঁর স্ব রচিত প্রার্থনাগুলো ‘দশম গ্রন্থ’ নামক এক গ্রন্থে সংকলিত আছে। ‘গুরুগ্রন্থ সাহিবের’ সর্ব শেষ সংকলন হয় দশম গোবিন্দ সিং এর হাতে। অর্জন সিং এর ‘দশম গ্রন্থ’ যা ‘আদি গ্রন্থ’ নামে পরিচিত তাতে নানক, অঙ্গত, অমর দাস ও রাম দাস রচিত প্রার্থনা, কিছু হিন্দু ও মুসলিম ভক্তের প্রার্থনা ও তাঁর রচিত কিছু প্রার্থনা গীতি সংকলিত হয়েছে। দশম গুরু গোবিন্দ সিং ঘোষণা করেন যেহেতু আর কোন গুরুর আবির্ভাব হবে না সেহেতু ‘আদিগ্রন্থ’ তার উত্তরসূরী এবং সেই থেকে ‘আদি গ্রন্থ’ ও ‘গুরুগ্রন্থ সাহিব’ যুগপৎ অভিন্ন অর্থে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
উপাসনা ও উপাসনালয়
গুরু নানক রাভী নদীর তীরে কর্তারপুরে একটি ‘ধর্মশালা’ নির্মাণ করেছিলেন যা ‘গুরু দুয়ারা’র পূর্ব নাম। সেখানে সঙ্গীত ও স্তোত্রগীতের মাধ্যমে ধর্মালোচনা হতো। অপরাহ্নে Sodar ও আরতি গীত হতো এবং প্রভাতে Japji আবৃত হতো। তাদের উপাসনালয়ের নাম ‘গুরুদুয়ারা’। গুরু অমর দাস সর্বক্ষণ নামজপের প্রবর্তক পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরেঅপরূপ স্বর্ণ মন্দির নির্মাণ করেন। গুরু অর্জন দেব শিখ ধর্মের সর্ববৃহৎ পবিত্র মন্দির হারমন্দির (গোল্ডেন টেম্পল) এর ভিত্তি স্থাপন করেন। এখানে ‘গুরুগ্রন্থ সাহিব’ এর মূল কপি সংরক্ষিত আছে। তাই একে ‘দরবার সাহিব’ও বলা হয়ে থাকে। এই মন্দির চত্বরের চারিদিক জলাধার বেষ্টিত। এখানে ‘খালসা’ বা পবিত্রকরণ দীক্ষা দেওয়া হয়। খালসা দীক্ষা গ্রহণকারীকে পাঁচটি ব্রত পালনের প্রতিজ্ঞা করতে হয় যা নিম্নরূপ: ১০০
১. কেশ (Kes) : চুল-দাড়ি না কাটা,
২. কাঙ্গা (Kanga): চিরনি, ৩. কিরপান (Kirpan) : ছোট তরবারী,
৪. কারা (Kara) : কবজিতে থাকা লোহার চুড়ি,
৫. কাচ্চা (Kacha) : ছোট অন্তর্বাস।
সেই সঙ্গে ঘোষণা করতে হয়
- ক) জীবনে নিশা বা উত্তেজক দ্রব্য গ্রহণ করবেনা। খ) শরীরের কোন লোম কর্তন করবে না।
- গ) উৎসর্গীকৃত পশুর মাংস খাবে না।
- ঘ) বিবাহ বহির্ভূত যৌনকর্মে লিপ্ত হবে না।
সমবেতভাবে ‘গুরুগ্রন্থ সাহিবে’র দিকে মুখ ফিরিয়ে ‘গ্রন্থ সাহিবে’র নির্দৃষ্ট কবিতা, শ্লোক বা স্তোত্রগীত কোন ‘সাঙ্গাত’ (পাঠক) কর্তৃক পঠিত হয় এবং ‘রাগিস’ (বাদক) সঙ্গীত যন্ত্রিদের সুরের মূর্ছনায় প্রার্থনা সম্পাদিত হয়। তাদের কোন পুরোহিত নেই। দুয়ারার সেবক শ্রেণীকে ‘গ্রন্থি’ বলা হয়। তাদের মধ্য থেকেই কেউ না কেউ প্রার্থনা পরিচালনা করে থাকে।
তাদের পাঁচ সদস্যের শীর্ষ ধর্ম পরিষদের নাম ‘আকাল তখত’ স্বর্ণ মন্দিরে অবস্থান করে। তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই সবার জন্য বাধ্যতামূলক। শিখদের বিশেষ প্রার্থনার নাম Ardas । যে ‘গ্রন্থি’ এটা পরিচালনা করেন তিনি ‘মানজি সাহিব’ নামে অভিহিত। তিনি উচ্চস্বরে গ্রন্থ সাহিব থেকে পাঠ করেন আর উপস্থিত সদস্যরাও তা উচ্চারণ করে। ঈশ্বরের কাছে দীনভাবে বিনয় প্রকাশক শ্লোক পঠিত হয়। প্রার্থনা শেষে লঙ্গর খানায় খাবার খেতে হয়।
আনন্দ ফারাজ বা বিবাহ উৎসব
তাদের বিবাহ উৎসব হিন্দু রীতির প্রায় অনুরূপ।
মৃত দেহ সৎকার
হিন্দু দাহ প্রথার অনুরূপ।
নির্বাণ বা মুক্তি
ঈশ্বর এক অদ্বিতীয় মহামহিম প্রভু। ঈশ্বর ভক্ত ব্যক্তি নির্বাণ বা মুক্তির মাধ্যমে ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। ১০২ ঈশ্বরভক্তি অর্থ হলো ঈশ্বরের ভালবাসা ছাড়া অন্য কিছুতে প্রলুব্ধ না হওয়া। মানুষ ঈশ্বর হবে না তবে ঈশ্বরের সত্তায় মিশে যাবে।